সীতাকুণ্ডে ট্রাজেডিতে আহতদের দেখতে যাওয়া গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির ওপর হামলা করেছে ‘একদল দুর্বৃত্ত’। পুলিশ হামলাকারীদের বলছে ‘অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী’। হামলার শিকাররা বলছেন হামলা করেছে ছাত্রলীগ। হামলাকারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে হামলা করেছে এমনই অভিযোগ এসেছে। হামলায় জোনায়েদ সাকির নাক দিয়ে রক্ত ঝরেছে, তার সহযোগীরাও আহত হয়েছেন।
গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর লোডিং স্টেশন এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কন্টেইনারে মজুত থাকা রাসায়নিক বিস্ফোরণে ব্যাপক প্রাণের অপচয় হয়। এ দুর্ঘটনায় ৪৪ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েকশ লোক। উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া অন্তত নয়জন ফায়ারসার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আহতরা চট্টগ্রাম-ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঘটনার চারদিনের মাথায় মঙ্গলবার সাত দল ও সংগঠনকে নিয়ে নবগঠিত ‘গণতন্ত্র মোর্চা’র নেতারা সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণস্থল বিএম কন্টেইনার ডিপো দেখতে যান। এরপর তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। আহতদের কাছে যেতে চিকিৎসকদের অনুমতি না মেলায় দূর থেকে আহত ব্যক্তিদের দেখেন তারা। পরে হাসপাতাল থেকে ফেরার সময়ে হামলার শিকার হন।
হামলা প্রসঙ্গে জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করেন। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা হয়েছে। তারা গাড়ি পুরোপুরি ভেঙে ফেলেন। কয়েক দফায় হামলা করেছেন তারা। জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও ছাড় দেননি। বেধড়ক মারধর ও হামলায় তার নাক ফেটে গেছে। হাতও কেটে গেছে।’ এ ঘটনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ জোনায়েদ সাকির। হামলায় ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গে সংগঠনটির চট্টগ্রাম নগর সভাপতি ইমরান আহমেদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ায় ছাত্র ও যুবকেরা জোনায়েদ সাকিদের প্রতিহত করেছেন। [প্রথম আলো, ৭ জুন ২০২২] এদিকে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার বলেছেন, ‘উনারা সীতাকুণ্ডের আহতদের দেখে ফিরে যাওয়ার সময় অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসে হামলা করে। এতে উনি সামান্য আহত হয়েছেন বলে শুনেছি।’ [বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৭ জুন ২০২২] পুলিশ বলছে ‘অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী’, জোনায়েদ সাকি বলছেন হামলাকারী ছাত্রলীগ, আবার ছাত্রলীগ নেতা বলছেন প্রধানমন্ত্রীর কটূক্তিকারীদের প্রতিহত করেছেন ছাত্র ও যুবকরা। অর্থাৎ হামলা প্রসঙ্গে জোনায়েদ সাকির অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করেনি স্থানীয় ছাত্রলীগ, তবে তারা এই ঘটনায় ছাত্র ও যুবকের নাম ব্যবহার করে সীতাকুণ্ড ট্রাজেডির সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিকেও যুক্ত করেছেন।
জোনায়েদ সাকি আক্রান্ত হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে একধরনের বিকৃত উল্লাস লক্ষ্য করা গেছে কিছু ব্যবহারকারীর। হামলার পক্ষে এবং জায়েজিকরণে তাদের অনেককেই সীতাকুণ্ডের ঘটনাকে নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ আনছেন। এটা সাকির উচিত শিক্ষা বলেও মন্তব্য অনেকের। দৃষ্টিকটু হলেও এমন মন্তব্যের আধিক্যে চাপা পড়ে গেছে মানবিক দিক। আহতদের দেখতে ঢাকা থেকে ছুটে যাওয়া এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মাঝেও তারা রাজনৈতিক স্বার্থ দেখছেন। বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন শেষে জোনায়েদ সাকি বলেছেন, ‘অতীতের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনা ঘটলে তা নাশকতা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়। এখানে কোথাও নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পুরোপুরি কারখানা ব্যবস্থাপনার গাফিলতিতে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আমরা ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত দাবি করছি।’ তার এই মন্তব্য বিশেষত তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে, যেখানে মন্ত্রী বলেছিলেন ডিপোর অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা সেটা খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া বিএনপিসহ বামজোট এই ঘটনায় সরকারের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে আসছে।
