গুরনাহর নোবেল জয়: আনন্দের বন্যা বইছে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে

, যুক্তিতর্ক

সাঈদ চৌধুরী | 2023-08-31 00:34:33

আনন্দের বন্যা বইছে বৃটেনের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকার সাবেক ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক প্রফেসর আবদুলরাজাক গুরনাহ সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেছেন। ৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি তাঁর নোবেল জয়ের ঘোষণা দেয়।

The Nobel Committee awarded this year’s Prize to Professor Gurnah for ‘his uncompromising and compassionate penetration of the effects of colonialism and the fate of the refugee in the gulf between cultures and continents.'

এই খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সহ সর্বস্তরের মানুষ আনন্দিত, উল্লসিত। বিভিন্ন মিডিয়ায় তারা নিষ্কলুষ আনন্দ ও চিত্তাকর্ষক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। সেই সাথে প্রকাশ পাচ্ছে বিলেতে অভিবাসী (ডায়োসপরা) মানুষের প্রাণশক্তির বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তি।

কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঘোষণা করা হয়েছে, আমরা আনন্দিত যে আমাদের প্রাক্তন ছাত্র এবং ইমেরিটাস প্রফেসর আবদুলরাজাক গুরনাহ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ২০২১ পেয়েছেন। ঔপনিবেশিকতার অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আবদুলরাজাক গুরনাহর আপসহীন সংগ্রাম এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশীয় পরিসরে উদ্বাস্তু মানুষের কণ্ঠস্বরকে সাহসের সাথে তুলে ধরার জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেয়া হলো। তাঁর অনেকগুলি গল্প আমাদের নিজস্ব লাইব্রেরিতে প্রথম খসড়া হয়েছিল। এটি বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্পর্শ করেছে।

আবদুলরাজাক গুরনাহ একজন তাঞ্জানীয় ঔপন্যাসিক, যিনি বৃটেনে বসবাস করেন। তার মাতৃভাষা সোয়াহিলি, কিন্তু তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখে থাকেন। বুকার এবং কমনওয়েলথ রাইটার পুরস্কারের মনোয়ন তালিকায়ও ছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের ৮৫ বছর পর প্রথম আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পুরস্কারটি পান ওল সোয়েঙ্কা। এরপর তিনি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন।

আবদুলরাজাক গুরনাহ কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে পিএইচডি করেছেন। তাঁর অভিসন্দর্ভ ছিল ‘ক্রাইটেরিয়া ইন দ্য ক্রিটিসিজম অব ওয়েস্ট আফ্রিকান ফিকশন’। এখানেই দীর্ঘদিন তিনি (professor of English and postcolonial literatures) ইংরেজি ও পোস্ট কলোনিয়াল লিটরেচার্স বিভাগে অধ্যাপনা করেন। সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন।

আবদুলরাজাকের জন্ম ১৯৪৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবারে, বর্তমান তাঞ্জানীয়া। ১৯৬৩ সালে বৃটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে দেশটি মুক্ত হয়। কিন্তু আরব-বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও গণহত্যা শুরু হলে বহু মানুষ দেশ ত্যাগ করেন।

প্রফেসর গুরনাহ দশটি উপন্যাস আর একটি মাত্র ছোটগল্পের বই লিখেই নোবেল জয় করেছেন। প্রকাশনার সময় কালের দিক থেকে তার গ্রন্থ সমূহ হচ্ছে ১৯৮৭: মেমোরি অব ডেপারচার, ১৯৮৮ পিলিগ্রিম’স ওয়ে, ১৯৯০: ডটি, ১৯৯৪: প্যারাডাইজ, ১৯৯৬: অ্যাডয়ামারিং সাইলেন্স, ২০০১: বাই দ্য সী, ২০০৫: ডেজার্সন, ২০০৬: মাই মাদার লিভড অন দ্য ফার্ম ইন আফ্রিকা (ছোটগল্প), ২০১১: দ্য লাস্ট গিফট, ২০১৭ : গ্র্যাভল হার্ট, ২০২০ : আফটার লাইভস।

ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের ইন্টারন্যাশনাল পার্টনারশিপস অফিসার ক্যাথরিন থম্পসন (Kathryn Thompson, International Partnerships Officer, University of Kent) বলেন, আমি ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী এবং আমেরিকান সাহিত্যে অধ্যয়ন করেছি। আমার চূড়ান্ত বছরে, প্রফেসর গুরনাহর নির্দেশনায়, আমি উত্তর উপনিবেশিক বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র সম্পন্ন করেছি। ভ্রমণ, পরিচয় এবং স্থানচ্যুতির বিষয়গুলি অনুসন্ধান করেছি। একজন শিক্ষক হিসেবে গুরনাহ দয়ালু, ধৈর্যশীল এবং উত্সাহী ছিলেন। তখন উত্তর উপনিবেশিক সাহিত্যের প্রতি আমার আবেগকে প্রজ্বলিত করেছেন। প্রফেসর গুরনাহর সহায়তায় এই বছরের মধ্যে আমি একজন সমালোচক লেখক এবং চিন্তাবিদ হিসেবে আরও বিকশিত হয়েছি এবং একটি ডিস্টিংশন পেয়েছি। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকের কাছে শেখার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করি।

আধুনিক সাহিত্যের শিক্ষক প্রফেসর ডেভিড হার্ড (David Herd - Professor of Modern Literature) বলেন, আবদুলরাজাক গুরনাহ উপনিবেশিকতার নৃশংসতা সম্পর্কে শক্তিশালী কলম সৈনিক।

বিশ্ববিদ্যালয়েল ইংরেজি বিভাগের প্রধান ড. বশির আবু-মান্নেহ (Dr Bashir Abu-Manneh) বলেন, আবদুলরাজাক গুরনাহর লেখা আমাদের স্থানচ্যুতি, সহিংসতা এবং সমসাময়িক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে। ন্যায়বিচারের জন্য তিনি একটি অনন্য কণ্ঠ।

ফিওনা জোন্স (Fiona Jones, Eliot, 2000: English & American Literature and Philosophy) ভীষন আনন্দিত। তার মতে, আবদুলরাজাক গুরনাহ একজন দুর্দান্ত প্রভাষক ছিলেন। তিনি সবসময় আমাদের চ্যালেঞ্জ করতেন এবং সর্বদা অনুপ্রেরণামূলক ছিলেন। এই পুরস্কারটি তাঁর প্রাপ্য। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমি এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তাকে আমাদের বিশাল অভিনন্দন জানাতে চাই। তিনি আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা - একজন শিক্ষক হিসেবে, কেন্টের প্রাক্তন ছাত্র এবং উত্তর উপনিবেশিক সাহিত্যে এমন শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে।

উপাচার্য অধ্যাপক কারেন কক্স (Professor Karen Cox, Vice-Chancellor) বলেন, আমি এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য আবদুলরাজাককে আমাদের গভীর অভিনন্দন জানাতে চাই। তিনি আমাদের সকলের জন্য অনন্য অনুপ্রেরণা।

আবদুলরাজাক গুরনাহ রয়েল সোসাইটি অফ লিটারেচারের ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। কর্মকালে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার পর আমি অনুপ্রাণিত, খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করলাম। আমি এখনও তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ মুখরতায় দেখা দিয়েছে অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য । সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি ও অভিবাসীদের নিয়ে গর্ব করার এবং স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি প্রকাশের উল্লাসে মেতে ওঠেছে সকলে, নিত্য নব উৎসব রচনায়।

প্রসঙ্গত, ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে আলফ্রেড নোবেলের উইলের মাধ্যমে এ পুরস্কারের প্রবর্তন হয়। তার রেখে যাওয়া তিন কোটি সুইডিশ ক্রোনার দিয়েই শুরু হয় পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া। পরবর্তীকালে ১৯৬৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি। তবে পুরস্কার ঘোষণার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা একটি স্বর্ণপদক এবং এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার (১ কোটি ১৪ লাখ ডলার) অর্থ পেয়ে থাকেন।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর