গত সপ্তাহে চিনি কিনেছিলাম ৯৮ টাকা দরে, গতকাল বাজারে গিয়ে দেখি দাম চড়েছে ১১০ টাকায়। পেঁয়াজ আগের মতো। সয়াবিনেও বাড়তি দাম। গুড়ো দুধের দাম জিজ্ঞেস করতে মাথায় হাত, প্যাকেটে বেড়েছে ৩০ টাকা। বললাম, প্যাকেটে তো আগের দাম; বাড়তি রাখবেন কেন? জবাবে জানাল, তারা বাড়তি দাম দিয়েও জিনিসপত্র পাচ্ছেন না। কোম্পানির প্রতিনিধিরা নাকি বলছে, আসছে সপ্তাহে দাম আরও বাড়তে পারে। টাকা দিয়ে মাল পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে পরামর্শ দিয়ে বলল, দরকারমতো জিনিসপত্র নিয়ে যান। দামের এই হালে কিছু নিলাম না, চক্ষুলজ্জায় কেবল ওই দোকান থেকে দুই প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে বের হলাম।
আরেক দোকানের দিকে রওনা দিলাম। পাইকারি দরে জিনিসপত্র বিক্রি করে। দরদাম করলাম। একই হাল। একই বক্তব্য, কোম্পানির লোকজন বলছে আগামী সপ্তাহে দাম বাড়তে পারে, টাকা দিয়েও মালপত্র পাওয়া যাচ্ছে না, সাপ্লাই কম। এরইমধ্যে শোনাল আবার আরেক কথা, দেশের অবস্থা খারাপ, খুব খারাপ। সবখানে একই সুর। বাজারে, জনসমাগমে লোকজনের সঙ্গে কথা বললে এই এক আওয়াজ। দেশে দুর্ভিক্ষ আসছে, মানুষ না খেয়ে মারা যাবে, যাদের টাকা আছে তারা টাকা দিয়েও কিছু পাবে না। বাড়তি দাম পরিশোধের কষ্ট বুকে চেপে, লোকজনের কথা শুনতে শুনতে অতি-প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে ঘরে ফিরলাম।
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময়ে ঘরে প্রশ্নের মুখে পড়লাম, তবে কি দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেল? না, এমনটা না; এমন উত্তরে আলোচনার সমাপ্তি ঘটাতে চাইলাম। সত্যি কথা বলতে কী, এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়িনি। কখনও ফিরিনি এমন দাম শুনে, কিন্তু এখন ফিরতে হচ্ছে। কারণ বাজার পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখানে আমাদের দিন যাপন কঠিন হয়ে ওঠেছে এরইমধ্যে। কেমন যাবে আগামী এটা ভাবতেই ভয় হচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক আগেই ভোক্তা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা নেই, তদারকি নেই, যার যেমন ইচ্ছে তেমনই বাড়াচ্ছে দাম। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা, টাকা থাকলেও কিছু না পাওয়ার শঙ্কার কথা। এগুলো প্রচার হচ্ছে দ্রুতগতিতে, এবং দোকানিদের দ্বারাই। দোকানিদের এই বার্তাগুলো খুব সহজেই মানুষের ঘরে-ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। আতঙ্কে থাকা মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেশি ভর করছে। বাজারে গিয়ে দেশ-পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা ধারণা রাখা আমিও যেখানে প্রভাবিত হচ্ছি সেখানে আমার চেয়ে কম ধারণা রাখা মানুষদের অবস্থা কেমন, ভাবা যায়!
পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলের মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এমন একটা ধারণা জন্মেছিল মানুষের। এরপর তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং, ডলার সঙ্কট এবং সবশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে দুর্ভিক্ষের ধারাবাহিক ইঙ্গিতের পর মানুষের আশাবাদে চিড় ধরেছে। দেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারণা মানুষের বিশ্বাস মূলে সেভাবে প্রভাব ফেলতে না পারলেও বাজার অব্যবস্থাপনা, ডলার সঙ্কটজনিত ব্যবসা বাণিজ্যের নাজুক অবস্থায় এখন মানুষ সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করছে যে ভয়াবহ দিন আসছে।
সম্প্রতি আরেকটা আওয়াজ ওঠেছে ব্যাংকে-ব্যাংকে টাকা মিলছে না। অর্ধেকের বেশি ব্যাংকে নেই আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা। যে রিজার্ভ নিয়ে সাধারণ মানুষের কোন আগ্রহই ছিল না, সেই রিজার্ভ নিয়ে মানুষ কথা বলছে। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নামতে-নামতে এখন ৩৪ বিলিয়নে এসে ঠেকেছে। দেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে যোগ হয়েছে টাকা পাচারের প্রচারণা। আওয়ামী লীগের লোকজন দেশের বাইরে টাকা পাচার করে দেশের এমন অবস্থা করেছে এমনটা মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে বলেও মনে হচ্ছে। এর কারণ মূলত বাজার পরিস্থিতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। কারণ প্রত্যেককেই বাজারে যেতে হয় এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাটা মানুষের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার কারণে অবিশ্বাস বাড়ছে, আতঙ্ক বাড়ছে।
ক্রমবর্ধমান এই আতঙ্কের বিপরীতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোন সংবাদ নেই। সরকারপ্রধানের কাছ থেকে আছে দুর্ভিক্ষের বারংবার হুঁশিয়ারি সংকেত। আছে লাগামহীন বাজার পরিস্থিতি, সঙ্গে যোগ হয়েছে দাম আরও বাড়ার শঙ্কার সংবাদ। এমন অবস্থায় মানুষ যাবে কোথায়, খাবে কী? মানুষের আয় কি বেড়েছে? বাড়েনি, বরং আগের চেয়ে কমেছে। আমরা কৃচ্ছ্র-অনুশীলনে, তবু টিকতে পারছি না।
জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, বাজার তদারকি নেই, এসব বাস্তবতা। কিন্তু আর কিছুদিন পর বাজারে জিনিসপত্র পাওয়া যাবে না এমন প্রচারণা জোরদার হচ্ছে ক্রমশ। এটা একটা জায়গা নয় অনেকগুলো জায়গা থেকে শুনছি, বিক্রেতা পর্যায়ের লোকজন বলছেন। এতে ক্রেতাদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর ফল ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেবল ভাতের জন্যেই না, মানুষ মরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করবে এই আতঙ্কে! এখানে কি সরকারের কিছু করার নেই? প্রশ্নের খাতিরে প্রশ্ন করছি ঠিক, তবে উত্তর হচ্ছে সরকারের করার আছে অনেককিছু, কিন্তু তারা করছে না। সরকার-প্রশাসনের মাঝেও কি তবে আতঙ্ক ভর করল?
কবির য়াহমদ সাংবাদিক, কলাম লেখক