মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের নিগ্রহের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেরিতেই এসেছে, গণমাধ্যমেও। ঘটনার দুই সপ্তাহ পর জানা যাচ্ছে, বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ক আলোচনায় তার বক্তব্যগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার স্থান হয়েছে কারাগারে। জামিন চেয়েছেন তিনি আদালতের কাছে। আদালত জামিন দেননি। আইনজীবীর বরাতে জানা যাচ্ছে, নিরাপত্তাজনিত কারণ এখন দৃশ্যমান।
শিক্ষক নিগ্রহে এখানে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তার শিক্ষার্থীদের কয়েকজন। বয়সে অনতিতরুণ। দশম শ্রেণির ছাত্র, এই হিসেবে অনুমান করছি বয়স তাদের ১৫/১৬-এর মধ্যেই হবে। এ বয়সেই তারা জড়িয়ে পড়েছে অপরাধে, নিজেদের শিক্ষককে প্রশ্নোত্তর পর্বে মুখোমুখি করে সে বক্তব্যকে গোপনে রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তারা। এলাকায় লোক জড়ো করে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, লিখিত অভিযোগ দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে। থানায় মামলা হয়েছে। মামলার আগেই পুলিশ ওই শিক্ষককে আটক করে, এবং আটকের দুইদিন পর মামলা দায়ের হলে সে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
এই ঘটনায়ও রয়েছে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ পরিচিত নিগ্রহের পদ্ধতি অনুসরণ। কথিত এই অনুভূতির আঘাতে জেরবার দেশ। এখানেও এর ব্যতিক্রম নয়। হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক। বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, স্কুলে শিক্ষক স্বল্পতায় গত ২০ মার্চ তিনি অন্য একটি বিষয়ের ক্লাস নেওয়ার সময়ে কয়েকজন ছাত্র তাকে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত কথোপকথনে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, প্রশ্নকারী শিক্ষার্থীরা বেশ প্রস্তুতি নিয়েই প্রশ্নগুলো করেছে, এবং হৃদয় মণ্ডল স্বাভাবিকভাবেই সেগুলোর উত্তর দিচ্ছিলেন, যেখানে বিজ্ঞানের প্রমাণিত বিষয়কেই তিনি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। প্রশ্নকারী শিক্ষার্থীর প্রশ্নের ধরনে তাদের দশম শ্রেণির বলে মনে হয়নি। এটা আদতে তাদের পূর্বপ্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়। তাহলে এর সঙ্গে কি অন্য কেউ জড়িত? কারা জড়িত?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত অডিও এর একটা বিষয় লক্ষণীয়-শিক্ষক যখন বিজ্ঞানকে প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান বলছিলেন তখন কয়েকজন শিক্ষার্থী বারবার ধর্মকে টেনে আনছিল। স্বাভাবিকভাবেই তিনি বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন, যখন ধর্ম ছিল না তখনও বিজ্ঞান ছিল এমন বলছিলেন। হৃদয় মণ্ডল ধর্মকে মানুষের ‘বিশ্বাস’ বলে মন্তব্য করছিলেন। তিনি ধর্ম নিয়ে বিরূপ কিছু বলেননি। তবু শিক্ষার্থীরা এটাকে ইসলাম ধর্মের অবমাননা হিসেবে প্রচার করে। প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ পেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে। কিন্তু এই নোটিশের জবাবের আগেই স্কুলে ঢুকে বহিরাগতরা মিছিল করে, পার্শ্ববর্তী বাজারেও মিছিল হয় তার শাস্তির দাবিতে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানালে পুলিশ এসে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে আটক করে নিয়ে যায়।
‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ এই ঘটনার সঙ্গে অপরাপর আরও কিছু ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা, কিছু মানুষদের মিছিল, শাস্তির দাবি, তদন্তের আগেই ভিকটিমকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া, আটকের পর মামলা দেওয়া, মামলা দায়ের পর গ্রেফতার দেখানো এবং এরপর জামিন না হওয়া। এই মিলগুলোর বাইরে নতুন ঘটনা এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষকের বিরুদ্ধে খেপিয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এই পদ্ধতি অনুসরণ করায় এবার যে ঘটনা ঘটবে তা হচ্ছে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সন্দেহের একটা পরিবেশ তৈরি হবে। শ্রেণিকক্ষে যা পড়ানো হচ্ছে সেটা কি বাইরে বেরুচ্ছে, কোন কথা কীভাবে কে উদ্ধৃত করে কী প্রক্রিয়ায় তার প্রচার চালায়-এমন একটা অসহনীয় পরিস্থিতির তৈরি হবে।
দেশের প্রত্যন্ত একটা অঞ্চলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পক্ষে যদি কোন শিক্ষককে এভাবে হেনস্তা করা যায়, তাহলে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা অন্য কোথাও কি এরচেয়েও বড় কিছু অসম্ভব? এই প্রশ্ন, এই সন্দেহ, এই ভয় কি ছড়িয়ে পড়ছে না প্রতিষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষকে-শিক্ষকে; পুরো দেশে! হৃদয় মণ্ডলের প্রতি রাষ্ট্রের এমন আচরণে হতবাক সবাই। শঙ্কায় ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন রেখে বলছেন, আমি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একজন শিক্ষক। সমাজের নানা বিষয়ে পড়াতে হয়। প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করতে শেখানো আমার কাজ। নিরঙ্কুশ সত্য নিয়ে পড়ে থাকলে আমরা সামাজিক পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে পারি না। এই জাতীয় ঘটনার পরে সরকারের তরফ থেকে যদি অন্যায়ের শিকার শিক্ষককেই গ্রেফতার করা হয়, তবে কোন ভরসায় আমি ক্লাসে যাবো? কাজেই হৃদয় মণ্ডলকে কেন গ্রেফতার করা হলো, এই প্রশ্নের পরিষ্কার জবাবটা আমার চাই। প্রশ্ন না করতে করতে তো এখানে এসে দাঁড়িয়েছি সবাই মিলে। সামাজিক কোন সূত্রকে নির্মোহভাবে আলোচনা করতে গেলে আমার দুই গালে তালে তালে জুতা মারার মিছিল হবে না, এবং সেই মিছিলের সূত্রে আমাকে রাষ্ট্র গ্রেফতার করবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? আমি কি তবে চাকরি ছেড়ে দেবো গ্রেফতার এবং জীবন বাঁচানোর স্বার্থে? সম্মানের কথা বাদই থাক। স্পষ্টভাষী ও সাহসী হওয়ায় ঢাবির এই শিক্ষক না হয় প্রশ্ন রেখেছেন, কিন্তু যারা প্রতিবাদ দূরের কথা প্রশ্ন করতেও ভয় পাচ্ছেন তারা কি নিজেদের গুঁটিয়ে নেবে না? এমন অবস্থায় কোথায় আমাদের ভবিষ্যৎ, কোথায় শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ?
গণিত বিষয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল প্রথমে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থীদের দ্বারা, এখন হচ্ছেন রাষ্ট্রের দ্বারা। শিক্ষার্থীদের সকলেই স্বাভাবিকভাবেই কিশোর বয়েসী। এই বয়েসী শিক্ষার্থীরা কেন শিক্ষক নিগ্রহের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িত হবে? তারা নিজ থেকে এত বড় অপরাধ সংঘটনে সাহস পেতো না নিশ্চিত। কারা আছে এর পেছনে- তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পুলিশ প্রশাসন ঘটনার তদন্ত করবে, এই তদন্ত যদি শিক্ষকের বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে কিশোর বয়েসীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পথ বন্ধ হবে না, বন্ধ হবে না এর পেছনের মানুষদের অপরাধের। তদন্তকে তাই সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে যাতে কিশোর বয়েসীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পথও বন্ধ হয়।
কবির য়াহমদ: লেখক, সাংবাদিক