লেখক: মো. মাজেদুল হক, অর্থনীতি বিশ্লেষক।
অর্থমন্ত্রী যেদিন সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেন সেদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২ হাজার ৭২৪ জন মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮ লাখের বেশি। করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর এটা ছিল দ্বিতীয় বাজেট যার আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬ শত ৮১ কোটি টাকা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ।
উল্লেখ্য, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনার কারণে তা কমে ৫.২ শতাংশে দাঁড়ায়। আমাদের জন্য সুখবর যে, দেশে মাথাপিছু আয় বর্তমানে ২ হাজার ২২৭ ইউএস ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে দারিদ্র্যের হারও কমে অর্ধেক হয়েছে। এ হার আরও কমে যাবে। কারণ এবারের বাজেট কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এরই মধ্যে ১০ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ৩৭টির কাজ শেষ হলে আরও ৮ লাখ মানুষ কাজ করার সুযোগ পাবে। যা করোনা বিধ্বস্ত অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।
এছাড়াও সরকার গ্রামীণ অর্থনীতিতে ই-কমার্স বিষয়ক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ই-কমার্সকে সম্প্রসারিত করার জন্য সরকার ৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিবে। তবে আমার দিক থেকে পরামর্শ যে শুধু প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, তাদেরকে ব্যবসা শুরু করার জন্য আর্থিকভাবে সহযোগীতা করতে হবে। তাহলে এ কর্মসূচির সফলতা আসবে। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় তাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে।
এছাড়াও প্রতিবছর পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া ৪ লাখের বেশি নতুন গ্রাজুয়েটদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশ পাঠাতে পারলে একদিকে রেমিট্যান্স বাড়বে সেই সাথে বেকারত্বের হারও হ্রাস পাবে। এবার প্রস্তাবিত বাজেটে তরুণদের জন্য অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে যা অত্যন্ত ইতিবাচক। যেমন বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তি সেবায় তরুণ উদ্যোক্তাদের কর ছাড় দিয়েছে সরকার। এমনকি ল্যাপটপ আমদানিতে শুল্ক বাড়েনি। তবে বিদেশি ফিচার ফোনের আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। অন্তত করোনার সময় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি।
বাংলাদেশে এখন মোট মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগের কাছাকাছি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে। করোনাভাইরাসের কারণে সরকার যে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ কর্মসূচি চালু করলো সেটা সম্পূর্ণ স্মার্ট ফোন নির্ভরশীল। এ কর্মসূচি অনলাইন ভিত্তিক যার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট ফোন এবং সাথে ইন্টারনেট সুবিধা। সরকার ইতিমধ্যে স্মার্ট ফোন কিনতে ৪১ হাজার ৫০১ জনকে ঋণ দিয়েছে। যে ৪ কোটি শিক্ষার্থীকে এ কর্মসূচির আওতায় পাঠদান করা হবে তাদের বেশি টাকা ব্যয় করে স্মার্ট ফোন কেনার সক্ষমতা নাও থাকতে পারে। ঋণের ব্যবস্থা না করে স্মার্ট ফোনের দাম কমানো যৌক্তিক মনে করি। অনেকে ঋণের সদ্ব্যবহার নাও করতে পারে। করোনা মহামারির ভেতর মানুষের আয় হ্রাস পাওয়ায় ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর হার কমানো হয়েছে যা বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের জন্য সহায়ক হবে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভারের ওপর কর মওকুফ করা হয়েছে। এতে করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে সেই সাথে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে বাজেটে যে ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা কমানো হয়েছে এটা আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়নি। আমরা সবাই জানি যে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের কাছাকাছি বহু বছর ধরে ঘুরাঘুরি করছে।
এছাড়াও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কখনো পূরণ হয়নি। আবার করোনাভাইরাস শুরু থেকে রাজস্ব আয় কমে গেছে। এ দেশে ১৬ কোটির বেশি জনগণের মধ্যে টিআইএন এর আওতাভ’ক্ত ২৫ লাখের বেশি মানুষ কর প্রদান করে না। এছাড়া কর ফাঁকি দেওয়া সম্পদশালীদের মধ্যে একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। আমি বলবো ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা আগের চেয়ে আরও বাড়ানো উচিত। কয়েক বছরের মধ্যে কর-জিডিপি হার ১৫ শতাংশের কাছাকাছি না গেলে ঋণ-জিডিপি হার বাড়তে থাকবে। এতে করে অর্থনীতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। করের জাল বিস্তৃত করার লক্ষ্যে গ্রাম বাড়ির নকশা অনুমোদনের জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভালো উদ্যোগ। তবে প্রবাসীদের জন্য করারোপ শিথিল করা যেতে পারে। তারা বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও ঘরে বসে রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। বিগত আট বছরে করজাল ৪৫৫ শতাংশ বেড়েছে । আমার মতে আগামী অর্থবছরে করজাল বাড়ার হার আরও বেড়ে যাবে। এখন থেকে ৩ লাখ টাকার বেশি আয় করলে কর দিতে হবে। সাধারণত এ আয়ের ভেতর কর দিয়ে থাকেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। করোনার মধ্যে যারা রাতারাতি কাজ হারিয়েছেন তারা সবাই নিম্ন আয়ের লোক। তাদের কথা চিন্তা করে করারোপ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
