আগুন শুধু পোড়ায় না, কিছু বিষয় আঙুল দিয়ে দেখায়ও

, যুক্তিতর্ক

হাসান হামিদ | 2023-08-31 18:48:35

 

পত্রিকায় দেখি প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও আগুন লাগে। পুড়ে মারা যায় মানুষজন। এই খবর আমাদের দেশে নতুন নয়। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের এক পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে বছরে আনুমানিক ৬ লক্ষ লোক আগুনে পুড়ে যায়। আগুনে পুড়ে গড়ে প্রতিদিন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসেন ২০ থেকে ২৫ জন। আর ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৬ বছরে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৮ হাজারের মতো। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এসবে প্রাণহানি হয়েছে ১ হাজার ৪ শ' জন, আহত হয়েছে অন্তত ৫ হাজার মানুষ। প্রতিদিন যেসব খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এর মধ্যে ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু বাদ যায় না। এসব নিয়ে সরকারের কী ভাবনা তা জানি না। তবে এমন খবর পড়তে পড়তে এখন আর আমাদের মনেই হয় না, একটি মানুষের মৃত্যু মানে শুধু তার চলে যাওয়া নয়; পাশাপাশি একটি পরিবারের সারা জীবনের হাহাকার রচনা হওয়া। অথচ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাটের গুদাম পুড়েছিল বলে বঙ্গবন্ধু নিজে দৌলতপুরে গিয়ে পোড়া পাট ধরে কেঁদেছিলেন। কিন্তু এখন এতো যে মানুষ মারা যায়, পরবর্তীতে কে রাখে তাদের খবর?

সর্বশেষ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে গত শনিবার রাত আনুমানিক এগারোটায়। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিস্ফোরণ-আগুনে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৯ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যও আছেন। অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে তারা নিহত হয়েছেন। আর যারা মারা গেছেন তারা প্রায় সকলেই পরিবহনশ্রমিক এবং ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর বাইরে এই ঘটনায় আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সদস্যসহ দুই শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। কেন ঘটেছে এই বিস্ফোরণ? প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ডিপোর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিকের কারণে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই কনটেইনারে ছিল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিক যৌগ। যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। বিএম ডিপোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইডবাহী কনটেইনার ছিল ২৬টি। ডিপোর টিনশেডে এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন জারে এই রাসায়নিক ছিল। আগুন লাগার পর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিকভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বের হয়ে কনটেইনারের সংস্পর্শে আসে। অক্সিজেন নির্গত হয়ে পানি ও আগুনের সংস্পর্শে কনটেইনারের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। কনটেইনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে স্প্রিন্টারের মতো। এতে বিস্ফোরণের তীব্রতা বেড়ে যায় ভয়াবহভাবে।

পত্রিকার খবরে পড়েছি, বিএম কনটেইনার ডিপোর আশপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকায় বসবাসকারীরা বেশির ভাগই শ্রমিক। এলাকার বসতঘরগুলো টিনশেডের। এখানকার বাড়িঘরের অনেকের দরজা খুলে পড়ে গেছে, ঘরের বেড়া উড়ে গেছে কিংবা জানালার কাচ ভেঙে গেছে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এত মারাত্নক ছিল যে এতে এই এলাকার ঘরবাড়ির দরজা-জানালাই শুধু ভেঙে যায়নি, টেলিভিশন, ফ্রিজ ও বৈদ্যুতিক পাখাও নষ্ট হয়েছে। প্রায় তিন দিন চলছে এই অগ্নিকাণ্ডের, এখনও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যাচ্ছে না। কারণ কেউ কেউ বলছেন এখনো ধোঁয়া উড়ছে। আবার কখন কী ঘটে, সেই ভয়ে দুই রাত ধরে অনেকেই ঘুমাতে পারছেন না। কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আতঙ্কে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স সম্প্রতি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ঘটা অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে তারা বলেছে, বাংলাদেশে প্রায়ই নিরাপত্তার নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়। বিশেষ করে শিল্পখাতে। ২০০৫ সালের পর থেকে এখানে কারখানা ও বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের প্রতিবেদনে কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুগন্ধা নদীতে একটি লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন লেগে অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়। লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনায় যাচ্ছিল। এ বছরের জুলাই মাসে রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের একটি জুস তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৫২ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৫ জন নিহতের পাশাপাশি ৫৫০ জন আহত হন। তাছাড়া বাস্তুচ্যুত হয় ৪৫ হাজার মানুষ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার সামান্য বাইরে একটি মসজিদের গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনায় নিহত হন ১৭ জন ও আহত হয় কয়েক ডজন। নামাজ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার কাছে একটি ফ্যানের কারাখানায় আগুন লাগে। যাতে কমপক্ষে ১০ জন মানুষ নিহত হন। আর নভেম্বরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাসের পাইপ লাইন বিস্ফোরণে সাতজন নিহত ও আটজন আহত হন। একই বছর মার্চ মাসে ঢাকার একটি ২২ তলাবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত ও ৭০ জন আহত হন। এ সময় ভবনটিতে বহু মানুষ আটকা পড়েন। আর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে দুইটি ভয়াবহ প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসময় পুরান ঢাকার একটি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৭০ জনের প্রাণহানি হয়। তাছাড়া চট্টগ্রামের একটি বস্তিতে আগুন লেগে দুই শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। এতে আটজন নিহতের পাশাপাশি ৫০ জনের বেশি আহত হন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি টেক্সটাইল কারখানায় আগুন নেভানোর আগেই ছয় শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৩ জনের মৃত্যু ও কয়েক ডজন আহত হন। ২০১২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের ইতিহাসে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। ঢাকার তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক নিহত ও ১৫০ জনেরও বেশি আহত হন। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে কারখানাটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার বাইরের একটি ক্রীড়া পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হন। একই বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২১ শ্রমিক নিহত ও প্রায় ৫০ জন আহত হন। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে একটি টেক্সটাইল কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬৫ জন শ্রমিক নিহত ও কয়েক ডজন আহত হন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার বাইরে একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২২ জন নিহত ও ৫০ জনের বেশি আহত হন। এগুলো কেবল গত কয়েক বছরে বড় অগ্নিকাণ্ডের তথ্য। এর বাইরে ছোট ছোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে সারা দেশে আঠারো হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং এতে  অর্ধ শতেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আর এসব অগ্নিকাণ্ডে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪৩০ কোটি টাকার মতো, যা উদ্বেগজনক। কলকারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এক হাজারের মতো, আর দোকান-পাটে প্রায় দুই হাজার। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু হওয়ার পর গত দুই দশকে ৭০০ গার্মেন্টস শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের মনে আছে, তাজরীন ফ্যাশনে লাগা আগুনে ১১১ জন শ্রমিকের পুড়ে মারা যান। গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হন আরও অনেক শ্রমিক। বাঁচার আশায় ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে পঙ্গু হয়ে যান কেউ কেউ। এরপর কারখানায় নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিস্তর কথা-বার্তা হলেও, থেমে নেই কারখানা দুর্ঘটনার খবর।

আমাদের দেশে বহুবার অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় সবারই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এতবড় বড় প্রতিষ্ঠানে যেখানে হাজার হাজার কর্মী কর্মরত, সেখানে কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে না? কোনো আইন নেই? আর কেমিক্যালের মজুদ কেন এমন অনিরাপদে থাকবে? এখন আরও যেসব এলাকায় এসব মৃত্যুকূপ আছে, তার কতটুকুইবা সরানো হবে! মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি এসব অগ্নিকাণ্ডে অর্থনৈতিক ক্ষতিও কিন্তু কম নয়। আমরা একবারও ভাবি না, ক্রমাগত  অগ্নিকাণ্ডের ফলে  দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষত পোশাকশিল্পে আগুনের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেজন্য বিদেশীরা এই খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবে স্বাভাবিক। আর এভাবে ক্রমশঃ শিল্পের বাজার ছোট হয়ে আসবে। বেড়ে যাবে বেকারত্বের হার; আর সেইসাথে বৃদ্ধি পাবে অপরাধকর্ম। এভাবে অর্থনৈতিকভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এখনো সময় আছে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবার। আমাদের ভাবতে হবে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়ই আসলে কী? আর অবশ্যই সরকারি কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমাদের সচেতন হতে হবে। তাছাড়া এই ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেজন্য সরকারকে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অতীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা আমরা কি ভুলে গেছি? হ্যাঁ, ভুলে গেছি! আমরা কি সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছি? না, নেইনি। আমরা এমনই সব খুব দ্রুত ভুলে যাই। আমরা সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর ঘটনাও ভুলে যাবো, যেমন আমরা প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পর কিছুদিন খুব সোচ্চার হই এবং তা ভুলেও যাই; যেমন নিরাপদ সড়কের দাবির কথা আমরা এখন প্রায় ভুলে গিয়েছি। কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক খুললেই শুধু ধ্বংসস্তুপের ছবি আর স্বজনহারা মানুষের আহাজারি। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সংবাদকর্মীদের পরিশ্রম ও ব্যস্ততা উল্লেখ করার মতো। সাধারণ মানুষও এগিয়ে এসেছেন সাধ্য মতো। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী হয়তো কয়েকজন কিংবা কয়েকটি পরিবারের দায়িত্বও নেবেন। কিন্তু যে শিশু আর কোনোদিন বাবা বলে ডাকতে পারবে না, যে মা কোনোদিন তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন না, যে ভাই আর কোনোদিন তার ভাইকে পাবেন না, যে পিতা কোনোদিন সন্তানের সফলতায় অহংকার করতে পারবেন না, যে স্ত্রী আর ফিরে পাবেন না তার স্বামীকে; তার কিংবা তাদের সেই ক্ষতি কি কোনোদিন পূরণ করা সম্ভব? সম্ভব নয়। তবে এই ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই ব্যবস্থা করা কিন্তু সম্ভব। আমরা একটু সচেতন হলেই এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারি। আমাদের সেই বোধের উদয় কবে হবে?

*লেখক- কথাসাহিত্যিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর