লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd.
গ্রামের এক জ্যাঠা বড় গৃহস্থ। অনেক জমি-জমা ও পুকুর আছে তাঁর। সাথে সরিষার তেল মাড়াইয়ের ঘানিকল। তাঁর স্বচ্ছল পরিবারে দুটি ছেলে। ওরাও বেশ কর্মঠ। বাবাকে পরিবারের সব কাজে সাহায্য করে। ফলে টিপটপ গোছানো সংসার। সুখ-শান্তিতে ভরা সময় কাটে। তবে একটি নেশা ছিলো- প্রতিবছর কার্তিকের অবসরের সময় মেলার ডাক পড়লেই সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া। দূর-দূরান্তের প্রসিদ্ধ জায়গার মেলাতে তার যেতেই হবে। লক্ষ্য হলো, বড় বড় তাজা গরু কিনে এনে স্থানীয় হাটে চড়া দামে বিক্রি করে দু’পয়সা মুনাফা করা। সাধারণত: তিনি সেসব পশুর মেলায় একাই যেতেন। এজন্য নিজের জেলা পার হয়ে ভিন জেলায় যেতে আপত্তি করতেন না। তখন পথের নিরাপত্তা নিয়ে তার কোন চিন্তা ছিল না। তিনি তাঁর বাপ-দাদার নিকট থেকে পথের খাদ্য, নিরাপত্তা বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন বহু আগেই। এবছর তার ইচ্ছে, কিছুটা ট্রেনে, কিছুটা হেঁটে কিছুটা মহিষের গাড়িতে চড়ে একাই বহুদূরের জেলায় (আলোয়াখাওয়ার মেলা) গিয়ে পছন্দসই গরু কিনে আনবেন।
যেই ভাবনা সেই কাজ। বৃষ্টি–বাদলের দিন শেষ হতেই রেডিওতে মেলার বিজ্ঞাপন শুনে প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা দিলেন। পথে তিন দিন তিন রাত লেগে যাবে মেলায় যাওয়া-আসা করতে। খাবারের জন্য শুকনো চিড়া, মুড়ি, আখের গুড়, লবণ নিলেন। আর পরিধেয় বস্ত্রের জন্য দুই সেট লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, ১টি জলগামছা আর রাতে গায়ে জড়ানোর জন্য ১টি জ্যাকেট।
মেলায় পৌঁছে অনেক ঘুরলেন, অনেক জেলার তৈরি জিনিসপত্র দেখলেন, অনেক মিঠাই,–মন্ডা খেলেন। এবার বড় গরু কিনে বাড়ি ফেরার পালা। আজ সন্ধ্যায় গরু কিনে কাল ভোরবেলা হেঁটে বাড়ির পথ ধরে চলতে হবে। আজ একবার মেলার পাশের পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল করতে মন চাইলো তাঁর। দেশে এই কয় বছরে যে এত চোর-বাটপারের দল সৃষ্টি হয়েছে তা তাঁর মাথায় একবারও আসেনি। বেলা গড়াতেই পুকুর পাড়ে যেতে লাগলেন। অমনি তার পিছনে একজন লোক চেঁচিয়ে জানালো- চাচা আপনার পাঞ্জাবিতে ময়লা লেগেছে। এ তো দেখছি মানুষের মল! গন্ধ ছুটছে। যান, পুকুরে নেমে ধুয়ে ফেলুন। আমার কাছে সাবান আছে। এই নিন। তাড়াতাড়ি ধুয়ে আসুন।
সরল মনে তিনি গায়ের সব কাপড় খুলে পুকুর পাড়ে রাখলেন। কোমরের গরু কেনার টাকার পুঁটলিটা অন্যান্য কাপড় ও জ্যাকেট দিয়ে প্যাঁচিয়ে রাখলেন। পানিতে নেমে ভালো করে গোসল সেরে উপরে উঠে তার চোখ ছানা বড়া! জ্যাকেট আছে কিন্তু টাকার পুঁটলিটা নেই। ওই লোকটি বা তার সাথে থাকা অনুসরণ করা প্রতারক চক্রের লোকজন টাকার পুঁটলি নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
টাকা হারিয়ে তিনি প্রথমে হতবাক। তারপর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একা একা কাঁদলেন। পরে হাউমাউ করে লোকজনকে টাকা হারানোর কথা বলাবলি করলেন। কিন্তু কোন কাজ হলো না। এটি ছিল চোর-বাটপারদের কাজ।
এবার তাঁর আর গরু কেনা হলো না। পরদিন মনের দুঃখে একা একা বাড়ির পথ ধরলেন। এই বাস্তব ঘটনাটি শুনেছিলাম প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল একজন বড় অফিসারের বাসার সামনে কয়েক বছর আগে। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এবং ঘুষের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিম্ন আয়ের কর্মচারীরা তাদের বসের কাছে প্রতিকার না পেয়ে তার বিরুদ্ধে নোংরা-ঘৃণার কাজ করে প্রতিবাদ জনিয়েছিল। তারা তার বসের বাসার সদর গেটে, দেয়ালে মানুষের মল ছিটিয়ে রেখে নোংরা করে বসের নোংরামির প্রতিবাদ করেছিল। যেটা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল। পরে অন্য আরেকটি ঘটনায় সেই বসকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এগুলো আজকাল প্রতিবাদের ঘৃণ্য পদ্ধতি হলেও দারুণ ভাষা। যা অতিদ্রুত কোন জটিল সমস্যার সমাধানের পথ বের করে দিতে পারে।
অনেকের কাছে হয়তো আরও অনেক দারুণ ঘটনার অভিজ্ঞতার কথা জানা আছে।
এরূপ কোন কোন ঘটনা দেশবাসীকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। যেমন হঠাৎ সহিংস ঘটনা ঘটে গছে বরিশালে। পোস্টর অপসারণ করা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জের ধরে হামলা হানাহানি ঘটে গেছে। এজন্য গত ১৮ আগস্ট বিকেলে বরিশালের ইউএনও-র বাসার সামনে ট্রাকভর্তি ময়লা ফেলে প্রতিবাদ করেছে পৌরসভার কর্মচারীরা। বিষয়টি নিয়ে বড় বড় সংবাদ হয়েছে।
ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বাসভবনের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে ১৮ আগস্ট হুড়মুড় করে জনতা-রাজনৈতিক কর্মীরা ভেতরে ঢুকে গেছে। আমরা টিভিতে দেখেছি, দেখেছে সারা বিশ্ব। ইউএনও-সাহেবের নিরাপত্তা কর্মীদের সাথে সংঘর্ষের মাঝে গোলগুলির ঘটনা ঘটেছে। এজন্য ৪৫০ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলা রুজু করা হয়েছে। সহিংসতা ও সরকারি গুলির ঘটনায় শহরের রাজনীতিকরা একাত্ম হয়ে পাল্টা মামলা করেছেন। ক্রমান্বয়ে মহানগরের প্রভাবশালী নেতারা জড়িয়ে গেছেন ঘটনার সাথে। ‘মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছেন পুলিশ-প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা।’ বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সভা করে জরুরি ভিত্তিতে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে গ্রেফতারের দাবি জানায়। বলা হয়, সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইউএনও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের দ্বারা হেনস্থা হয়েছেন।
প্রাচ্যের ভেনিস নামে খ্যাত শান্ত বরিশাল এখন বড় অশান্ত। এর জনমনে শঙ্কা, বাতাস গুমোট। কারণ, পিআইবি সাম্প্রতিক ঘটনাটি তদন্ত করবে বলে জানা গেছে। যেখানে নাকি সাক্ষীও আসামির তালিকায় রয়েছে। জানা গেছে ২৩ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট দাখিলের তারিখ। অনুসন্ধান শেষে কে কার বিরুদ্ধে কী তদন্ত রিপোর্ট দিবেন সেটা দেখার বিষয়।
কেউ বলেছেন, বরিশালের ঘটনা স্থানীয় বিষয়। কিনতু তা মোটেও নয়। এটা জাতীয় সমস্যার একটি প্রতিফলন মাত্র। এখানে কারো আবেগের ব্যাপার নয় বরং- কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে নিষ্ফল প্রতিবাদের নমুনা ও পাল্টপাল্টি কর্তৃত্বের জেদ দৃশ্যমান হয়েছে। অবাধ আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ও রাজনীতির দেউলিয়াত্ব এসব ঘটনার জন্ম দেয়। সাধারণত: কোন দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দুর্বল হলে যা হয়, তাই ঘটেছে বরিশালে।
এমন অবস্থা পর্যবেক্ষণের ইঙ্গিতে সংবাদে প্রকাশ, ‘..বিপজ্জনক প্রবণতা স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান আওয়ামী লীগের মধ্যে দেখা দিয়েছে। দলের সাংগঠনিক শক্তি নেই। মন্ত্রীদের চাইতে তাদের সচিবদের ক্ষমতা বেশি।’ (আজকের পত্রিকা ২২.০৮.২০২১)। এর প্রধান কারণ, সংসদে শক্তিশালী বিরোধীদলের অভাব।
এখন আর নির্লোভ, ঝানু, ত্যাগী ব্যক্তিরা রাজনীতি করা পছন্দ করেন না। তাই রাজনীতিকদের ধৈর্য্য ও দূরদর্শিতা বিলীন হয়ে গেছে। বরিশালের ঘটনা অনেক দূর গড়িয়ে রাজনৈতিক তোলপাড়ের পর এখন আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা চলছে। বিষয়টি এখন বিচারাধীন। তাই সে বিষয়ে আর কিছু লিখতে চাই না।
শুধু বলতে চাই, মেলায় গরু কেনার জন্য জ্যাঠার টাকার পুঁটলি চুরি করা প্রতারকদের মত ময়লা পার্টির রাজনীতি কি ভদ্রলোকের টেবিলে ঢুকে পড়লো? ঘটনার কয়েকদিন পরও রাস্তা থেকে ময়লা সরানো হয়নি। এমনিতেই করোনা, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া ইত্যাদির আক্রমণে নাকাল মানুষ নাকে-মুখে পর্দা লাগিয়ে চলাচল করতে গিয়ে ফাঁপড় খাচ্ছে। তার ওপর ময়লার গন্ধ যেন- মড়ার ওপর খাড়ার ঘা।
আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরে মলম পার্টি, মরিচের গুঁড়ো পার্টি, মল পার্টি, আলকাতরা পার্টি, পোড়া মবিল পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, কোকা-কোলা পার্টি, শরবৎ পার্টি, লাগেজ টানা পার্টি, ব্যাগ কাটা পার্টি-আরও কত অজানা প্রতারক পার্টির ঘৃণিত কর্মকাণ্ড চলছে। এগুলো নির্মূল করা যায় না, নির্মূল হয় না। কারণ, এদের সাথে রেজিস্টার্ড ভাগবাটোয়ারা পার্টির যোগসাজশ থাকে। যারা ওদের কাছে নিয়মিত মাসোহারা পায়। এদের নেতা ও গ্যাং লিডার থাকে। আরও থাকে মাফিয়া নামক বড়ভাই। এসব বড়ভাইদের অনেকেই টাকার জোরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত মুখ। যারা ১ মিনিটেই যে কোন অপরাধীকে ছাড়িয়ে আনতে পারে। যারা নিমিষেই যে কাউকে বদলি করাতে পারে বা চাকরি খেয়ে দিতে পারে। এই দুষ্ট চক্রের হাতে বইয়ে লেখা থাকা নীতিবাক্যের কথা বলা হাস্যকর। এদের খোলসে যখন সরকারি কাজকর্মের ফিরিস্তি চলে তখন সাধারণ মানুষের অধিকার, হক ইত্যাদি কি শুধু কথার ফানুস নয়?
বরিশালের মত অভাবনীয় ঘটনা দেশের নানা জায়গায় প্রায়শঃই ঘটে থাকে। এসকল বিষয় লাভ-লোকসান ও মর্যাদার সাথে জড়িত থাকায় বহুলাংশেই রাজনীতিকদের দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রশাসনের লোকজন নাক গলাতে যান না। সেজন্য দেশের উন্নয়নে বহুলাংশে ‘যে লাউ, সেই কদু’-ই জনগণ দেখতে পায়। কিন্তু এবারের ঘটনায় একজন প্রতিমন্ত্রী ও মেয়রের দ্বন্দ্বের মধ্যে জড়িয়ে গেছে প্রশাসন (আজকের পত্রিকা ২৩.০৮.২০২১)। এসব আধিপত্য বিস্তারে স্থানীয় পেশী শক্তিকে সহায়তা করা আজকাল জাতীয় ইস্যু মনে করা হয়। হয়তো করো প্রচ্ছন্ন নৈতিকতায় এর ব্যত্যয়ে ঘটনা ভিন্নদিকে মোড় নিয়ে ফেলেছে।
একটি দৈনিক লিখেছে- রাজনৈতিক খোলস-নলচে থেকে বের হতে চায় প্রশাসন। খুব ভাল কথা। এটাই তো দরকার। এটা শুরু করতে গেলে বে-আইনি কাজের খবরদারিদের খবর শুরু হয়ে যাবে। তখন ক্রোধের বশে কেউ কেউ বাসার সামনে ময়লার ট্রাক ডাম্পিং বা আরও নোংরামি কিছু করতে কুন্ঠিত হবে না। তবে মনে রাখতে হবে অপরাধী ও অত্যাচারীরা চিরকালই ভীরু। নিজের নোংরারি বুঝতে পারলে তারা একদিন সুযোগ বুঝে পিছুটান দিতে বাধ্য হবে। এজন্য সমাজের ভাল মানুষগুলোর মাধ্যমে শক্তিশালী নৈতিক কমিটমেন্ট প্রদর্শন করা প্রয়োজন। তা না হলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স কখনো কার্যকরী হবে কি?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd.