এক কান কাটা গেলে মানুষ একদিক দিয়ে হাঁটে। আর দুই কান কাটা গেলে হাঁটে মাঝখান দিয়ে। মামুনুল হকের হয়েছে সেই দশা। তার দুই কান কাটা গেছে, এখন তিনি মাঝখান দিয়ে হাঁটছেন। ফেসবুক লাইভে এসে বড় বড় কথা বলছেন, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হুমকি দিচ্ছেন। কিন্তু তার সব গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে এই কলামে ‘মামুনুলের মিথ্যাচার’ শিরোণামে যা লিখেছিলাম, তাতে তার অন্ধ ও উগ্র অনুসারীরা আমার চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করেছিলেন। রয়েল রিসোর্টে মামুনুলের সাথে থাকা নারীর বোরকার রং নিয়েও তর্ক করেছিলেন কেউ কেউ। এমনকি অনেকে সেই নারীকে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার স্ত্রী বানিয়ে দিয়েছিলেন। ফাঁস হওয়া টেলিফোন সংলাপকে অনেকে বানানো বলে চালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মামুনুল নিজে ফেসবুক লাইভে এসে তার সকল মিথ্যা আর অপকর্ম স্বীকার করেছেন। মামুনুল হকের ফেসবুক লাইভের পর এটা প্রমাণিত হয়েছে, আমার লেখার প্রতিটি বর্ণ সত্য। আমি তখন শুধু দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। মামুনুলকে ধন্যবাদ, তিনি আমার হিসাবটা মিলিয়ে দিয়েছেন। তবে এখনও তিনি অনেক সত্য গোপন করেছেন, অনেক মিথ্যা প্রতিষ্ঠিতকরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আসলে সব পাপের উৎস হলো মিথ্যা। মামুনুল একের পর এক মিথ্যা বলে নিজের ফাঁদে নিজেই আটকে যাচ্ছেন। তার এক কথার সাথে আরেককথা মিলছে না। এমনকি মিথ্যার স্বীকৃতি দেয়া ফেসবুক লাইভটিও তিনি পরে সরিয়ে নিয়েছেন।
মামুনুল হক দাবি করেছেন, ‘ইসলামি শরিয়তের মধ্যেও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে যে, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য, স্ত্রীকে খুশি করবার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে, সীমিত পরিসরে সত্যকে গোপন করারও অবকাশ রয়েছে।’ ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করার কী ভয়ঙ্কর অপচেষ্টা। ইসলামে কোনোভাবেই সত্য গোপন করা, মিথ্যা বলা বা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। স্ত্রীকে খুশি করার জন্য যেটুকু সিত্য গোপন করার অবকাশ রাখা হয়েছে, মামুনুল তার সীমা লঙ্ঘণ করেছেন অনেক আগেই। আমার ধারণা মামুনুল দ্বিতীয় বিয়েটা করেনইনি। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে তার দাবি যদি সত্যিও হয়, তাহলে দুই বছর ধরে প্রথম স্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় বিয়ের খবর গোপন রাখা কোনোভাবেই ‘সীমিত পরিসরে সত্য গোপন করার’পর্যায়ে পড়ে না। এটা ভয়ঙ্কর মিথ্যা এবং বাংলাদেশের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের আইনে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করারই কোনো সুযোগ নেই। সেখানে দুই বছর সেই বিয়ের খবর গোপন রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না। অনুসারীরা ছিনিয়ে আনার পর প্রথম স্ত্রীকে ফোন করে তিনি বলেছিলেন, সাথে থাকা নারী ‘আমগোর শহীদুল ভাইয়ের ওয়াইফ’। এটাও ‘সীমিত পরিসরে গোপন করার মত সত্য নয়’।
