দৈনিক তেত্রিশ লাখের অধিক করোনা সংক্রমণে ভাবনার অন্ত নেই মানুষের। ওমিক্রন সংক্রমণে বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দী হয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব। ডেল্টা ও ওমিক্রন একসঙ্গে ডেলমিক্রন নামক জমজ করোনা ভ্যারিয়েন্টের থাবায় নতুন করে ভীতি ছড়াচ্ছে মৃত্যুর। যদিও করোনার ডেল্টা আক্রান্ত বিশ্বের আতঙ্কগ্রস্থ দুর্বল মানষেগুলোর ক্ষত এখনও শুকায়নি, স্বজন হারানো পরিবারগুলোর শোক এখন কাটেনি। এরই মাঝে অতি শক্তিশালী বেশি স্পাইক সমৃদ্ধ ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব সবাইকে অজানা উদ্বিগ্নতায় আড়ষ্ট করে তুলেছে।
জানুয়ারি ১৪ পর্যন্ত বিশ্বের ১০০-র বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ওমিক্রন । দক্ষিণ আফ্রিকায় উৎপত্তি হওয়া ওমিক্রন ইউরোপ হয়ে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে প্রতিবেশি ভারতে ঢুকে পড়েছে। ইতিমধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। পশ্চিমবঙ্গে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশে শীতের শুরুতে আবারও বাড়তে থাকে সংক্রমণ। ১৪ জানুয়ারি আক্রান্ত হয় ৪ হাজার ২৪২ জন। শনাক্তের হার বেড়ে হয়েছে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ ।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেলমিক্রন করোনাভাইরাসের আলফা, বিটা কিংবা অন্য ধরনগুলোর মতো একেবারে নতুন কোনো ধরন নয়। মূলত করোনাভাইরাসের বিদ্যমান দুটি ধরন ডেল্টা ও ওমিক্রনেরই সমন্বিত রূপ এটি।
ইউরোপের বহু দেশে গত এক সপ্তাহ যাবত ওমিক্রন সংক্রমণের খবর ফলাও করে বের হতে থাকলেও আমরা তাতে কোন উদ্বিগ্ন হইনি। কারণ, এর আগে ডেল্টার ক্ষতি আমাদের দেশে বেশি ভয়ংকর হলেও মৃত্যু সংখ্যার দিক দিয়ে সরকারি পরিসংখ্যান ছিল সীমিত। করোনাভীতি, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ভয়ে গ্রাম-গঞ্জের অনেক তথ্য অজানা থেকে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এছাড়া করোনায় মৃত্যুর বেসরকারি পরিসংখ্যানের ব্যাপ্তি নিয়ে নানা গুঞ্জণ শোনা গেলেও সেটা ডকুমেন্ট আকারে প্রকাশ করতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
ওমিক্রন গত ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রথম শনাক্ত হবার খবর জানা যায়। তবে কেউ কেউ বলেন ইউরোপে অনেক আগেই ওমিক্রনের অস্তিত্ব ধরা পড়লেও তা গোপন রাখা হয়েছিল। এসব সত্য-মিথ্যার খবর যাই হোক না কেন, আসল বিষয় হলো ওমিক্রন উচ্চ মৃত্যুঝুঁকি সম্পন্ন ভ্যারিয়্যান্ট। এর সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে মারাত্মক পরিণতির সৃষ্টি হতে পারে। এটা দ্রুতগতিতে বার বার প্রোটিন পরিবর্তন করে। ডেল্টা যে সময়ে ২ বার স্পাইক পরিবর্তন করে ওমিক্রন সে সময়ে ৫০ বার পরিবর্তন করতে পারে বলে জানা গেছে। এর অভূতপূর্ব স্পাইক মিউটেশন বিজ্ঞানীদের কপালে নতুন চিন্তার বলিরেখা তৈরি করে দিয়েছে। ওমিক্রন সংক্রমণ প্রচলিত টিকার মাধ্যমে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়ায় সুরক্ষার কাজ নাও করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তাই ডব্লিউএইচও ওমিক্রনের নাম দিয়েছে- ‘ভ্যারিয়্যান্ট অব কনসার্ন’।
অক্সফোর্ডের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ পিটার হার্বিও বলেন, ওমিক্রনের অনেকগুলো বিপদচিহ্ন রয়েছে। যতটা ভাবতে পারি কিংবা আমরা যতটা পরিকল্পনা করতে পারি সেটা তার চেয়েও বদলে যাচ্ছে।
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন (ইসিডিসি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যে গতিতে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ছে, শিগগিরই ডেল্টাকে সরিয়ে এটিই বিশ্বে মূল সংক্রামক ভ্যারিয়্যান্ট হয়ে উঠবে। এই ধরন আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
ইতিমধ্যে যে ৬৪ দেশে ওমিক্রন ছড়িয়েছে তার মধ্যে বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, ঘানা, নাইজেরিয়া, ইসরাইল, ভারত, মালয়েশিয়া, হংকং, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যন্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, দাক্ষিণ কোরিয়া, নরওয়ে, স্পেন, ডেনমার্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্কটল্যান্ড, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। গত ২৯ নভেম্বর স্কটল্যান্ডে ৬ জন ও পর্তুগালে ১১ জন সংক্রমিত হয়েছে। ডিসেম্বর ০১ তারিখে পর্তুগালে চিকিৎসক আক্রান্ত হওয়ায় সেখানকার এক শিশু হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতে ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে ওমিক্রনের প্রভাবে রাজধানী দিল্লি ও মুম্বাইসহ বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যেই মুম্বাইয়ে গত একদিনেই নতুন করে দুই লক্ষাধিক মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের মাঝে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে ওমিক্রনে আক্রান্ত অনেক রোগী ভর্তি হচ্ছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই টিকা নেননি এবং ১৮ বছরের কম বয়সী। ডেল্টা ও ওমিক্রন ধরন সম্মিলিতভাবে করোনার সংক্রমণের একটি বিপদজনক সুনামি চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নতুন করে রেকর্ডসংখ্যক মানুষের করোনা শনাক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার ডব্লিউএইচওর মহাসচিব তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, ফ্রান্সে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এযাবৎকালে এক দিনে সর্বোচ্চ দুই লাখ আট হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক গড়ে রেকর্ড ২ লাখ ৬৫ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। জানুয়ারির প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক গড়ে সংক্রমণ রেকর্ড ১০ লাখ পেরিয়ে গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে চলে আসা ২০০ জন ব্যক্তির ঠিকানা খোঁজা হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইনের ভয়ে তারা লাপাত্তা। তারা এয়ারপোর্ট থেকে নিজেদের বাড়ির ঠিকানায় যাননি। মোবাইল ফোন বন্ধ করে কোথাও লুকিয়ে আছেন। এটা আমাদের দেশের জন্য ভয়ংকর খবর। ব্রাম্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও বিভিন্ন উপজেলার গ্রামাঞ্চলে তাদের অনেকের বাড়ি। সে সকল বাড়ি চিহ্নিত করে লাল পতাকা টাঙানোর মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
গতবছর সিলেটের হোটেল থেকে কোয়ারেন্টাইন ভেঙে কিছু বৃটেন ফেরত অবিবেচক মানুষ কানাইঘাটে বিয়ে করতে গিয়েছিল। তাদেরকে হোটেলের সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে চিহ্নিত করে ধরা হয়েছিল। তাদের কাছে ঘুষ নিয়ে হোটেলের বাইরে যেতে দেওয়া হয়েছিল বলে সংবাদ হয়েছিল।
এরকম অবহেলা, দুর্নীতি ও অনৈতিকতা ওমিক্রনের বেলায় করা হলে তা কাউকে ক্ষমা করবে না। কারণ এটা ডেল্টার চেয়ে অধিক শক্তিশালী। করোনার এই ঢেউ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লে তা প্রতিরোধ বা প্রতিকার করার মত সক্ষমতা আমাদের নেই। গত দু’বছরে দু’শর বেশি চিকিৎসক করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের সবাইকে এখনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। তাই তারা হয়তো ওমিক্রনের সংক্রমণ ঘটলে সামনে এগিয়ে যেতে সাহস করবেন না।
ওমিক্রনের ভয়ে ভীত হয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করেছে অনেক দেশ। আমরা এখনও উদাসীন। আমাদের দেশের মানুষ কোন কিছুকে আগে থেকে পাত্তা দেন না। বিপদে পড়লে হাউমাউ করে কাঁদতে জানেন শুধু।
ওমিক্রন কতটা মারাত্মক তা বিদেশ ফেরত যাত্রীদের পৃথক রেখে আমাদের পরিবেশে ঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য র্যাপিড অ্যাপ্রাইজাল গবেষণা করা উচিত। এজন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? আমাদের মনোভাব হলো দেখি কি হয়? তারপর যা করার তা করা হবে। এই মানসিকতা পরিহার করে অতি দ্রুত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জারি সকল বিমান ও সমুদ্র বন্দর থেকে চলাচলকারী গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরত দুইশত মানুষ দেশের কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। শুধু তাই নয়- ইউরোপ থেকে আগতদের আলাদা করতে হবে খুব দ্রুত। ডেলমিক্রন ডেল্টার চেয়ে বনেদী ঘরানার। একে দাওয়াত দিয়ে আনতে হয়। একা একা আসে না, কারো সঙ্গী হয়ে এসে প্রথমে তার শরীরে এবং তারপর পরিবারে ও গোটা সমাজে অজান্তেই ঢুকে পড়ে। এই অতিথি এবার কোনপ্রকারে ঢুকে পড়লে আমরা তাকে সামলাতে পারবো তো?
মার্কিনিরা অবহেলা করে ডেল্টায় সাত লাখ মানুষকে হারিয়ে এখনও প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। তারা দুই ডোজ টিকা দিয়েছে প্রায় সবাই। খাবার বড়ি মলনুপিরাভি আবিষ্কার করে মজুত করছে। এখন বুস্টার ডোজ দিচ্ছে। কিন্তু এরপরেও তারা ভয়ে দিন গুণছে-যদি টিকা বা মলনুপিরাভি বড়ি ওমিক্রনের ক্ষমতার কাছে মলিন হয়ে যায়! তাহলে তাদের মলনুপিরাভি বড়ি কেনার ৩২০ কোটি ডলার পানিতে মিশে যাবে।
শুধু মলনুপিরাভি বড়ি ও টিকা মজুত নয়- ওমিক্রনের ওপর গবেষণা জোরদার করতে হবে সব দেশকে। কোভিডের প্রাথমিক পর্যায়ের মত তথ্য নিয়ে লুকোচুরি না করে সঠিক পরিস্থিতি গণমাধ্যমে দ্রুত প্রকাশ করে সঠিক তথ্য বিনিময় করতে হবে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে। তা করা না হলে এর পরিবর্তিত স্পাইকের কাছে মজুত ওষুধ বিফল প্রমাণিত হলে মানবতার বিপর্যয় ঘটে গিয়ে মরণ অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া গবেষণার সাথে মানুষের চলাচল ও ওমিক্রন আক্রান্ত দেশ থেকে মানুষের বাংলাদেশে প্রবেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও মানুষ এখনো উদাসীন। তাই ওমিক্রন সম্পর্কিত নির্দেশনা না মানলে আর্থিক জরিমানা করা অতি জরুরি। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মত আমাদের দেশেও সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা উচিত। এছাড়া জীবন রক্ষায় সকলের একান্ত সতর্কতার প্রয়োজন তো আছেই। অতি দ্রুত সংক্রমণশীল ওমিক্রন ও ডেল্টার জমজ ডেলমিক্রন ঠেকানোর আর কোন ভাল গত্যন্তর আছে বলে আপাতত জানা নেই।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd