একবার ভাবুন। একজন অতিরিক্ত সচিব দেশসেরা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের গলা চেপে ধরে আছেন। তাও সচিবালয়ের মতো একটি জায়গায়। সেখানে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেনস্তা করছেন। তারপর দিয়েছেন পুলিশে। পুলিশ তাকে থানায় এনে সারা রাত আটক রেখে সকালে আদালতে তুলেছেন। পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়েছেন। বিচারক সাহেব রিমান্ড বাতিল করে তাকে কারাগারে প্রেরণ করেছেন। সেই সাংবাদিক প্রিজন ভ্যানে তুলার সময় বলছিলেন, তার সঙ্গে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে। এর মাঝে তাকে পুলিশ আর তাকে কোনো কথা বলতে দেয়নি । এইটুকুই শেষ কথা। প্রিজন ভ্যানে তাকে নেয়ার পর জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বিমর্ষ চেহারা নিয়ে। হতবাক! এই যেন বলার কোনো ভাষা নেই। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চিত্র! যে রাষ্ট্রে সাংবাদিকতা মানে বাতাবি লেবুর ফলন।
প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলাম বাতাবি লেবুর ফলন নিয়ে রিপোর্ট করতেন না। এতেই ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তিনি। শত্রু হয়ে অসংখ্য। তার ফল গতকালকের এই ঘটনা। রোজিনা আপাকে চিনি দীর্ঘদিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম তখন সবার আগেই চলে আসতো প্রথম আলোর নাম। এর আগে কলেজ জীবনে পত্রিকা পড়ে যাদের প্রতিবেদন ভালো লাগতো তাদেরকে আমি ফেসবুকে বন্ধুর অনুরোধ পাঠাতাম। এর মধ্যে রোজিনা আপাও ছিলো। সচিবদের মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ ব্যবহার করে পদোন্নতি, বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনের মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টের স্বর্ণে ১২ আনাই মিছে! এমন তোলপাড় করা অনেক প্রতিবেদন রয়েছে তার।
সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নিয়ে ‘এখন এক কোটি দিবো, পরে আরও পাবেন’ শিরোনামে একটি আলোচিত প্রতিবেদন করেন। এমন অসংখ্যা প্রতিবেদন আছে তাঁর, যেগুলো রীতিমতো দুর্নীতিবাজদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে তাঁর।
বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হয় না বললেই চলে, সেই জায়গায় রোজিনা ইসলাম দুর্নীতিবাজদের জন্য আতঙ্কের এক নাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছরেও দুর্নীতি থেকে মুক্তি পায়নি। গরিব মানুষদের শোষণ করে যুগের পর একটি দেশ দাড়িয়ে আছে। যে সরকারই আসুক না কেন, চিত্র এক থাকে। শুধু খেলোয়াড় বদলে যায়। মাঠ আর বল ঠিক থাকে। আর এসব নিয়ে কথা বললেই নির্যাতন, অত্যাচার। সভা সেমিনারে সবসময় সরকার দলীয় লোকজন ও আমলারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বুলি আওড়িয়ে বেড়ায়, অথচ নিজের মন্ত্রণালয়ে স্বজনপ্রীতি বা দলীয় লোকজন ঘিরে রাখে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে যখন এসব কথা বলতে যাবেন, তখন আপনাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা সরকার বিরোধী প্রমাণ করার জন্য ওঠেপরে লাগে। শুধু তাই নয়,এই সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকাতে হবেই। আপনি যদি উত্তর পাড়ার রহিমকে নিয়ে স্ট্যাটাস দেন বা কিছু লিখেন, আর সেক্ষেত্রে তেতুলিয়ার কুদ্দস মিয়ার অনুভূতিতে যদি আঘাত লাগে তাহলে আপনার নিস্তার নেই। সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে গেলে, শুধু মাত্র মহামারির সময়েই ৮০ জন গণমাধ্যমকর্মীকে এই আইনে মামলা দেয়া হয়েছে। এই আইন শুধুমাত্র দুর্নীতিবাজদের পিঠ বাঁচানোর জন্য। বাক স্বাধীনতার বারোটার বাজানোর জন্য।
স্বাস্থ্যখাতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রতিবেদন করেছেন প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলাম। তাঁর এসব্ প্রতিবেদন মানুষের মধ্যে আলোচিত হয়েছে। দুর্নীতির অনেক চিত্র সামনে এসেছে। গত একমাসে তিনি এই মন্ত্রণালয় নিয়ে চার চারটি প্রতিবেদন করেছেন, যেগুলো আলোড়ন তৈরি করেছে। এসব নিয়ে মন্ত্রণালয়ের লোকজন তার উপর ক্ষোভ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি নিজেও যখন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছি, নানান জায়গায় থেকে হুমকি ধমকি এসেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী নজরদারিতে রেখেছিলেন। এই নিয়ে থানায় জিডিও করেছি। কিন্তু সচিবালয়ের মতো একটি জায়গায় রোজিনার আপার মতো একজন রিপোর্টারকে এভাবে হেনস্থা, সেটা সম্ভবতো বাংলাদেশে বলেই সম্ভব।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, তিনি নথি চুরি করেছেন। নথির ছবি তুলেছেন। যার কারণে তাকে পাঁচ ঘণ্টা আটকিয়ে রেখে হেনস্তা করেছেন। আর এই পুরো পক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলো তিন চারজন আমলা। একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরে রেখেছে একজন অতিরিক্ত সচিব! কি ভংঙ্কর! এসব করতে শুনেছি পাড়ার মাস্তানদের মতো লাকজন। কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষ, রাষ্ট্রের একজন আমলার কাছে এটা পুরোটায় কল্পনাতীত মনে হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন মাস্তানদের বসবাস।
নথি চুরি! কি এমন নথি চুরি করেছেন রোজিনা ইসলাম? এই প্রশ্নের জবাব নেই কারো কাছে। বাংলাদেশ কি কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে? যুদ্ধ জাহাজ কিনছে? অস্ত্রবারুদ কিনেছে? বাংলাদেশ থেকে কিডনি রপ্তানি করা হচ্ছে? কি এমন নথি?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে চুক্তি সংক্রান্ত নথি! কিন্তু এসব চুক্তির খবর তো তারাই গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে ডেকে নিয়ে দেন। সংবাদ সম্মেলন করে জানান। তাহলে এই চুক্তি নিয়ে কেন এতো গোপনীয়তা? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি প্রদক্ষেপের সঙ্গে সারাদেশের মানুষ জড়িত। যেখানে জনমানুষ জড়িত সেখানে গোপনীয়তা কিসের? সেটা কিন্তু কেউ খোলাসা করে বলেননি। মানুষ জানতে চায় কি এমন নথি, যা প্রকাশ পেলে রাষ্ট্র রসাতলে যাবে।
সেই নথি চুরির অপরাধে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে রোজিনা ইসলামকে পুলিশের কাছে দিয়েছেন আমলারা! প্রশ্ন হচ্ছে,যদি পুলিশের কাছেই দিতে হয়, তাহলে পাঁচ ঘণ্টা তাকে আটকিয়ে রাখা হলো কেন? শুধু মাত্র নিজেদের ক্ষোভ মেটানোর জন্য? তাঁর গায়ে হাত তুলা হলো কেন? তিনজন আমলা যেটা করেছেন, সেটা কি আইনসিদ্ধ? যদি আইনে জায়েজ না হয়ে থাকে তাহলে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকিয়ে রেখে নির্যাতন করা হলো কেন? এবং নির্যাতনকারীদের কি বিচারের আওয়াতায় আনা হবে?
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ভয়াবহ অবস্থা, এটা সবারই জানা। কোনো কিছু লেখা যায় না, প্রকাশ করা যায় না। পদে পদে সেন্সর! তারপরও সরকারদলীয় লোকজন বলে বেড়ান, তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কতটা বিশ্বাসী সেটা সবারই জানা। রোজিনা আপার মতো একজন সাংবাদিকের টুটি চেপে ধরে, জেলে পাঠিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তারা কতটা বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন।
এই দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা অহরহর ঘটে থাকে। কেউ কেউ বলেন রোজিনা ইসলামের এই ঘটনা দিয়ে পুরো সাংবাদিক কমিউনিটিকে এক ধরনের ভয়াবহ বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু এই বার্তা তো গত একযুগেরও বেশী সময় ধরে পেয়ে আসছে সাংবাদিকরা। তাহলে নতুন করে কেন এই বার্তা দিতে হবে? এই প্রশ্নের সোজা উত্তর, মনে করিয়ে দেয়া। বার বার মনে করিয়ে দিলেই গণমাধ্যমকর্মীদেও মাথায় ঘুরপাক খাবে, এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন থেকে মনের অজান্তেই দূরে থাকবেন তাঁরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের একজন উপসচিব, যে মামলা দিয়েছেন,সেটি হচ্ছে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশরা এই অফিশিয়াল সিক্রেসি এক্ট তৈরি করেছিলো নিজেদের দুর্নীতি আর অপকর্ম হালাল করার জন্য। এক’শ বছর পরেও এই আইন বলবদ আছে। প্রথমে বলেছি, এই রাষ্ট্রে শুধু খেলোয়াড় বদলায়। মাঠ আর বল ঠিক থাকে। একটি বিষয় খেয়াল করুন কি হাস্যকর! এই রাষ্ট্রের বড় চোরদের যদি তালিকা করা হয়, এর মধ্যে আমলা মন্ত্রীদের নাম চলে আসে। আর ওরাই যখন একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে অপবাদ দেয়, চোর বলে! তখন মনের অজান্তেই অট্টহাসি আসে। শুধু মহামারির এই সময়টা খেয়াল করলে দেখা যাবে, স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে কত রিপোর্ট হয়েছে! কিন্তু সাধারণ জনগণ হিসেবে কেউ এর কোনো বিচার দেখেছে? সাধারণ জনগণের টাকা হরিলুট করছে অথচ এই দেশে এর কোনো বিচার নেই। অথচ একজন রোজিনা ইসলামকে জেলে যেতে হয়!
আমার ছোট্ট সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতায় বলে, এখন আর বিভিন্ন দপ্তর থেকে সাংবাদিকদের নথি চুরি করতে হয় না। নিজেদের লোকজনই সাংবাদিকদের কাছে এসব সরবরাহ করেন। আর এসব তখনই করেন, যখন নিজেদের ভাগ না মিলে না। অনেকসময় সৎ আমলারাও রয়েছে। তারাও চায় দুর্নীতি বন্ধ করতে। ফলে বিশস্ত গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তারা নথি সরবরাহ করেন। কিন্তু রোজিনা ইসলামের সঙ্গে গতকালের ঘটনাটি যদি আপনি একটু ভালো করে খেয়াল করেন, তখন বুঝতে পারবেন পুরো বিষয়টি পরিকল্পিত। যদি বিষয়টি পরিকল্পিত না হতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ডাকতেন। এতো সময় নিতেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন না।
এই ঘটনায় আমলাদের পাশাপাশি কোনো অংশে কম যান না পুলিশও। উপসচিব ডা. শিব্বির আহম্মেদ ওসমানী মামলাটি দায়েরের পর (যদিও মামলায় তার স্বাক্ষরটি নিয়ে যতেষ্ট সন্দেহ রয়েছে) পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়েছে। একটু ভাবতে পারেন আপনি? রোজিনা ইসলাম কি শীর্ষ সন্ত্রাসী কেউ? যে তাকে রিমান্ডে নিয়ে তার কাছ আরো তথ্য পাওয়া যাবে? হাউ ফানি!
রোজিনা ইসলাম যদি নথি চুরি করেও থাকে, সেটা অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে কোনো অন্যায় নয়। সারা বিশ্বে যত বড় বড় অনুসন্ধান হয়েছে, সব নথি চুরি করেই হয়েছে। বড় বড় চোরদেরও ভাষায় এটি চুরি। কিন্তু সাংবাদিকতার ভাষায় এটা নৈতিক দায়িত্ব। সাংবাদিকতার ইতিহাসে এমন অসংখ্য ঘটনা ফাঁস হয়েছে বা চাঞ্চল তৈরি হয়েছে, যেগুলো করতে গিয়ে এমন উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে । যা আইন সমর্থন করে না। কিন্তু যখন ঘটনা সবার সামনে চলে এসেছে, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। যে চুরি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, সেই চুরি করতে আমি রাজি। রোজিনা ইসলামের মতো আমাকে গ্রেফতার করা হোক।