দুর্ঘটনার পর পর সরকার ও সরকারবিরোধী অংশের মধ্যে দায় নিয়ে এই কাদা ছোড়াছুঁড়ির ঘটনা নতুন নয়। প্রতি ঘটনার পর যেখানে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা সেখানে আমরা বিভক্ত হয়ে যাই। পুরনো সেই ধারার ব্যতিক্রম এবারও হয়নি। যে প্রাণের অপচয় হয়েছে, যে মানুষগুলো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে তাদের প্রতি সর্বাত্মক মানবিকতা দেখানোর কথা আমাদের সেটা দেখাতে আমরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। এবারও হয়েছি, বিশেষত রাজনৈতিক এই কথা-চালাচালিতে। জোনায়েদ সাকির ঘটনাস্থলে যাওয়া, হাসপাতালে গিয়ে আহতদের দেখে ফেরার পথে হামলার ঘটনা আমাদের অমানবিক দিকটি আরও বেশি প্রকাশ্য করেছে। এখানে তাদের রাজনৈতিক কৌশল থাকলেও এই রাজনৈতিক কৌশলের জবাব আক্রমণ দিয়ে করা উচিত হয়নি।
এই আক্রমণে কে লাভবান হলো? সরকার ও সরকারদল আওয়ামী লীগ নয় নিশ্চিত, বরং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা। সাধারণ মানুষের কাছে যে বার্তা গেল এটা সরকারের জন্যে সুখের নয়। সরকারবিরোধী অংশের বক্তব্যগুলোর গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তি কি দিচ্ছে না এই আক্রমণ? আমরা বিশ্বাস করি সরকার ও সরকারদল আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এই হামলা হয়নি। তবে এর দায় গিয়ে পড়বে সরকারের ওপরই, মানুষ এখানে সমালোচনা করবে সরকারকেই। রাজনীতির মাঠে জোনায়েদ সাকি ও তাদের নবগঠিত ‘গণতন্ত্র মোর্চা’র গ্রহণযোগ্যতা, শক্তি ও অবস্থান যাই হোক না কেন দেশবাসীর সহানুভূতি পাবেন জোনায়েদ সাকিরাই।
এমনিতেই সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক মত ও শক্তিকে প্রতিহত করার অভিযোগ রয়েছে, তার ওপর এই হামলা পূর্বতন অভিযোগের পালে আরও বেশি হাওয়া যোগাবে। দলীয় সিদ্ধান্তে হামলা না হওয়া সত্ত্বেও কিছু উশৃঙ্খল সরকার-সমর্থকেরা সরকারকেই বেকায়দায় ফেলছে। চট্টগ্রামের এই হামলা নতুন ঘটনা না হলেও আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এই ঘটনাও যোগ হবে। আসছে নির্বাচনের প্রচারণায় এই হামলা ও আহতদের ছবি পোস্টার, লিফলেটে ব্যবহার হয়ে সরকারবিরোধী জনমত গঠনে সহায়ক হলে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
রাজনীতিবিদেরা যেখানে পা রাখবে সেখানে রাজনীতি থাকতেই পারে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আহতদের দেখতে যাওয়ার মধ্যেও প্রকাশ্য ঘোষণা না থাকলেও রাজনীতিকে অস্বীকার করা যাবে না। অপ্রকাশ্য এই রাজনীতিকে নোংরা রাজনৈতিক কৌশল, আইন-আদালতকে তোয়াক্কা না করে আক্রমণ, গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনায় রূপ দেওয়া সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা নয়। এটা যারা করেছে তারা জোনায়েদ সাকির ভাষায় ছাত্রলীগ, পুলিশের ভাষায় অজ্ঞাতনামা দুস্কৃতকারী এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতার ভাষায় ছাত্র ও যুবক; এদেরকে যে যে-নামেই উল্লেখ করুক না কেন রাষ্ট্রের চোখে, আইনের চোখে তারা অপরাধী। আমাদের দাবি তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সহনশীলতা এবং আইনের শাসন চালু রাখতে তাদেরকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো। তা না হলে প্রথা-প্রতিষ্ঠান-সামাজিক-রাজনৈতিক রীতিনীতির সকল কিছুই ধ্বংস হতে থাকবে।
জোনায়েদ সাকি ও তাদের গণতন্ত্র মোর্চা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী হতে পারেন, কিন্তু তাদের অধিকার আছে আইনের মধ্যে থেকে যেকোনো কিছু করার। এখানে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই; সরকারের নেই, ছাত্রলীগের নেই, হামলার সমর্থক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর কারো নেই। যার যে অধিকার সেটা ভোগের অধিকার দিয়েছে রাষ্ট্র। সরকার ও সরকারদলের সমর্থকদের এর ব্যত্যয় করার সুযোগ নেই।
চট্টগ্রামের হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি আমাদের। সরকারবিরোধী হলেও সকলের নির্বিঘ্নে চলাচলের এবং মানবিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকারকে জোরপূর্বক দমন যারাই করতে চায় তারা সরকার সমর্থক নামধারী হলেও প্রকৃত অর্থে এরা দল ও সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। এরা বুঝেশুঝে কিংবা অজ্ঞতায় যেভাবেই হোক সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলাকারীদের কারণে সরকার ও সরকারদল কেন বেকায়দায় পড়বে, কেন প্রশ্নবিদ্ধ হবে—ভাবতে হবে গুরুত্ব দিয়ে।