যে কোনো শিক্ষা পদ্ধতির প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো নিরাপত্তা ও আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক প্রতিভার বিকাশ ঘটানো। শিক্ষার্থীর সুপ্ত মেধাকে প্রকাশ করা এবং ক্রমে ক্রমে দক্ষতার স্তরে উপনীত করাই শিক্ষার মূল্য লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ।
পশ্চিমা বা প্রাচ্য, আধুনিক বা ধর্মীয়, শিক্ষার ধরণ বা পদ্ধতি বা সিলেবাস যা-ই হোক না কেন, সর্বক্ষেত্রে শিক্ষা প্রদানের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ অভিন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মূল্য লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। 'গরুর মতো পিটিয়ে ছাত্রকে মানুষ করার' একটি বর্বর ও মধ্যযুগীয় প্রবণতা আমাদের চারপাশে দেখা যায়। শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও আনন্দের বদলে নির্মম অত্যাচার, কখনো যৌন নির্যাতন করার মাধ্যমে শিক্ষাজীবনকে কারাগারে রূপান্তরিত হয়।
এসব অত্যাচারে বহু ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে। কেউ কেউ স্বাভাবিক বিকাশের বদলে বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন হয়েছে। অত্যাচার-নির্যাতনের পাশাপাশি জোর করে মুখস্ত করানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক প্রতিভার বিকাশ ও সুপ্ত মেধাকে প্রকাশ করার বদলে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যমান এসব সমস্যা সবারই জানা। বিশেষত নির্যাতনের বিষয়টিও ওপেন সিক্রেট। তথাপি কোনো কোনো পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা স্পর্শকাতর ইস্যু রূপে সামনে আসে। মানুষের বিবেক ও সংবেদনশীলতা নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এসব নির্যাতনের ঘটনায় সমাজের মানুষ ব্যথিত ও আতঙ্কিত হয়। যেমন ঘটেছে গত মঙ্গলবার (৯ আগস্ট)।
চট্টগ্রামে সংঘটিত ঘটনাটি অতি সামান্য হলেও তার শাস্তির রূপটি ছিল ভয়াবহ ও পাশবিক। হেফজ বিভাগের শিশু ছাত্র ইয়াসিন ফরহাদকে দেখতে মঙ্গলবার বিকালে তার বাবা-মা মাদরাসায় আসেন। তারা চলে যাওয়ার সময় ইয়াসিন তার মায়ের কাছে ছুটে যায়। মা তখন মাদরাসার বাইরে। শিক্ষক এ অপরাধেই তাকে বাইরে থেকে ঘাড় ধরে মাদরাসার ভেতরে নিয়ে মারধর শুরু করেন। দীর্ঘকাল তাকে মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে পেটানো হয়। আহত ও আক্রান্ত শিশুটি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাতরাতে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোমহর্ষক নির্যাতনের ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। ফলে ঘটনাটি বিচারের আওতায় আসে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে চাকরিচুত্য করা হয়। কিন্তু এতেই সমস্যাটির মূল শেকড়বাকড় উৎপাটিত হয় না। অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়।
বিশেষত বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অন্ত নেই। কিছু আছে মাদরাসা শিক্ষা বিরোধীদের ষড়যন্ত্রমূলক প্রোপাগান্ডা। কিন্তু বিরোধীদের কথা বাদ দিলেও ভেতর থেকে যেসব সমস্যার লক্ষণ দেখা যায়, তার উত্তর কে দেবে? মাদরাসা শিক্ষায় ধর্মের মানবিক ও আদর্শিক বিষয় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এহেন নির্মমতা কেন?
আরও বেদনার বিষয় হলো ইলম শিক্ষায় আগত শিশুদের মারপিট, যৌন নিপীড়নের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তিগত কাজে নিয়োজিত করা হয়। ওস্তাদের খেদমত বা সেবার নামে শরীর মালিশ, কাপড় ধৌত করা বা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার বিষয়টিও দুঃখজনক।
এসব বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। এসব কাজের ফলে মাদরাসা শিক্ষার ইমেজ ও ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাদরাসা শিক্ষা বিরোধীদের আঘাতের চেয়ে ভেতরের এসব অপনীতি ও অব্যবস্থা অনেক বেশি ক্ষতি করছে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার।
মোদ্দা কথায়, মাদরাসা বা আধুনিক তথা শিক্ষার কোনো ক্ষেত্রেই নির্মমতা মোটেই কাম্য নয়। শিক্ষাকে নির্যাতন ও আতঙ্কের জায়গা থেকে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় পরিবেশে উত্তরণ করা সকলের দায়িত্ব। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুষ্ঠু ও প্রকৃত বিকাশের স্বার্থেই এসব অনাচারের মূলোৎপাটন করা সরকার, সমাজ ও মানুষের একান্ত কর্তব্য।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম