তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে এই নদীর পানিবন্টন নিয়ে বিরোধ চলছে। ভারত ২০১১ সালে তিস্তার পানির ৪৭.৭ শতাংশ শেযার করার জন্য রাজি হয়েছিল। শুকনো মৌসুমে অর্থ্যাৎ ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ৪২.৫ শতাংশ পানি ধরে রাখার জন্য একমত হয়। কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিন টালবাহানার মধ্যে নিপতিত হয়ে তিস্তা চুক্তি বাস্তবে রূপ নেয়নি। বিগত বছরগুলোতে নানা কমিটির আয়োজনে এবং অধীনে শত শত বার বৈঠকের পরও কোন ঐক্যমতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে দুই দেশ।
আসামের গৌহাটিতে (মে ২৮-২৯, ২০২২) অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স রিভার কনক্লেভ’ থিম ব্যানারে আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনে উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তিস্তাসহ দেশের অন্যান্য নদীগুলো পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রন ও বন্টন নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। আর বিশেষ কোন অগ্রগতি হয়নি।
এরপর ভারতের এনডিটিভিতে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রস্তুত, তারাও (ভারত) প্রস্তুত, তবু এখনো চুক্তি হয়নি। এটা একটা লজ্জাজনক ব্যপার। ভবিষ্যতে পানির জন্য বড় ধরনের হাহাকার হবে। এবং আমাদের এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে” (ইত্তেফাক মে ৩১, ২০২২)। তিনি আরো বলেন, ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্য যে ১১ বছরেও আমরা তিস্তা পানি বন্টন চুক্তির সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি। ভারতের সঙ্গে আমাদের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। আমরা সব নদীর যৌথ ব্যবস্থাপনা ভাগাভাগি ও একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। উভয় পক্ষ এবং নদী এলাকার মানুষের সুবিধার জন্য যৌথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।’
অনেক ইস্যু নিয়ে আলোচনার পর সমাধান করা হরেও তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তির ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের দোহাই দিয়ে বার বার পিছুটান দেয়। কেন্দ্র বিগত কয়েক বছর দরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর উপর দোষ দিয়ে তিস্তা সমস্যাকে জিইয়ে রাখে। এটা বাংলাদেশর কোটি কোটি মানুষের জন্য শুধু দুর্ভাগ্য বললে ভুল হবে- আসলেই চরম লজ্জাজনক ব্যাপার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় আসাম কনফারেন্সে কিষয়টা উপলব্ধি করে মুখ ফুটে কিছু বলতে না পারলেও এনডিটিভিতে তার ক্ষোভ ঝেড়েছেন।
গতবছর তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন- “আগে নিজে খাব, পরে তো দেব” (দৈনিক ইত্তেফাক ৮.৩.২০২১)। কথাটি এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় উভয় দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য চুক্তি সই করার বিষয় সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জীর সামনে তিস্তা প্রসঙ্গ উত্থাপন করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে।
এর আগে ২০১৭ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘তিস্তায় তো পানি নেই-চুক্তি হবে কিভাবে’? তাঁর কথা ছিল তিস্তা নয়- তোরসা, জলঢাকা, মানসাই, ধানসাই ইত্যাদি নদীতে পানি আছে। সেগুলো থেকে বাংলাদেশের জন্য পানি দেয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন-বাংলাদেশের তিস্তা চুক্তি নয়, দরকার তো জলের! তবে এসব ক্ষীণ জলধারাকে বর্ষাকালে নদী মনে হলেও এগুলো সারা বছর প্রবাহমান কোন নদী নয়। এসব নদীর কোন অস্তিত্ব বা প্রবাহ কি বাংলাদেশে আছে? তিনি তিস্তা পানি বন্টনের কথা অন্যখাতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিস্তা সমস্যার সমাধান তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি দিয়েই করতে হবে। তার আপাতত: কোন বিকল্প নেই। কারণ, চীনের সংগে তিস্তা পুন:র্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় হয়তো আগেকার বৈঠকের বিষয়গুলো পুরোপুরি মাথায় নেননি। কারণ নানা উছিলায় তিস্তা ইস্যু নিয়ে কালক্ষেপণ ভারতের একটি ভূ-রাজনৈতিক কৌশল। এটা নতুন ইস্যূ নয়। তিস্তা সমস্যাকে জিইয়ে রেখে অন্যান্য সব সুবিধা আদায় করে নেয়া তাদের কৌশল।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী আগমনে তিস্তা নিয়ে আলোচনার আশা ছিল। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বচ্চো কর্তৃপক্ষ থেকেও বলা হয়েছে- ওগুলো বাদ, এটা আনন্দ উৎসব। তিস্তা সমস্যা নিয়ে চিন্তা পরে হবে! পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সই হয়ে গেছে ১০ বছর আগেই। তবে বাস্তবায়ন হয়নি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিস্তা তো অলরেডি ১০ বছর আগে চুক্তি হয়ে গেছে। বাস্তবায়ন হয় নাই (দৈনিক যুগান্তর ১৩.৩.২০২১)।
গতবছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় আরো বলেছিলেন, “তিস্তা চুক্তি ১০ বছর আগে পাতায় পাতায় সই হয়েছে। ডকুমেন্টও উভয়পক্ষ। ভারত সরকার আমাদের বলেছে, আগে যে চুক্তি হয়েছে সেটা স্ট্যান্ডবাই। তারা এটা গ্রহণ করে এবং তার থেকে কোনো ব্যত্যয় হয়নি। কী কারণে যে বাস্তবায়ন হয় নাই, আমরা তো সেটা জানি”(দৈনিক যুগান্তর ১৩.৩.২০২১)।
তিস্তা চুক্তি পরে আর কবে কোন সময় হবে সেটার আশ্বাস শুনতে শুনতে মানুষ বড্ড ক্লান্ত। সেটা কবে কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা ভুক্তভোগীদের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়! নয়াদিল্লীতে আগামী জুনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিস্তা ইস্যুকে প্রাধান্য দেয়া হবে বলে এবারের আসাম সম্মেলনের পর জানা গেছে।
তিস্তা নদী বাংলাদেশ মৃতপ্রায়। বহু বছর ধরে খরা ও বন্যা উভয় মওশুমে তিস্তা নিয়ে দুর্গতির শেষ নেই। তিস্তানদী সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েক দশক ধরে চলমান উদ্যোগের ঘাটতি নেই, কিন্তু সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য জন্য প্রতিপক্ষের দীর্ঘসূত্রিতা ও অবহেলারও শেষ নেই। বাংলাদেশের তিস্তাতীরের ভুক্তভোগী মানুষের অপেক্ষা ও কষ্টের দীর্ঘশ্বাসকে কেউ পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল যেহেতু অনেকটা নিরাপদ কৃষিভূমি দ্বারা আবৃত, এটাকে সযত্নে লালন করার জন্য তিস্তা ক্যাচমেন্ট এলাকাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। ভারতের সাথে তিস্তাচুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করা না গেলে দেশের কৃষি-অর্থনীতির উন্নয়নে চীনের ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন’প্রকল্পের মাধ্যম তিস্তা নদী তথা ডালিয়া ব্যরাজকে পুনরুজ্জীবন দেয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু চীন গত দেড় বছরেও তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়নি। আলোচিত ১০০ কোটি ডলার ঋণও দেয়নি।
কোন কারণে যদি চীনও বিগড়ে যায়, তাহলে পদ্মা ব্রীজের মতো আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি ও দেশীয় অর্থায়নে বর্ষার পানি ধরে রেখে ‘বিকল্প তিস্তা রেস্টোরেশন’প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটাই মাথায় রাখা উচিত। কারণ বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং কৌশলগত সুবিধার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলো সুসম্পর্ক রাখতে চায়। আবার বেশী শান্তিতে থাকুক বা বেশী ক্ষমতাধর হোক সেটা প্রতিবেশী দেশগুলোর কেউ চায় বলে মনে হয় না। আগে বহুবার বহু লেখায় উল্লেখ করেছি, চীনের সংগে তিস্তা পুন:র্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে গেলেও ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। যুগ যুগ চেষ্টা করেও কাঙ্খিত সহযোগিতা না পেলে নিজের দেশের চিন্তা নিজেকেই করতে হতে পারে।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd