তোফাজ্জল-শামীমেই শেষ হোক!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী এক যুবকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। নিহত যুবক ছিলেন অনেকটাই অপ্রকৃতিস্থ। হন্তারকদের ধারণা ছিল তিনি ‘চোর’; ঠিক এ সন্দেহে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন তারা। অর্থাৎ স্রেফ সন্দেহের বশে একটা তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তারা।
সন্দেহে হত্যা বা অসাবধানতায় অতি প্রহারে প্রাণ গেছে এমন না তোফাজ্জলের। রীতিমত উৎসব করে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রাণনাশের আগে কয়েকদফা প্রহারের মধ্যবর্তী সময়ে তাকে পেট পুরে ভাত খাওয়ানো হয়েছে। পানি দেওয়া হয়েছে। আধমরা অবস্থায় যুবকটি যখন পানি খাচ্ছিল, অর্থাৎ তার মাঝে যখন প্রাণের উপস্থিতি দৃশ্যমান, তখন সেটা দেখে প্রহারকারীরা হাততালিও দিয়েছে, আরও কিছু প্রহারের সুযোগ পাওয়া গেছে বলে!
বিষয়টি যত সহজে লিখছি, আদতে এটা তত সহজ না। হৃদয় বিদারক। মর্মস্পর্শী এই ঘটনা নাড়া দিয়েছে সবাইকে। বিচারের দাবি ওঠেছে। এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তৎপর হয়েছে। শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের একজন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সরকার পতন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, এবং সে সুবাদে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান করছেন, অন্যদের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদেরকে বলা যায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’।
গণমাধ্যমে নিহত তোফাজ্জলের যে পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি পরিবার ও অভিভাবকহীন। বাড়ি বরগুনায় হলেও ঢাকার রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরতেন। বছর দশেক আগে বাবা, এর তিন বছর পর মা এবং তারপর একমাত্র বড় ভাই মারা যান তোফাজ্জলের। ভাইয়ের মৃত্যুর পর একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে মারধরের শিকারও হন তোফাজ্জল, এবং এরপর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলা বিষয় অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বঙ্গবন্ধু ল কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন তিনি, এমনটাই গণমাধ্যমের খবর।
ফজলুল হক মুসলিম হলের যে ছাত্ররা চোর সন্দেহে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রহার করছিল, তারা যোগাযোগ করে তোফাজ্জলের পরিবারের সঙ্গে। মোবাইলের ৩৫ হাজার টাকা দাম চায় বলে জানিয়েছেন তার মামাত বোন। তোফাজ্জল কীভাবে পরিবারের সদস্যদের মোবাইল নম্বর মুখস্থ রাখতে পারল, এটা নিয়েও তাদের সন্দেহ ছিল। এবং সন্দেহ একদিকে যেমন বাড়ছিল তাদের, অন্যদিকে বাড়ছিল মারধরের গতিও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ওই সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাপর শিক্ষার্থীদের কেউ এই মারধর বন্ধে এগিয়ে আসেনি। মিছিল-প্রতিবাদ এই কদিন যেখানে ছিল অতি স্বাভাবিক, সেই স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় দেখা গেল এবার খোদ সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই।
হত্যার আগে তাকে ভাত খাওয়ানো হয়েছিল। মৃত্যুর আগে পানি চেয়ে কদিন আগে পাননি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পা হারানো সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ। তোফাজ্জলের ক্ষেত্রে কেবল পানিই নয়, ভাতও খাওয়ানো হয়েছিল। এক গরিব ভবঘুরের প্রতি এটা মানবিক আচরণ নয় কোনোভাবেই, বরং এটাও ছিল পরিহাস। প্রথমে তার দারিদ্র নিয়ে পরিহাস করেছে ছাত্ররা, এরপর তার জীবন নিয়ে খেলেছে, এবং তাদের ‘চোর-পুলিশ’ খেলায় বলি হয়েছে একটা তরতাজা প্রাণ। এখানে আমাদের সমাজমানসের চিত্রের দেখা মেলে। সাধারণত অপ্রকৃতিস্থ, আরও পরিস্কার করে বললে যাদের ‘পাগল’ ভাবা হয়, তাদেরকে আমাদের সমাজ কী চোখে দেখে তার একটা পরিস্কার ধারণা পাওয়া গেল। ‘পাগলদের’ চাইলেই মারধর করা যায়, ‘পাগলদের’ বেঁচে থাকার অধিকার নাই, এবং ‘পাগলদের’ মারধর করা আনন্দপ্রদায়ক অনেকের কাছে। এই ঘটনা কি তার প্রকাশ নয়? দুঃখজনক বিষয়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের একাংশ এখনো এই কলুষিত চর্চায়।
বলতে দ্বিধা নেই এটা ঠান্ডা মাথায় খুন। উৎসব করে খুন বললেও কি অত্যুক্তি হবে? সম্ভবত না! অথচ তারা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত। তারা সার্টিফিকেট অর্জন করে এখানে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু ন্যূনতম যে মানবিকতা সেটা ধারণ করতে পারেনি। মানুষের জীবনের কোন মূল্য নাই তাদের কাছে। তারা কি সত্যি বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকারের মধ্যে আছে এখনো? ঠান্ডা মাথার এই খুন অন্তত সে সাক্ষ্য দেয় না। বরং বলছে তারা সঠিক পথে নেই।
তোফাজ্জল হোসেন যেদিন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, সেদিনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পিটুনিতে নিহত শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। গত বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটকের একটি সেলুনের সামনে পরিচিত একজনের অপেক্ষায় থাকা শামীমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী মারধর শুরু করে, একপর্যায়ে তাকে টেনে ক্যাম্পাসের ভেতরে নিয়ে আরও কয়েকজন মিলে মারধর করেন। এবং শেষ পর্যন্ত তারও মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে আছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একাধিক নেতা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক। এই ঘটনাও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে দেশে, দাবি ওঠেছে বিচারের। একই দিনের এই দুই ঘটনাই কেবল নয়, দিনের আগে-পরে এমন ঘটনা ঘটছে, এবং এগুলো অনেকেই ‘মব জাস্টিস’ আখ্যা এবং ‘গণপিটুনিতে মৃত্যু’ উল্লেখে হালকা করে দেখানোর প্রয়াস চালাচ্ছেন। এগুলো সঠিক নয়। এসব মূলত অনিয়ন্ত্রিত আচরণ ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং এর প্রতিবাদ ও আইনি প্রতিবিধান হওয়া উচিত।
খানিক বিরতি শেষে তোফাজ্জল হোসেন ও শামীম আহমেদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেগে ওঠতে শুরু করেছে আমাদের বিবেক। এটাকে ধরে রাখা উচিত আমাদের। ক্যাম্পাসে কিংবা দেশের যেকোনো জায়গায় বিচার বহির্ভূত যেকোনো হত্যাকাণ্ড এবং যেকোনো আইনবিরুদ্ধ ঘটনায় আমাদের এভাবেই জেগে ওঠা ও সচেতন থাকা উচিত। তোফাজ্জল-শামীম হয়ত শেষ নয়; তবু আমাদের চাওয়া এখানেই শেষ হোক, এখানেই থামা উচিত।