মহামতি সম্রাট আকবর বাংলা সালের প্রচলন করেছিলেন। শুরুটা ছিল বার্ষিক কর আদায়ের নিয়ম চালু জন্য একটি হিসাব রাখার মাধ্যমে। ধীরে ধীরে এই নিয়ম বার্ষিক বাংলা পঞ্জিকায় রূপ নেয়। বকেয়া কর ও খাজনা আদায়ের জন্য পরগণার পদস্থ কর্মচারীরা পাইক-পেয়াদা নিয়ে কখন ঢেরা পিটিয়ে কর আদায় করতে আসবে তার জন্য প্রজারা তটস্থ থাকতো। দিল্লির আদেশ জারির দিন কয়েক বাদে সেটা বাঙাল মুল্লুকে পৌঁছে যেত। খাজনা দিতে দেরি হলে তখনও এখানকার গরিব চাষিদের বুক কাঁপতো, কিন্তু ধনীদের কোন চিন্তা ছিল না, এখনও নেই। কালের পরিক্রমায় এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। একটি সাহসী নির্ভীক জাতির উন্মেষ ঘটেছে, সৃষ্টি হয়েছে আপন উন্নত কৃষ্টি ও সংস্কৃতির। পহেলা বৈশাখে আজকের মত চারিদিকে জাঁকজমক রূপে রঙিন সাজ হবে, সর্বজনীন উৎসবে রূপ নেবে- সেটা হয়তো সম্রাট আকবর বা তার পারিষদের কেউ ভাবেননি।
পহেলা বৈশাখী অনুষ্ঠান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালিরা বাস করছেন সেখানেই এই উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি পহেলা বৈশাখে শুধু হালখাতা ও বৈশাখী মেলা হতো। এখন শুধু তা নয়।
এখন পহেলা বৈশাখে শুধু গণমাধ্যমে অনুষ্ঠান দেখে ও বাসায় বসে মজাদার খাবার খেয়ে কারো মন ভরে না। বর্তমানে পোশাক, খাদ্য, বাজনা-বাদ্য ইত্যাদি ছাড়িয়ে আনন্দ ও প্রাণের উচ্ছ্বাসে এক মিলনমলোয় যেন এদেশের সব ধর্মের, সব রঙের-বর্ণের বড়-ছোট সবাই ঘরের বাইরে বের হয়ে পহেলা বৈশাখ নিয়ে মেতে উঠ্ছে। এই দিনটিতে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সহপাঠী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বাইরে ঘুরতে ও কেনা খাবার খেতে পছন্দ করছে। এটা একধরনের সামাজিক পরিবর্তন। যুগের প্রয়োজনে এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তবে সতর্কতার সাথে এই সামাজিক পরিবর্তনকে ইতিবাচক ধারায় বিকশিত করতে হবে। কারণ, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের এই ধরনের ইচ্ছা ও আনন্দে যেন হঠাৎ কোন বিষাদের ছায়া না আসে সেজন্য অভিভাবকদের আগেই সতর্ক থাকতে হবে। যেমন, ক’দিন পূর্বে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অর্থনীতি বিভাগর দু’জন মেধাবী শিক্ষার্থী সবার অগোচরে হঠাৎ ভেজাল চোলাই মদ খেয়ে এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছে। যা শুধু তাদের পরিবার বা অভিভাবকদের জন্যই নয়- আমাদের জাতির জন্য চরম দুঃসংবাদ ও ভয়ংকর কিছুর ইঙ্গিত বহন করে।
এবছর বৈশাখী পণ্য ও আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে পোশাকের ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমে জানা গেছে এবারে ষোল হাজার সাতশ’ কোটি টাকার শুধু পোশাকের ব্যবসা হচ্ছে! খোদ রাজধানীতে নাকি ছয় হাজার রেস্টুরেন্টে ২৭০০ টন ইলিশ মাছের নানা পদের মুখরোচক রান্না হবে। এগুলো আমাদের অর্থনীতির গতির জন্য ভাল সংবাদ। কিন্তু অর্থনীতির এই অদ্ভুত গতি গ্রামের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কারো কল্পনাতেও আসে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, গেল সপ্তাহে সহপাঠীর কাছে বৈশাখের নতুন জামা কেনার সংবাদ জানার পর বাড়িতে ফিরে এসে কুড়িগ্রামের একটি গ্রামে এক স্কুলপড়ুয়া মেয়ে তার বাবার কছে বৈশাখের নতুন জামা আবাদার করেছিল। সেটা না পেয়ে সে অভিমান আত্মহত্যা করেছে। কারণ, তার বাবার চাকরি নেই তাই বৈশাখী ভাতাও নেই!
ক’বছর পূর্বে বৈশাখে নতুন রঙিন পোশাক কিনতে হবে, পরতে হবে তার তেমন প্রচলন ছিল না। এমনকি পান্তা দিয়ে ইলিশভাজা খেতে হবে তাও মানুষ জানতো না। এটা শহুরে সংস্কৃতি, যা ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের বদৌলতে গ্রামের সাধারণ মানুষরাও জেনে ফেলেছে বৈ-কি! কিছু লোভী ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করার মানসে ইলিশের অবৈধ মজুত গড়ে তোলে। শুধু বৈশাখের একদিনের জন্য হাজার হাজার টন ইলিশ সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এভাবে বাজারে ইলিশের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষকে বোকা বানানো হয়। এগুলো সব কিছুই শহুরে ধনীক শ্রেণির রসনা পূরণের কাজ লাগে। সাধারণ গরীব বা গ্রামের মানুষ এ থেকে বঞ্চিত হয়।
পহেলা বৈশাখে শহুরে মানুষ নতুন পাঞ্জাবি, শাড়ি, ফুল, মিষ্টি ও পানীয় কেনে। এ দিনে রসনা পূরণের জন্য তারা বহু আগেই ইলিশ কিনে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে। বাসায় ভালো কিছু রান্না হয়। আত্মীয়রা সবাই দাওয়াত না পেলেও বন্ধু-বান্ধবী ও সতীর্থরা সেগুলো খেতে ভীড় জমায়।
গ্রামের স্বচ্ছল পরিবারের সচেতন মানুষেরা সেদিন নিজের বা প্রতিবেশীদের জমি থেকে সাত ধরনের শাক খুঁজে খুঁজে তুলে আনে। সাত ধরনের শাক একত্রে রান্না করা হয়। এর মধ্যে তিতো পাটশাক, মিষ্টি ম্যারা শাক, কাঁটাঅলা খুঁড়িয়া শাক ও টক চুকাপাতা শাক অবশ্যই থাকতে হবে। সাত শাক মিলে এক ভিন্ন স্বাদের রান্না তৈরি হয়। একে ‘সাতশাকী’ বলে। অনেকের বিশ্বাস, পহেলা বৈশাখে ‘সাতশাকী’ খেলে অনেক অজানা অসুখ খেকে রেহাই পাওয়া যায়। অনেক গ্রাামের প্রচলিত কৃষ্টি হলো-এদিন সাতশাকী তুলতে সাধারণত: কারো জমিতে যেতে কেউ বাধা দেয় না।
এছাড়া নতুন কচি আম দিয়ে অম্বল বা খাট্টা বানানো হয়। সাজনা ডাটা, আটি কলার মোচা, শুটকি ভর্তা, পুদিনা ভর্তা, ইন্দুরকানি আলু ভর্তা, মাসকলাই ভর্তা ইত্যাদি নানা জাতের ঐতিহ্যবাহী খাবার আঞ্চলিক ভিন্নতা ভেদে গ্রামীণ জনপদের মানুষেরা পহেলা বৈশাখে নিজ বাড়িতে রান্না করে থাকে। এলাকাভেদে নানা ধরণের মেলার আয়োজন করা হয়। খেলাধূলা, শারীরিক কসরত প্রদর্শন, যাত্রা-পালা, পুতুল নাচ ইত্যাদি তো আছেই। তবে অনেক এলাকাতে এগুলো হারিয়ে গেছে। এছাড়া আছে দেশজ ফলমূল ও মিষ্টির নানা রকমফের। তরমুজ-বাঙ্গির সাথে বাতাসা, আমৃত্তি, জিলাপি, রসগোল্লা, কদমা ইত্যাদি না হলে তো বৈশাখী খাওয়া-দাওয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
উল্লিখিত বিষয়গুলো শহরের মেলাতেও আজকাল দেখা যায়। তবে গ্রাম বা শহর যাই হোক না কেন, এক শ্রেণির অসাধু মানুষ পহেলা বৈশাখে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও মাদকদ্রব্যের পরসা নিয়ে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের চরিত্র হরণ করতে বদ্ধপরিকর থাকে। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
করোনা মহামারির সংক্রমণ কমে যাবার আড়াই বছর পর হঠাৎ করেই ঘর থেকে বের হয়েছে মানুষ। আগের মতো পুনরায় তারা হোটেল, রেঁস্তোরায় খোলা খাবারের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। মার্চের শুরু থেকে রাজধানী ও আশেপাশের শহরগুলোতে ব্যাপক আকারে ডায়রিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপদ সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া সংক্রমণ কমছে না। এসময় বৈশাখী মেলায় খোলা খাবার ও অনিরাপদ পানীয় পান থেকে বিরত থাকতে হবে।
এছাড়া আমাদের দেশে বর্তমানে একটি অর্থনৈতিক ট্রানজিশন চলছে। সেজন্য এই সময়টা চারদিক থেকে বেশ অস্থির। সামাজিক ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে এই সময়টা আমাদের সামাজিক ও পরিবেশগত ট্রানজিশনের ক্রান্তিকাল হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। একটি টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে এই সামাজিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের ধারাকে সতর্কতার সাথে লালন করতে হলে আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের বৈশাখী সংস্কৃতি যেন শুধু একদিনের আনন্দ উল্লাস ও মেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি গঠনমূলক ও ইতিবাচক ধারায় বিকশিত হতে পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে প্রচেষ্টা চালাতে তৎপর হতে হবে।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।