নির্বিবাদে এটি সবাই স্বীকার করবেন যে অনেকের চেয়ে বেশি অবদান রেখেও সবচেয়ে অবহেলিত আমাদের কৃষকরা। কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ নিয়ে সর্বদা সোচ্চার থাকা জরুরি হলেও এ নিয়ে কথা বলা মানুষের বড়ই অভাব। ফসলের উৎপাদন থেকে বিপণন-এর প্রতিটি ধাপে কৃষকদের যেসব নিগ্রহের ভেতর দিয়ে যেতে হয় তা দেখভালে সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে সামান্যই।
বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) মাল্টিমিডিয়া নিউজপোর্টাল বার্তা২৪.কম-এ ‘গাইবান্ধায় ৩২ লাখ টাকার নকল কীটনাশক পুড়িয়ে ধ্বংস’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে ফের স্পষ্ট হয়ে উঠল আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় কত অসঙ্গতি বিরাজমান। বছরের বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে আমরা জানতে পারি, পোকার আক্রমণে ফসলহানিতে দিশেহারা কৃষক, ভেজাল সার-কীটনাশক কিংবা বীজে সর্বাশান্ত কৃষকের হাহাকার নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন।
এ ধরণের সংবাদ প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছুদিনের জন্য তৎপর হয়ে উঠলেও অবস্থার যে বিশেষ উন্নতি হয় না। কৃষি ও কৃষকবিনাশী প্রতিষ্ঠানগুলো যে অবাধেই তাদের অনৈতিক ব্যবসার প্রসার বৃদ্ধি করতেই থাকেন তা আমরা পরের বছরে সংবাদপত্রে একই ধরণের খবর দেখে বুঝতে পারি। অভিযোগ রয়েছে, ভেজাল কীটনাশক কিংবা মানহীন বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোন খবর বেরুলে তা কৃষির সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উপরি আয়ের জোগাড় হয়। কারণ ব্যবস্থা নেবে যে কর্তৃপক্ষ তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নীরব হয়ে যান, ভেজাল পণ্য উৎপাদকরা নতুন উদ্যোমে লেগে যান উৎপাদনে!
২০২৪ সালের বিবিএস এর পরিসংখ্যান বলছে, জিডিপিতে দেশের কৃষি খাতের অবদান ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে এটি নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, আমাদের গবেষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতসহ উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেও কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় থেকে যাওয়া অসঙ্গতি এই খাতের প্রবৃদ্ধিকে ক্রমেই পেছনে টানছে।
বার্তা২৪.কম-এ প্রকাশিত খবর জানাচ্ছে, গাইবান্ধায় জেলার শহরের খাঁ পাড়া এলাকায় জব্দকৃত ৩২ লাখ টাকার নকল কীটনাশক আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এসময় নকল কীটনাশক বিক্রি ও মজুদের দায়ে তারিকুল নামের এক ব্যবসায়ীকে তিন মাসের দণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নামি-দামি কোম্পানির প্যাকেট এবং মোড়ক তৈরি করে তাতে নকল কীটনাশক ভরিয়ে অধিক মুল্যে বাজারে বিক্রি করতেন ব্যবসায়ী তারিকুল।
আরও পড়ুন: গাইবান্ধায় ৩২ লাখ টাকার নকল কীটনাশক পুড়িয়ে ধ্বংস
দেশের বিভিন্ন জনপদে কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে যা জানার সুযোগ হয়েছে, তাতে এটি নির্দ্বিধায় বলা যায় গাইবান্ধার তারিকুলের মতো ব্যবসায়ী দেশের সবখানেই রয়েছে। যদি কীটনাশক বিক্রির লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ কিংবা কৃষি বিভাগের স্ব-স্ব এলাকার কর্মচারীরা এসব ভেজাল পণ্য নির্মূলে বদ্ধপরিকর না হন তবে এ ধরণের অভিযান কৃষকের সর্বশান্ত হওয়া ঠেকাতে পুরোপুরি সমর্থ হবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত, দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়াসহ ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই অনিবার্য হয়ে পড়েছে। অঞ্চলভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় যে বৈচিত্র এসেছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বালাই ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলা গেলে এবং এ ধরণের ভেজাল কীটনাশকে বাজার সয়লাব হয়ে গেলে ফলন বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।
যেহেতু আমাদের দেশে কৃষকের কণ্ঠ এখনও সেভাবে সোচ্চার নয় তাই সংখ্যায় বিপুল হলেও তাদের স্বার্থ উপেক্ষিতই থাকছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, দেশে কীটনাশকের বাজার ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশীয় ৬ শতাধিক কোম্পানি মাত্র ৭শ’ কোটি টাকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও বহুজাতিক কোম্পানির কাছেই রয়েছে সিংহভাগ কর্তৃত্ব। তাই মাঠ পর্যায়ে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ভেজাল বিক্রেতাদের নির্মূল করার পাশাপাশি ভেজাল সরবরাহকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন।
প্রয়োজনে দেশের জ্যেষ্ঠ কৃষিবিদদের পরামর্শ নিয়ে কৃষি উৎপাদনবিনাশী ও কৃষকদের সর্বশান্তকারী এই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের সামর্থ্য বাড়ানোর বিকল্প নেই। অপেক্ষাকৃত অধিক আলোচিত বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে গিয়ে সেদিকেই অভিযান পরিচালনার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থরক্ষায় এ ধরণের অভিযান অব্যাহত রাখতেই হবে।