মানুষের মস্তিষ্কে নিউরোনের (মস্তিষ্কের কোষ) সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন)। মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় ১০ হাজার কোটি নিউরোনের প্রতিটি কয়েক হাজার থেকে প্রায় ৫ লাখ নিউরোনের সাথে সংযুক্ত। মানুষ মস্তিস্কের কোষ অর্থাৎ নিউরনগুলো যত বেশি ব্যবহার করবেন, ততই মানুষের সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও সাফল্য বাড়বে। যদিও অধিকাংশ মানুষ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হয়ে হতাশা, আলস্য ও বিভিন্ন নিজ সৃষ্ট (Self-Created) অজুহাতের কারণে তাঁর নিজের মস্তিস্কের নিউরোনের অল্প সংখ্যক কাজে লাগায়, ফলে জীবনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায় না। মানুষের সাফল্যের পেছনে নেপথ্যে থেকে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে সঠিক (ইতিবাচক/পজিটিভ) দৃষ্টিভঙ্গি। মস্তিষ্কের এই অফুরন্ত ক্ষমতা ও শক্তি কতটা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবেন তা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। মানুষের সাফল্যের পেছনে নেপথ্য ভূমিকা পালন করে সঠিক (ইতিবাচক/পজিটিভ) দৃষ্টিভঙ্গি।
সঠিক (ইতিবাচক/পজিটিভ) দৃষ্টিভঙ্গি কি? ‘আপনার কি নাই বা কি আপনি পারেন না বা কি আপনি হারিয়েছেন — তা নিয়ে হতাশায় ও আত্মবিশ্বাসহীনতায় না ভুগে যা আপনি পারেন তা দিয়ে শুরু করাটাই’ হচ্ছে — সঠিক (ইতিবাচক/পজিটিভ) দৃষ্টিভঙ্গি। আমেরিকার খ্যাতিমান অপেরা উইনফ্রে এর বিখ্যাত উক্তি, ‘মানবজাতির সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর একটি হলো তারা এ বিষয়টি খুঁজে বের করতে পেরেছে যে মানুষ তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমেই জীবন পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।’
আসলে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাকে 'সংকটে' পরিণত করে; আর ইতিবাচক/পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাকে পরিণত করে 'সম্ভাবনায়'।
প্রয়াত ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং মানুষটিই এক অনুপ্রেরণার নাম। ২১ বছর বয়স থেকেই মোটর নিউরন নামে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগেছেন। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতা তাঁকে রুখতে পারেনি। স্টিফেন হকিংয়ের বিখ্যাত উক্তি, প্রথমত, মাটির দিকে নয়, বরং আকাশের ওই তারাগুলোর দিকে চোখ রাখতে কখনো ভুলো না।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, মানুষকে জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে সংগ্রাম করতেই হয়। যারা ছাত্রজীবনে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, তারা সাধারণত সুন্দর ক্যারিয়ার নিয়ে বাকি জীবন আরামে ও মর্যাদার সাথে কাটায়। আর যারা ছাত্রজীবনে আরাম ও আলস্যে কাটায়, তারা সচরাচর বাকি জীবন চরম কষ্ট ও অর্থ সংকটে দুঃসহ জীবন যাপন করে।
জীবনে ব্যর্থ হওয়ার মুখ্য কারণগুলো হচ্ছে — নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের ও সুন্দর পরিকল্পনার অভাব। খ্যাতিমান Mentor Myron Sta. Ana উক্তি করেছেন, "A good plan is a success half-done whereas a bad plan is a possible failure in progress." অর্থাৎ একটি সুন্দর পরিকল্পনা সাফল্য সুসম্পন্নের অর্ধেক; পক্ষান্তরে খারাপ পরিকল্পনা সাফল্যের পথে ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁঁড়ায়।
ভারতের খ্যাতিমান রাজেশ মুরথি এর বিখ্যাত উক্তি, “জীবনের ৫০% ঠিক হয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা, এবং বাকিটাও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। জীবনে সবচেয়ে বড় জিনিসটা হলো দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করা, এটা হয় আপনার ভিতর ছাইচাপা আগুনকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে আপনাকে উজ্জ্বল করবে নতুবা আপনার সকল স্বপ্নকে মাটি চাপা দিতে পারে।” উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, “দৃষ্টিভঙ্গি জীবনে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম।”
আমরা প্রতিনিয়ত যে কাজ করছি, তা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত। তথ্য ও পরিবেশ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। মানুষ যা করে তা দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা তাড়িত হয়ে করে। সঠিক ও পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি পরিশ্রমে বাধ্য করে। ভারতের প্রয়াত বিজ্ঞানী ও সর্বকালের জনপ্রিয় (একাদশ) রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের একটি উক্তি, "মানুষ তার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে। অভ্যাসই মানুষের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে দেয়।" আর এই অভ্যাস পরিবর্তনের চাবিকাঠি হচ্ছে — দৃষ্টিভঙ্গি।
আসলে মানুষের শরীরের চেয়ে মন অনেক বেশি শক্তিশালী। মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা একটা সুপার কম্পিউটারের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। আমাদের কল্পনা ও বিশ্বাস অর্থাৎ ‘মনছবি’ তো এই নিউরোনগুলো পর্যায়ক্রমে আস্থা স্থাপন করে কাজের মাধ্যমে আমাদেরকে লক্ষ্যে পৌঁছায়। জীবনের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হলেই আত্মবিশ্বাস আসবে। সে কারণে নিজের মধ্যে ১০০% আস্থা তৈরিতে লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট করাটা জরুরি। প্রশান্ত মনের স্থির পর্দায় সফলতার ব্লু প্রিন্ট (প্রতিচিত্র) অর্থাৎ ‘মনছবি’ আঁকতে হবে। ‘মনছবি’ হচ্ছে মনের পর্দায় শুভ গভীর বিশ্বাস, একাগ্র চিত্তে ও গভীর মনোযোগে লালিত সাফল্যের ছবি। অর্থাৎ আপনি ভালো যা পেতে চান তা একাগ্রভাবে প্রথমে চাওয়া, চাওয়াটা ‘পাবোই’ বলে বিশ্বাস করা ও আন্তরিকভাবে বাস্তবায়নে কাজ করা। ‘মনছবি’ হলো শুভ চাওয়া, বিশ্বাস ও পরিশ্রমে লালিত ভবিষ্যতের বাস্তবতা (Future Reality) যা যে কোন সাফল্যের 'ভ্রুণ'।
মনছবির এ প্রক্রিয়ার ফলপ্রসূতার জন্য নিম্নোক্ত ০৪টি শর্ত আছে —
১) স্থির লক্ষ্য; ২) লক্ষ্যে আস্থা ও একাত্মতা; ৩) লক্ষ্যে আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ; ৪) লক্ষ্য পূরণে নীরবে কাজ।
স্থির ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যের ছবি (মনছবি) যখন মনে গেঁথে যায় তখন মানুষের মস্তিষ্কের কর্মগঠন বদলে যায় এবং তখন আপনার মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্য বাস্তবায়নের কাজে লেগে যায়। এটি বিজ্ঞানসম্মত। মনে রাখবেন, বারবার লক্ষ্য পরিবর্তন করলে আপনার মস্তিষ্ক কর্মপন্থা ঠিক করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সেকারণে লক্ষ্যে ও লক্ষ্য পূরণে কাজে সংকল্পবদ্ধ থাকুন। লক্ষ্য পূরণে নীরবে নিরলসভাবে কাজ করুন। তাড়াতাড়ি পাওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করুন।
আমরা মনে মনে নিজের যে ছবি আঁকি, ধীরে ধীরে আমরা তাতে পরিণত হই। ঔপন্যাসিক কূট ভনেগার্টের ভাষায়, ‘আমরা নিজেদের সম্পর্কে যা কল্পনা করি আমরা আসলে তা-ই’। আমরা যখন একাগ্র কল্পনায় আমাদের লক্ষ্যের ছবি মনে গেঁথে ফেলি তখন তা ব্রেন ও স্নায়ুতন্ত্রকে (নার্ভাস সিস্টেম) স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য অর্জনের পথে পরিচালিত করে। মনছবিকে আমরা তুলনা করি মিসাইলের সাথে। মিসাইলের যেমন টার্গেট নির্ধারণ করে দিলে আর কোনো দিক-নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না। মিসাইল নিজের পথে এগিয়ে চলে, মনছবিও ঠিক তেমনি। মনছবির মাধ্যমে লক্ষ্যের ছবি অবচেতন মনে বসিয়ে দিলে মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে তার সকল শক্তিকে নিয়োগ করে অবিরাম কাজ করে যায়। দুর্দমনীয় আগ্রহ ও উদ্যম সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার জন্যে যা যা করা দরকার তা করার জন্যে মনের গভীরে একটা তাড়না সৃষ্টি করে।
ড. মু. আলী আসগর: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়