ডিজিটাল বাংলাদেশে হাতে হাতে মোবাইল। মোবাইলে-মোবাইলে ইন্টারনেট। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারী অগণন। সামাজিকতা শেখার আগেই আমরা শিখে গেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। যোগাযোগের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে অনেকটাই। সহজ হয়েছে যোগাযোগ একদিকে, অন্যদিকে ব্যবহার না জানা অথবা ব্যবহারের বৈচিত্র্যে হারিয়ে ফেলেছি খেই। ফলে সামাজিক মাধ্যম অনেক সময় অসামাজিক মাধ্যমেও রূপান্তর ঘটে।
সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপকতার এই সময়ে অনলাইনে একদিকে আছে যেমন এর সদ্ব্যবহার, অন্যদিকে অপব্যবহারও। অনলাইনে যোগাযোগের সূত্রে অনেকেই ঝুঁকছে গুজব প্রচারের কাজে, অনেকেই আছে জঙ্গি ব্যবস্থাপনায়। সামাজিক মাধ্যমে অন্যতম জনপ্রিয় উপকরণ হচ্ছে ভিডিও। সংবাদ ও বিশ্লেষণধর্মী একাধিক পেজের অস্তিত্ব মেলে ওখানে। মূলধারার গণমাধ্যমসহ ভুলধারার অনেকেই এইধরনের ভিডিও প্রচার করে থাকেন। ফেসবুক এলগোরিদমের সুবাদে ব্যবহারকারীর ব্যবহার-ধারার ভিত্তিতে ফেসবুক সেইসব ভিডিও সামনে আনে। ফলে ভুল শিরোনামের, ভুল তথ্যের বেশিরভাগ ভিডিও চলে আসে সামনে। এইসব ভিডিও দেখে অনেকেই বিশ্বাস করে। মূলধারার গণমাধ্যমের চাইতে কিছু ভিডিওকে সর্বশেষ তথ্যের আধার ভাবে অনেকেই।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ফেসবুককে অনেকেই সংবাদের উৎস ভাবে। জানা-কম জানা অনেকের সঙ্গে পরিচয়, যোগাযোগ আমার। সেদিন একটা ছেলে সাম্প্রতিক লোডশেডিংয়ের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ বিদ্যুৎমন্ত্রী র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে এমনভাবে জানাল যাতে সরল বিশ্বাসে এই তথ্য অবিশ্বাস করার উপায় ছিল না! জিজ্ঞেস করলাম এটা জানল সে কীভাবে? উত্তরে জানাল, ফেসবুকে একটা ভিডিওতে দেখেছে বিদ্যুৎমন্ত্রীর ঘরের খাটের নিচ থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করেছে র্যাব। প্রবল আত্মবিশ্বাসে জানাল সে নিজে দেখেছে ভিডিও! বললাম এইধরনের ঘটনা ঘটলে সারাদেশে তোলপাড় হয়ে যেত, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে সংবাদ প্রকাশ হতো। তার কথা একটাই; র্যাব মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু সরকার এই সংবাদ গোপন করেছে! ছেলেটার তথ্যের উৎস ফেসবুকের সংবাদ, এবং এটা এমনভাবে সে বিশ্বাস করেছে যে পত্রপত্রিকা-টেলিভিশনে কোন সংবাদ না প্রচার হলেও ফেসবুকের সংবাদই আসল সংবাদ।
এটা সামান্য উদাহরণ মাত্র। আমাদের এলাকার মধ্য দিয়ে চার লেন সড়কের পরিকল্পনা চলছে। এনিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে নানা মাধ্যমে। এলাকার এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক সেদিন চার লেন সড়কের দরকার নেই জানিয়ে বললেন, সরকার এটা করছে ভারতের স্বার্থের জন্যে। ভারতের পণ্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে যাবে। ভারতের বড় বড় গাড়ির জন্যে বড় বড় সড়ক দরকার, তাই এই পরিকল্পনা। এই সড়ক এলাকার কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। তথ্যের সূত্র জানতে চাইলাম বললেন, ফেসবুকে দেখেছেন। ফেসবুকের সব কিছু সত্য নয় এমন বললে তার প্রত্যুত্তরের ভাবার্থ দাঁড়ায় সরকারের বিপক্ষে যায় এমন কিছু বলায় নাকি আমি মানতে পারছি না!
ছোট্ট দুই ঘটনার উল্লেখ করা মূলত সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে অসত্য তথ্য সত্ত্বেও সেগুলো কীভাবে মানুষ বিশ্বাস করে তার দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে। এমন কিংবা এরচেয়ে ভয়াবহ অনেক কিছুই মানুষ বিশ্বাস করে। প্রশ্ন ছাড়াই বিশ্বাস করে। যাচাই বাছাই আর বিবেচনাবোধের ধার ধারে না বেশিরভাগই। ফেসবুকে এসেছে, সত্য না হলে কি এমন আসতো; এধরনের বার্তা মেলে ওসব ক্ষেত্রে। সত্য হোক, মিথ্যা হোক স্রেফ একটা ভিডিও অথবা ভিডিওর মতো কিছু একটা হলেই যেন হয়!
এইধরনের যে ভিডিও হামেশা মেলে ফেসবুকে তার বেশিরভাগেরই পেছনে কোনো না কোনো চক্র কাজ করছে। অনেকেই পরিচিত। পরিকল্পনামাফিক চলছে এই কার্যক্রম। তাদের টার্গেট পিপল কারা সেটা আমরা বুঝতে পারি। ফেসবুকের নিরিহদৃশ্য ব্যবহারকারীরাই টার্গেট এদের। কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের পাঁচ কিংবা দশ শতাংশও যদি গুজবভিত্তিক এবং অসত্য ভিডিও ও প্রতিবেদনে প্রভাবিত হয় তবে এখানেই সাফল্য তাদের।
ডিজিটাল বাংলাদেশ; সরকার প্রচারিত স্লোগান এক। সরকার অনলাইনে কোন কিছু সেয়ারের আগে যাচাই বাছাই করার কথা বলছে। এটা কেবল সরকারই নয়, আমরাও বলি। কিন্তু কজন এই যাচাই বাছাইয়ের পথে যায়? সংখ্যায় নিশ্চিত খুব নগণ্য এটা। এই নগণ্য সংখ্যা অগণ্য হয়ে পড়ে অসত্য তথ্যে প্রভাবিত মানুষদের সংখ্যার তুলনায়।
অদ্য ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর একটা তথ্য দেখছি যেখানে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার সম্পদের পরিমাণ নাকি ৫১০ কোটি টাকা। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের নিউজওয়েবসাইটের একটা স্ক্রিনশটও দেখছি। প্রতিবেদনের যে লিংক ফেসবুকে অনেকেই সেয়ার করছেন সেটা ক্লিক করে দেখলাম প্রতিবেদনটি নেই। এতে ধারণা করছি, আগে এইধরনের প্রতিবেদন করলেও সেটা মুছে দেওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর যেকোনো সংবাদ পরে মুছে দেওয়া অপেশারদারত্বের পাশাপাশি পাঠকের সঙ্গেও প্রতারণা। সংবাদ প্রকাশের আগে যেকোনো সংবাদমাধ্যমের যাচাই বাছাই এবং বিশ্বাসযোগ্য সূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার প্রাথমিক শর্ত যেখানে সেখানে এই সংবাদমাধ্যম এটা করতে ব্যর্থ হয়েছে, অথবা যথাযথ অনুশীলন করেনি।
সংবাদের মূল সূত্র খুঁজতে গুগলে সার্চ দিয়ে পেলাম ২৩ অক্টোবর ভারতের ‘ক্রিকট্র্যাকার’ নামের একটা ওয়েবসাইটে ‘টপ টেন রিচেস্ট বাংলাদেশ ক্রিকেটারস’ নামের এক প্রতিবেদন যার প্রতিবেদক তেজাস রাঠি নামের এক ফ্রিল্যান্সার। ওই প্রতিবেদনে মাশরাফীর সম্পদের পরিমাণ বলা হয়েছে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫১০ কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রতিবেদনে সূত্র হিসেবে লিখা হয়েছে ‘অ্যাকোর্ডিং টু মাল্টিপল ওয়েবসাইটস’! সংবাদ সংশ্লিষ্ট যারা তারা জানেন নামহীন যেকোনো ওয়েবসাইট এমন সংবেদনশীল তথ্যের জন্যে বিশ্বাসযোগ্য কোনো সূত্র নয়। উড়ো তথ্যের এমন প্রতিবেদন সত্ত্বেও এটা এখন অনলাইনে অনেকের আলোচনার কেন্দ্রে। মাশরাফী কেবল একজন সাবেক ক্রিকেটারই নয়, তিনি সংসদ সদস্যও; তাই তার সম্পদের এমন আজগুবি তথ্য নিয়ে যেখানে সতর্কতার দরকার ছিল, বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের উল্লেখ ছিল সেটার কিছুই করেনি ক্রিকট্র্যাকার নামের খেলাধুলা বিষয়ক ওই ওয়েবসাইট। ফলে উড়ো কথায় লাফ দিয়ে ওঠা লোকজন আরও বেশি উত্তেজিত। এটা নিশ্চিতভাবেই মাশরাফীর জন্যে বিব্রতকর!
মাশরাফীকে নিয়ে এই বিভ্রান্তিকর তথ্যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভাবমূর্তি সংকটে কিছুটা পড়বেন। এদিকে সামাজিক মাধ্যমের রকমারি উড়ো খবরে বিভ্রান্ত হয়ে অনেক ঘটনাও ঘটে যার প্রভাব সমাজে ব্যাপকভাবে পড়ে। এগুলো দেখে আসছি আমরা। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যেখানে সতর্ক হওয়ার এবং সুবিবেচনায় যাচাই বাছাইয়ে যাওয়ার কথা সেটা আমরা প্রায়ই অবজ্ঞা করছি। অথচ এটা জরুরি। উড়ো খবর যেভাবে উড়ে সত্যাসত্য যদি তাৎক্ষণিক সামনে আসতো তবে হয়তো রক্ষা মিলত। সেটা আর হচ্ছে কই!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক