নির্বাচনের ক্ষণগণনা ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-09-01 00:54:06

নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন, ৩০ অক্টোবরের পর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যাবে। এরপর যেকোনো সময় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। সচিব আরো দাবী করেছেন, নির্বাচনের আগে যেসব কাজ থাকে তার শতকরা আশি ভাগ কাজ তারা সম্পন্ন করেছেন। ৩০০ আসনের সীমানা পুননির্ধারণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের প্রশিক্ষণের কাজও তারা যথাসময়েই শুরু করবেন। তার মানে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কাজের তালিকা তারা করে ফেলেছেন এবং যথাসময়েই তারা কাজ শুরু করবেন। নির্বাচন সম্পর্কে ইসির এই বার্তা জনগণের মনে একটি সফল নির্বাচনের প্রাথমিক আশা সঞ্চার করে। সুষ্ঠু না বলে সফল বলার কারণ, সচিব প্রস্তুতিমূলক কাজের যে ফিরিস্তি দিয়েছেন তা মূলত কমিশনের রুটিন বা লজিস্টিক কাজ। এসব কাজ করার জন্য কমিশন নির্বাচনের আগে যথেষ্ট সময় পান। এছাড়া এসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য কমিশনের লোক-লস্করও আছে। একাজগুলো দৃশ্যমান। কিন্তু এর বাইরেও কমিশনের কিছু কাজ রয়েছে যা মূলত সুষ্ঠু নির্বাচনকে তরান্বিত করে। এসব কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নির্বাচনের প্রস্তুতির নানা দিক আছে। নির্বাচন কমিশন যে কাজগুলোর ফিরিস্তি দিয়েছে তা নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক কাজ। বলা যেতে পারে রুটিন কাজও। বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এসব কাজ প্রতিপালনে তাদের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা দিতে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বলা যেতে পারে নির্বাচনকালীন সরকার আসলে নির্বাচন কমিশন। সংবিধানের বিধানগুলো বিশ্লেষণ করলে বা বাস্তবায়ন করলে বিষয়টি এরকমই দাঁড়ায়। কিন্তু তারপরও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমাদের মত-দ্বিমত। এর কারণ, কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সরকারের ওপর নির্ভরশীল। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নিজেকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীন মনে করে কি না।এ বিষযগুলোর ওপর সুষ্ঠু নির্বাচনের অনেক কিছুই নির্ভর করে।

আমাদের আজকের রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ নির্বাচনকালীন সরকার। অথচ এই সংকট নিরসনের চাবিকাঠি কমিশনের হাতেই আছে। সংবিধানই তাকে এ সংকট নিরসনের ক্ষমতা দিয়েছে। এরশাদের গতি হারানোর পর একটি অস্থায়ী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের নজির সৃষ্টি হয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এ সরকার গঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনের ফলাফল সব রাজনৈতিক দল মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আন্দোলনের এজেন্ডা হিসেবে আওয়ামী লীগ-জামাত বেছে নিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী। আর বিএনপির মাগুরামার্কা নির্বাচন সে আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক ভিত্তির ওপর দাড় করালো। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা চিরতরে নির্বাচন কমিশনের কোমড় ভেঙে দিলাম। যেটি হতে পারতো একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবী সেটি হয়ে গেলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবী। এরপর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার ইতিহাস আমাদের সবারই জানা।

গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সংকট আস্থাহীনতা। রাজনীতিরও বড় সংকট এটিই। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি সাংবিধানিক বা বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানেরও সবচেয়ে বড় সংকট এই আস্থাহীনতা। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থাহীনতায় ভোগে তবে সে প্রতিষ্ঠান যতোই ‘আমি স্বাধীন’ ‘আমি স্বাধীন’ বলে চেচামেচি করুক তাকে কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু এ দায় শুধু ওই প্রতিষ্ঠানেরই নয়। দায় বর্তায় সরকারের ওপরও। আজ যারা বিরোধী দলে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঘাটে-অঘাটে তদবির করছে যেদিন সরকারে ছিলেন সেদিন সুষ্ঠু নির্বাচনের নজির সৃষ্টির সুযোগটি তারাও নিতে পারতেন। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, ‘যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবন।’ ভোটে নির্বাচিত হয়ে গদির গরমে সুশাসন, প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতায়ন এসব কথা তিতা লাগে। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায়নের চেয়ে বরং সুশীলদের গালাগালি দেয়া সহজ।

নির্বাচন পরিচালনার জন্য কমিশন প্রস্তুত। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি প্রস্তুত? কমিশন হয়তো বলবে এটি রাজনৈতিক দলের বিষয়। আমার কাজ সময় মতো নির্বাচন পরিচালনা করা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যে প্রস্তুতির কথা বলছে সেটি তার রুটিন কাজ বা লজিস্টিক প্রস্তুতি। এর বাইরে তার রাজনৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। অনেকে বলবেন, নির্বাচন কমিশনের আবার রাজনৈতিক দায়িত্ব কি? সাংবিধানিক ও আইনগত দায়িত্বের বাইরে তার কোনো দায়িত্ব নেই। কিন্তু এ ধারণা সঠিক না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনই কমিশনকে ক্ষমতার চৌহদ্দি নির্ধারণের ক্ষমতা দিয়েছে। সে চৌহদ্দির মধ্যে সে আছে কিনা সেটিই দেখার বিষয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ভোটাধিকার নাগরিকের একটি রাজনৈতিক অধিকার। এ অধিকারটি প্রয়োগ করার মতো অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করার দায়িত্ব কমিশনের ওপরই। এটি কমিশনের ওপর জনগণের একটি আমানত। কমিশনের সেই আমানত রক্ষার জন্য শক্তি, সামর্থ রয়েছে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই কমিশনকে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অনুকূল আবহ সৃষ্টি করতে হবে। এটি সবার জন্যই প্রযোজ্য- ভোটার, প্রার্থী, পোলিং অফিসার, এজেন্টসহ সবাই। একটি নির্বাচনের অংশীজন অনেকে। সবার জন্যই আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। সে রকম একটি রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি করা তফসিল ঘোষণার পরই কমিশনের ওপর বর্তাবে। শুধু ব্যালট পেপার ছাপানো, ভোটকেন্দ্রে পর্দা টাঙানোই শেষ কথা না।

জনগণের আস্থা অর্জন ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই চলতে পারে না। সব দলকেই তাই জনগণের কাছে আসতেই হয়। এটিই গণতন্ত্রের মডেল। নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের এই মডেলকে কার্যকর ও বাস্তবায়ন করে। ফলে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। যেদেশের কমিশন যতো স্বাধীন সেদেশের রাজনীতিও ততো মুক্ত ও স্বাধীন। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কমিশনের ভূমিকা একটি ব্রিজের মতো। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে সবাই সে ব্রিজ পার হয়ে ওপারে যেতে চায় (ক্ষমতায় যেতে চায়) কিন্তু কেউ ব্রিজটিকে একটু পাকাপোক্ত করার জন্য কাজ করে না। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মাঝেই আস্থার সংকটে ভোগে।

নির্বাচনের ক্ষণগণনার সঙ্গে সঙ্গেই সব রাজনৈতিক দল, ভোটার তথা জনগণের মাঝে একটি আদর্শ নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালনে সাফল্যের পরিচয় দেবে এটাই জনগণের দাবী।

এ সম্পর্কিত আরও খবর