রেমিট্যান্স বেড়ে এখন ২৪ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আয়ের মাধ্যমে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণে তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দিয়ে আসছে। ২০২১-২২ প্রস্তাবিত বাজেটে ২ শতাংশ রাখা হয়েছে। এটাকে বাড়িয়ে ৩ অথবা ৪ শতাংশ করলে বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাবে।
অতি ধনীদের ওপর সারচার্জ বাড়ানো সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিগত কয়েক বছর ধরে বংলাদেশে আয়-বৈষম্য বেড়ে চলেছে। করোনা প্রকোপের কারণে বৈষম্য আরও বেড়ে গেছে। আয় বৈষম্যের মাপকাঠি গিনি সহগের মান লকডাউনের আগে ছিল ০.৪৮২ যা লকডাউনের পরে ( ৩১ মে ২০২০) নাগাদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৬৩৫। এছাড়াও ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধনকুবেরের (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪.৩ শতাংশ হার। চীনে এ হার আরও কম।
সম্প্রতি ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করনো সংক্রমণের হার বেড়ে চলেছ। আগে শুধু বিভাগীয় শহরের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এটাকে সামাল না দিতে পারলে অর্থনীতির জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে গ্রামে হাসপাতাল খুললে কর ছাড়। এ উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার যে চিকিৎসা গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল তা খরচ হয়নি। তারপর আবারও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণায় স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। উন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসা গবেষণায় বছরে বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের বরাদ্দকৃত টাকা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ানো হয়েছে । যতটুকু বাড়ানো হয়েছে তা যথেষ্ঠ নয়। কারণ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, নতুন করে গরিব হওয়া ১৬.৩৮ মিলিয়ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে আর্থিক সহযোগীতার মাধ্যমে। যদিও ৩৫ লাখ মানুষকে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় ১৪ লাখের কাছাকাছি মানুষকে অর্ন্তভ’ক্ত করা হচ্ছে। এবার আরও ১২০ উপজেলায় ৮ লাখ বয়স্ক নাগরিককে ভাতার আওতায় আনতে চায় সরকার। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ভাতা বাবদ অতিরিক্ত ৪৮১ কোটি টাকার পরিবর্তে ৫০০ কোটি টাকা করা গেলে ভালো হতো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারির ১৬ মাসে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩৫ লাখ থেকে সাড়ে ছয় কোটির বেশিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ কি পর্যাপ্ত? বিদেশি মাংস, বিদেশি বিস্কুট আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট এবং সস্পূরক শুল্ক বাড়ানো যৌক্তিক ।
এছাড়াও ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্রান্ডকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এবং উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য যে ‘কর অবকাশ’ ঘোষণা করা হয়েছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। দেশীয় শিল্প বিকাশের মাধ্যমে একদিকে যেমন রফতানি আয় বাড়বে অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য বিদেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর বিকল্প নেই। অদক্ষ শ্রমিক মুজুরি কম পায়।
আইওএম এর তথ্যমতে, একজন বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক প্রতিমাসে রেমিট্যান্স পাঠায় গড়ে ২০৩ দশমিক ৩৩ ডলার। যেখানে চীন দেশের নাগরিক পাঠায় ৫৩২ দশমিক ৭১ ডলার। প্রস্তাবিত বাজেটে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশে এক সময় শঙ্খ শিল্পের অনেক বড় বাজার ছিল। এ বাজার এখন সংকোচিত হওয়ার পথে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য খাতকে তেমন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। মাথাপিছু করোনা ভ্যাকসিনের ব্যয় অনেক। কম সময়ের মধ্যে সবাইকে টিকা দিতে হলে এ খাতে আরও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মানুষ বাঁচাতে না পারলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা যাবে না।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া জিডিপির অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে বাংলাদেশ সবার চেয়ে পিছিয়ে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জীবন-জীবিকার বাজেট কল্যাণ বয়ে আনবে তখনই যখন বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ স্বচ্ছতা বজায় রেখে শত ভাগ বাস্তবায়িত হবে।
লেখক: মো. মাজেদুল হক, অর্থনীতি বিশ্লেষক।