আরেকজনের স্ত্রীকে নিয়ে রিসোর্টে যাওয়ার কোনো অবকাশ ইসলামে নেই। ফেসবুক লাইভে অনেক সত্য স্বীকার করলেও সবচেয়ে বড় সত্যটি তিনি এখনও লুকিয়ে রেখেছেন। দ্বিতীয় বিয়ের পক্ষে এখনও কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। দুয়ে দুয়ে চার মেলালে এটা পরিষ্কার, ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাফেজ শহীদুল ইসলামের স্ত্রীর প্রতি তার কুনজর পড়েছিল। তাই জোড়া লাগানোর নামে আসলে তিনি স্বামী-স্ত্রীর ছোটখাটো সমস্যাকে বড় করে সংসারটি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তারপর সেই নারীকে দুই বছর ধরে রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। এখন তো জানা যাচ্ছে শুধু জান্নাত আরা ঝর্না নন, তার মত আরো একাধিক রক্ষিতা ছিল মামুনুলের। ধরা পড়ার পর একজনকে সেকেন্ড ওয়াইফ বানিয়েছেন, আবার ধরা পড়লে থার্ড ওয়াইফ, ফোর্থ ওয়াইফও আবিস্কার হবে। আর মামুনুল তো নির্লজ্জের মত বলেই দিয়েছেন, আমি একাধিক বিয়ে করলে কার কী? ঠিক বলেছেন, মামুনুল চারটি বিয়ে করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যেহেতু কথায় কথায় ইসলামের দোহাই দেন, তাই তাকে ইসলামের নিয়ম মেনেই বিয়েগুলো করতে হবে। মামুনুলের দাবি করা দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী আইন এবং দেশের প্রচলিত আইন বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রথম কথা হলো, তিনি প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়েই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। শুধু প্রথম স্ক্রী নয়, পরিবারের কাউকেই তিনি দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানাননি। মামুনুলের বোনের সাথে তার প্রথম স্ত্রীর টেলিফোন আলাপে এটা প্রমাণিত। এভাবে গোপনে বিয়ে করার অনুমোদন ইসলামে নেই। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে না হলেও পরিবার, সমাজকে বিয়ের খবর জানাতে হবে। কিন্তু পাত্র মামুনুলের পরিবার যেমন বিয়ের খবর জানে না, পাত্রী জান্নাত আরা ঝর্নার পরিবারও জানে না। আসলে যে বিয়ে হয়ইনি, সে বিয়ের খবর কীভাবে মানুষ জানবে। ধরে নিচ্ছি, মামুনুল দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, তা হলেও এটা ইসলামসম্মত নয়। কারণ একাধিক বিয়ে করতে হলে সব স্ত্রীকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু মামুনুল জান্নাত আরা ঝর্নাকে রক্ষিতার বেশি মর্যাদা দেননি। মর্যাদা তো দূরের কথা, সামাজিক স্বীকৃতিই দেননি। মামুনুলের মত একজন ধনবান পরিবারের সন্তানের দ্বিতীয় স্ত্রীকে কেন সাবলেট থাকতে হবে, কেন সংসার চালাতে পার্লারে কাজ করতে হবে? দ্বিতীয় বিয়েটি যে মামনুল করেনইনি তার অনেক প্রমাণ আছে। জান্নাত আর ঝর্নার একাধিক টেলিফোন সংলাপে বলেছেন, বিয়ে বা কোথায় বিয়ে হয়েছে, এ ব্যাপারে তাকে যেন শিখিয়ে দেয়া হয়। মামুনুল কেন একেকবার একেক কথা বলছেন, কেন বারবার মিথ্যা বলছেন; তা নিয়েও আক্ষেপ ঝরেছে জান্নাত আরার কণ্ঠে। আর জান্নাত আর ফাঁস হওয়া ডায়রিতে বিয়ের কোনো কথা নেই। এক দুশ্চরিত্রের ফাঁদে পড়া এক অসহায় নারীর হাহাকার ডায়রির পাতায় পাতায়। সেখানে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, মামুনুল টাকার বিনিময়ে তার শরীরকিনেছেন। সেখানে প্রেম-ভালোবাসা বা বিয়ের কোনো ব্যাপার নেই। মামুনুল যে দ্বিতীয় বিয়েটি করেনইনি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রয়েল রিসোর্টের রেজিস্ট্রারে। স্থানীয় জনতা আটকের পর না হয় তার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, তিনি ভয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নামের বদলে প্রথম স্ত্রীর নাম আমেনা তৈয়েবা বলে ফেলেছিলেন। কিন্তু রিসোর্টের রেজিস্ট্রারে কেন ঠান্ডা মাথায় স্ত্রীর নামের ঘরে আমেনা তৈয়েবা লিখেছিলেন? তিনি যদি সত্যিই দ্বিতীয় বিয়ে করে থাকতেন, তাহলে তো রেজিস্ট্রারে জান্নাত আরা ঝর্নার নামই লিখতেন। মামুনুলের রিসোর্ট কেলেঙ্কারির শুরুটাই হয়েছে মিথ্যা দিয়ে। পরে অজস্র মিথ্যা তাকে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ফেলেছে।
ধরা পড়ার পর মামুনুল যে শরিয়তসম্মত বিয়ের দাবি করছেন, তার কোনো সাক্ষি-প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি। মামুনুল যে ধরনের বিয়ের দাবি করছেন, তা হলো দুশ্চরিত্র পুরুষের ঢাল। নারীকে পটানোর জন্য ‘আকাশ-বাতাস সাক্ষী রেখে বিয়ে’, ‘আল্লাহর নামে বিয়ে’, ‘আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বিয়ে’,‘কবুল-কবুল-কবুল বলে বিয়ে’ এ ধরনের অনেক উদাহরণ আছে চারপাশে। কিন্তু এ ধরনের বিয়ের আইনগত বা ধর্মীয় কোনো বৈধতাই নেই। অথচ হেফাজতে ইসলাম রীতিমত বৈঠক করে মামুনুলের কাল্পনিক বিয়েকে বৈধতা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, ‘হেফাজতে ইসলাম’ আসলে ইসলামকে হেফাজত করছে না। তারা তাদের নেতাদের লাম্পট্য ঢাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে শুধু। মামুনুল হক তার ফেসবুক লাইভে অনেক সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। টেলিফোন ফাঁস নিয়ে আপত্তি থাকলেও কথোপকথন অস্বীকার করেননি। মামুনুল বারবার কসম কাটেন, চ্যালেঞ্জ জানান। আমিও তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, শরিয়তসম্মত বিয়ের ছেলেমানুষি দাবি বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ জাতির সামনে দাখিল করুন। নইলে অবিলম্বে জান্নাত আরা ঝর্নাকে বিয়ে করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিন।
মামুনুল যদি দ্বিতীয় বিয়েটি করেও থাকেন, তাহলে প্রথম স্ত্রীর কাছে সেটা দুই বছর গোপন রেখে এবং কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রাপ্য মর্যাদা না দিয়ে তিনি ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ করেছেন। আর যদি আমার ধারণামতে বিয়েটি না করে থাকেন; তাহলে তিনি ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যভিচার করেছেন। তার কোনো স্ত্রী আদালত পর্যন্ত যেতে পারলেও ফেঁসে যাবেন মামুনুল। কিন্তু মামুনুলের প্রথম স্ত্রী বা কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর কোনো খোঁজ নেই। মামুনুলের পান্ডাদের ভয়ে তারা হয়তো কখনো আদালত পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগই পাবেন না।
হেফা্জতে ইসলাম এবং মামুনুলের অন্ধ সমর্থকরা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝেছেন, মামুনুল একটি মিথ্যাবাদী, ভন্ড এবং প্রতারক। তার লাইভ আশা করি আপনাদের চোখ খুলে দিয়েছে। তার অপরাধকে ঢাকতে গিয়ে আপনারা আর ইসলামকে হেয় করবেন না, ইসলামকে ব্যবহার করবেন না। আপনারা আপনাদের সংগঠন এবং নিজেদের নৈতিক মান সমুন্নত রাখতে ব্যভিচারী মামুনের পক্ষে আর দাড়াবেন না। মামুনুলকে ছুঁড়ে ফেলুন। আপনার সত্যিকারের ইসলামের ছায়ায় ফিরে আসুন।
লেখক: প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