অতীতে খরার সময় উত্তরের ছোট-বড় সব নদীতে পানি পাওয়া যেত। তাইতো তখন এই জনপদে পানি নিয়ে এত হাহাকার ছিল না। কিন্তু কয়েক দশক পূর্বে তিস্তাসহ সীমান্তের উজানের অনেকগুলো নদীতে একতরফা পানি প্রত্যাহার করার কারণে গ্রীষ্মকালে পানি সংকট একটি অবধারিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন উৎকণ্ঠিত সময়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সেচের পানির চাহিদা পূরণের নিমিত্তে লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে তিস্তা নদীতে ডালিয়া ব্যারেজের মাধ্যমে পানিসংকট নিরসনের চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু ডালিয়ায় ব্যারেজ শুরুর মাত্র পাঁচবছর সময় না গড়াতেই সেখান থেকে মাত্র ৬৬ কি.মি. উজানে ভারতের গা-জলডোবায় আরেকটি তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করে উজানের পানি প্রবাহ আটকিয়ে দেয়া হয়। এটা অনেক করুণ ইতিহাস। কারণ গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ঘরে-বাইরে শত শত মিটিং, বৈঠক ও তদবির করেও শুষ্ক মৌসুমে আন্তর্জাতিকতা নদী তিস্তার পানি ভাগাভাগির অদ্যাবধি কোন সমাধান লাভ সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন যাবত তিস্তা, ধরলা, পদ্মা ইত্যাদি অভিন্ন নদীতে আমাদের অধিকার ও পানি ব্যবহারের স্বাধীনতা হরিত।
ভারতের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের চরম গড়িমসি ও হেঁয়ালিপনার নিকট পরাজিত হয়েছে সকল দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টা ও আয়োজন। ভুলুন্ঠিত হয়ে গেছে সকল আন্তরিকতাপূর্ণ আলাপ-আলোচনা ও আশ্বাস। তিস্তা চুক্তির আশাবাদ নিয়ে অপেক্ষার পালা শেষ করে করে এখন আশাবাদের সকল আশা বাদ হয়ে গেলে চীনের সহযোগিতায় তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কিছুটা আশান্বিত হয়ে কালাতিপাত করছে। এই দারুণ পানি-খরার সময় তিস্তার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে কলকাতার পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফের গত ৪ মার্চের একটি খবর।
উক্ত পত্রিকায় একটি উদ্বেগজনক খবর বেরিয়েছে তা হলো ‘বেঙ্গল’স পুশ ফর টু মোর ক্যানেল আন্ডার তিস্তা ব্যারাজ প্রজেক্ট’। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘এর আগের দিন জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন ১ হাজার একর জমি হস্তান্তর করেছে পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের কাছে। উদ্দেশ্য, তিস্তার বাম তীরে আরও দুটি নতুন খাল খনন করা, যাতে জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলার আরও কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা যায়। অতিরিক্ত এক লাখ কৃষকের জমিতে সেচ-সুবিধা দেবে এই প্রকল্প। তবে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে এক দশকের অধিক সময় ধরে অপেক্ষমান বাংলাদেশ এতে আরও ক্ষুব্ধ হতে পারে।
জানা যায়, তিস্তা ও জলঢাকা নদীর পানি কুচবিহারে নিতে চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ২ কিলোমিটার একটি খাল খনন করা হবে। তিস্তার বাঁ পাশ দিয়ে দীর্ঘ আরেকটি খাল খনন করা হবে নদীর পানি জলপাইগুড়িতে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। তবে কেবলমাত্র তিস্তা নয়, ভুটান হয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলঢাকা নদীর পানিও সেচের কাজে জন্য ভারত প্রত্যাহার করবে বলে জানা গেছে।
এজন্য জমি হস্তান্তরের সময় রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক উপস্থিত থেকে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার এটিকে একটি জাতীয় প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করলেও এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল প্রদান করেনি। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে অর্থ না পেলেও পর্যায়ক্রমে আমরা এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা করব।
এ সময় বিজেপিকে উদ্দেশ্য করে করে পার্থ ভৌমিক বলেন, উত্তরবঙ্গের বিজেপির যে বিধায়করা আছেন, তারা নিজের এলাকার মানুষদের যদি বাঁচাতে চান, তবে কেন্দ্রের অনুদান আনুন। আপনাকে যারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তাদের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আছে। তবে এসব বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তিস্তা নদীর পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের মধ্যে বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক যোগসাজশ দেখানো শুরু হয়েছে। যেটা দিয়ে ২০২৩ সালে এসে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তার পানি প্রাপ্তির দাবিকে নতুনভাবে আড়াল করার হীন প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
প্রথমদিকে শুধু তিস্তার শুষ্ক মৌসুমের পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও পরবর্তীতে সারা বছর তিস্তার পানি ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে নানা পর্যালোচনার তাগিদ আসে। কিন্তু সেগুলোর কোনটিরই সমাধান নিয়ে অগ্রগতি হয়নি। এর মাঝে হঠাৎ করে জলঢাকা নদীর সঙ্গে সংযোগ ক্যানেল তৈরি করে পানি সরানোর বিষয়টি এসে হাজির হয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে।
জলঢাকা নদী শিঙ্গিমারী নামে জলপাইগুড়ি জেলা থেকে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে প্রবেশ করে কুড়িগ্রাম জেলায় ধরলা নামে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা, আদিতমারী ও সদরের সীমান্ত এলাকার মানুষের খরা মৌসুমে কৃষিকাজে সেচের প্রধান অবলম্বন ধরলা নদী। ধরলা নদীর পানির উপর নির্ভরশীল আদিতমারী উপজেলার মাছের অভয়আশ্রম ডাশিয়ার ছড়া। আশঙ্কা, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুকনো মৌসুমে যৎসামান্য পানি জলঢাকা থেকে বাংলাদেশের ধরলায় প্রবাহিত হতো, তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে। সেটা ঘটলে মাছের অভয়াশ্রম শুকিয়ে যাবে এবং কৃষপণ্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার বহু কৃষক ও জেলে বেকার হয়ে পড়বে।
ভারতের তৈরি নতুন দুটি খাল জলপাইগুড়ি ও কুচবিহারের বেশকিছু এলাকাকে সেচের আওতায় আনতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু ‘এটা বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে, কেননা উত্তরবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ ও পানি স্বল্পতা কাটাতে প্রতিবেশী দেশটি দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তির অপেক্ষা করছে।
বলা হয়ে থাকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকার ক্ষমতা আসার পর তিস্তা পানিবন্টন চুক্তির ব্যাপারে সুবাতাস বইতে শুরু করে। কিন্তু ‘২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি হয়নি। সেসময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে এই চুক্তির বাস্তবায়নের কথা থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফরসঙ্গী না হওয়া এবং রাজ্যের স্বার্থ দেখিয়ে সরে আসার কারণেই এই চুক্তি বাস্তবের মুখ দেখেনি। এবার প্রকল্পের পরিধি বাড়িয়ে মমতা উত্তরাঞ্চলের জন্য তিস্তার পানির প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের চেষ্টা করছেন বলে একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন।
পত্রিকায় শিলিগুড়ির নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপকের মন্তব্য হলো- যেহেতু মমতা ব্যানার্জির সরকার এখন সেচ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে, এটা স্পষ্ট যে তিস্তা থেকে আরও বেশি পানি নতুন খালগুলোর মাধ্যমে প্রবাহিত হবে। এর মানে হলো শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য আরও কম পানি থাকবে। এর অর্থ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা ও ধরলা নামক দুটি আন্তর্জাতিক নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে আরও বেশি সংকট তৈরি করা হলো।
মোটকথা তিস্তার পাশে আরও দুটি খাল খনন করছে ভারত যাতে বাংলাদেশের তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ কমার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি ধরলা নদী শুকিয়ে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় কৃষকদের আরো দুর্দিন নেমে আশার বিরাট হুমকি সৃষ্টি করা হলো। অন্যদিকে চীনের প্রস্তাবিত ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন’প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংকট আরও ঘণীভূত হয়ে গেল। কারণ, খরা মৌসুমে এই দুই নদীতে শতভাগ পানিশূন্যতা সৃষ্টি হলে চীনা প্রকল্প নিয়ে এতদিন যে পরিকল্পনা করা হয়েছে সেগুলো বাতিল করে নতুন করে ভাবতে হবে। এত প্রকল্পের ভাবনাচিন্তার গতি নষ্ট হয়ে যাবে।
এছাড়া চীনের সাথে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক সংকটের কারণে চীনা প্রকৌশলীরা ভারত সীমান্তে দীর্ঘদিন কাজে নিয়োজিত থাকলে সেটাকে কীভাবে পর্যালোচনা করা হবে তা নিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্লেষকগণ অনেক মন্তব্য করেছেন। আসলে তিস্তার দীর্ঘশ্বাসকে কেউ পাত্তা দেয় না। তিস্তা স্রোত বার বার যেন কার ইশারায় বাংলাদেশের দিকে না এসে ভিন্নদিকে চলে যায়। তিস্তা ইস্যু নিয়ে ভারত কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ব্লেম-গেম খেলে যাবে আরো কতকাল? কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একপক্ষ অন্য পক্ষকে দোষারোপ করে শুধু কালক্ষেপণ করে আর বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করে ফি-বছর প্রতারণা করে।
তবে আমি এর আগে আরেকটি লেখায় মন্তব্য করেছিলাম, ভারত যেভাবেই কালক্ষেপণ করুক না কেন এবং চীনা প্রকল্পকে যেভাবেই দেখুক না কেন, আমাদের অংশের তিস্তা নিয়ে আমাদের নিজেদেরকেই নতুন করে ভাবতে হবে। ভারতের আশ্বাসের গড়িমসি শুনতে শুনতে যদি আমাদের আরো যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হয় তাহলে সেই বিড়ম্বনাকে আমরা পাত্তা দিচ্ছি কেন? অথবা অতবড় চীনা প্রকল্প গ্রহণ করে আর্থিক সংকটের বেড়াজালে পড়ে এবং চীনের সাথে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে জড়িতে ও নিপতিত হয়ে আমাদের যদি নাভিশ্বাস উঠে তাহলে সেই প্রকল্পের আশায় আরো কালক্ষেপণ করে লাভ কী?
আমরা যেহেতু নিজ প্রচেষ্টায় পদ্মাসেতু তৈরি করতে পারি সেহেতু আমাদের অংশের তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, টিপাইমুখ ইত্যাদিকে মরতে যেতে দিতে পারি না। অপরকে ধর্ণা না দিয়ে স্থানীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে ছোট ছোট প্রকল্প গ্রহণ করে এসব নদীকে বাঁচিয়ে আমরা নিজেরাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের কাজে স্বাধীনভাবে সামনে এগিয়ে যাই না কেন? কেউ হাম্বরা হয়ে বার বার প্রতারণা করলে বঞ্চিতরা হন্যে ও ক্লান্ত হয়ে নতুন পথ খুঁজে নিতে দোষের কী?
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।