মহান ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার্থে ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ছাত্রদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের সত্তর বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছরই। গত বছর (২০২১) আমরা পালন করেছি আমাদের মহান স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। সেই সাথে ২০২০-২০২১ মেয়াদে আমরা গর্বের সাথে উদযাপন করেছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবাষির্কী। যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আপামর বাঙালি ১৯৭১ এ স্বাধীনতা অর্জন করে।
আমরা জানি, ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তি সংগ্রামের সূচনা হয়। উদুর্কে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রতিবাদে ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে প্রতিবাদ মিছিল বের করে তাতে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনী গুলি চালালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আবুল বরকতের সাথে আরও যারা নিহত হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুস সালাম, আবদুল জববার প্রমুখ। তাদেরকে শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়। তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষা সম্ভব হয়। ভাষা শহিদের স্মরণে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের জন্য একটি শোকদিবস পালনের দিনই নয়―এদিনটি আমাদের চেতনা জাগ্রত হবার দিন। স্বাধীনতার সূতিকাগারের দিন। আর এই দিনের শহিদেরা আমাদের জন্য পরম গর্বের, বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রগামী বীর সৈনিক।
বাংলাভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ভাষার মাধ্যমেই গড়ে ওঠেছে আমাদের একতা ও সংহতিবোধ। ভাষা থেকেই সৃষ্টি হয় জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। ভাষার বিভক্তির কারণেই আমরা একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭১ এ জীবনবাজি রেখে অস্ত্র হাতে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এদেশকে স্বাধীন করেছিলাম। যদিও কিছু মানুষ এ স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। ফলে বেড়েছে বিভক্তি। আর বিভক্তির সুযোগে এদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা হয়েছে ব্যাহত। বিভক্তির ফলে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে এদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে― বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য যা বিশাল কলংকের বিষয়।
১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট অকৃতজ্ঞ নর ঘাতকদের নির্মম বুলেট সপরিবারে হত্যা করে জাতির জনকসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের। এর পর থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশকে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাবার ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ছিন্নভিন্ন করার হিংস্র প্রয়াস। কিন্তু এদেশের সাধারণ জনগণ তাদের সেই হীনপ্রয়াসকে রুখে দিয়েছে। এদেশের সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে কুখ্যাত সেইসব কুচক্রীদের। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তারা।
২০০৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল ও উন্নয়নের ধারা সূচনা করেছিল। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করে ক্ষুধাা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি তিনি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। শত প্রতিকূলতা ও বর্বরোচিত জীবননাশের অপচেষ্টাকে উপেক্ষা করে এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।
একযুগের অধিক জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থেকে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছেন। ২০০৮ এ প্রণীত নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ এর ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেওয়া ‘রূপকল্প ২০২১’, ‘রূপকল্প ২০৪১’, ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’, বিভিন্ন পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা গ্রহণ করে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছেন। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ সফলভাবে অর্জিত হয়েছে। ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সুগম হয়েছে। উন্নয়নের প্রধান শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের ক্ষেত্রে গত একযুগে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেবেও বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক সূচকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিচার ব্যবস্থায়ও অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতিও অনেক।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করে। যার অনেকগুলোই আজ দৃশ্যমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পথে ধাবিত হবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এ সরকারের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্য অনেক। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বড় একটি উদাহরণ।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা ইচ্ছা করলে ক্ষমতায় এসে দেশের জন্য কোনো কাজ না করে ক্ষমতা শেষে দেশে ও দেশের বাইরে বিলাসী জীবন কাটাতে পারেন। দেশে-বিদেশে যার অসংখ্য পূর্ববর্তী উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেপথে যাননি। তিনি প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে উন্নত ও মর্যাদাশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
কিন্তু এখনও এদেশটাকে একটা গোষ্ঠী পিছিয়ে দিতে চাই। তারা দেশে-বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। এদেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে বিভক্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ, অপপ্রচার ও গলাবাজির মাধ্যমে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চাই। তাদের কাছে দেশের চেয়ে, মানুষের চেয়ে, দেশের উন্নয়নের চেয়ে ক্ষমতায় বড়। কারণ, ক্ষমতা পেলে এদেশকে আবার তারা শ্মশানে পরিণত করবে। যার প্রমাণ প্রায়ই তাদের হুংকারধর্মী বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। অতীতে তারা ক্ষমতায় থেকে এদেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ কায়েম করেছিল। উন্নয়নের মহানায়ক শেখ হাসিনাকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার চেষ্টা করেছিল। উন্নয়নের নামে বিদ্যুতের খাম্বা বসিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিল। জাতীয় ইস্যুতে তারা জাতিকে বিভক্ত করেছিল।
সুতরাং মহান ভাষা সংগ্রামের সত্তর বছর পর জাতীয় ইস্যুতে আমরা আর কোনো বিভক্তি চাই না। গত পাঁচ দশক ধরে আমরা বিভক্তির মধ্যে পড়ে অনেক পিছিয়ে গেছি। এখন আর পিছিয়ে যেতে চাই না। পেছালেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাদের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে হবে। উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়তে হবে। ভাষা সংগ্রামের সত্তর বছরে পৌঁছে উন্নয়নের স্বাদ পাওয়া কারও জন্যই যা কাম্য নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে ছিলো সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। আর স্বাধীনতার অর্ধ-শতক পরে সেই বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখন প্রায় সতেরো কোটি। ছোট্ট এই ভূখণ্ডে এত বিশাল জনসংখ্যা নিয়েও যে উন্নয়ন বিগত এক যুগে সাধিত হয়েছে―তা সত্যিই কল্পনাতীত। এটাই প্রমাণিত দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। তা সত্ত্বেও এখনো রয়ে গেছে অনেক অপূর্ণতা। অসৎ কিছু মানুষের দুষ্কর্মে ও করোনা মহামারির আঘাতে ব্যাহত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। তবে বাঙালি ঘুরে দাঁড়াবেই। দেশের উন্নতির জন্য একতাবদ্ধ হয়ে, ভাষা শহিদসহ সকল বীর শহিদের অবদানকে প্রতিনিয়ত স্মরণে রেখে আমাদের কাজ করে যেতে হবে; যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হয়, একতাবদ্ধ হয় এবং দেশের উন্নয়নে নিজেদেরকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্পণ করতে পারে। ভাষা সংগ্রামের সত্তর বছরে পৌঁছে এটাই এখন জাতির প্রত্যাশা।
ড. এ. এইচ. এম মাহবুবুর রহমান, চেয়ারম্যান, সমাজকর্ম বিভাগ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
ড. মতিউর রহমান, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী