বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুর পর সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নতুন প্রার্থী ছাড়া উপায় ছিল না আওয়ামী লীগের। তবে শেষ পর্যন্ত যে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক আওয়ামী লীগ নেতা যে মনোনয়ন পাবেন এমনটা তিন মাস আগেও কেউ ভাবতে পারেনি। এতদিন যা ছিল চিন্তার বাইরে, এখন এটাই বাস্তব। সিলেটের স্থানীয় কোন নেতা নন, সিলেটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে লড়বেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী সিলেট নগরের ভোটারদের কাছে খুব পরিচিত নাম নন। তবে তিনি দলের নেতাকর্মীদের মাঝে বেশ পরিচিত। সিলেটে আসেন মাঝেমাঝে, বিশেষত বিভিন্ন নির্বাচনের সময়ে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে নানা সময়ে প্রচারণা করে গেছেন তিনি। এছাড়া জনশ্রুতি আছে সিলেট আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন কমিটি গঠনে তিনি আগে থেকেই প্রভাব রেখে আসছেন। এই হিসেবে সিলেটে নেতাকর্মীদের মাঝে তার অনুসারীর সংখ্যা নেহায়েত কম না। তবু তিনি নির্বাচন করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তবে গত জানুয়ারিতে দেশে আসার পর হুট করে কেন্দ্রের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন যে প্রচার শুরু হয়েছিল সেটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবই রূপ লাভ করল, যদিও এই গ্রিন সিগন্যালকে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে অস্বীকার করে আসছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
এবার মেয়র পদে সিলেটে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ১১ জন। এদের মধ্যে নয়জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, একজন ক্রীড়া সংগঠক ও একজন প্রবাসী। তবে শেষ পর্যন্ত প্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ওপর আস্থা রেখেছে কেন্দ্র। শনিবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড সিলেটের মেয়র পদে তাকে বেছে নেয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর এই মনোনয়নপ্রাপ্তিতে সিলেট আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা আরও একবার মনোনয়নবঞ্চিত হলেন। যদিও এটা সিলেটের মেয়র পদে প্রথমবার, তবে সিলেট-১ আসনে প্রতিবার আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের বাইরের কাউকে। সিলেট-১ সংসদীয় আসনে ‘অতিথি’ প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ, এবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেই ধারা যুক্ত হলো। এটা সিলেটের স্থানীয় নেতাদের হতাশ করেছে, যার প্রমাণও মিলেছে কিছু প্রতিক্রিয়ায়। মনোনয়নবঞ্চিতদের প্রায় সবাই দলের সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য দেখালেও ‘স্থানীয়দের কেউ প্রার্থী হলে ভালো হতো’ বলেও মন্তব্য করেছেন। মনোনয়নবঞ্চিত এবং স্থানীয় নেতাদের এই মন্তব্যে একদিকে যেমন দলের প্রতি আনুগত্য আছে, অন্যদিকে আছে উষ্মাও। নির্বাচনী-রাজনীতিতে এটাকে সাদামাটা দৃষ্টিতে দেখাও কঠিন!
সিলেট সিটি করপোরেশনে এ পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে, যেখানে প্রথম দুইবার মেয়র হয়েছিলেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সর্বশেষ দুইবারের মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। আরিফুল হককে সরকার ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়, বিশেষত প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পরিবারের সঙ্গে সখ্যের কারণে সরকারবিরোধী নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পেয়ে আসছেন। মুহিতের অবসর ও মৃত্যুর পর সেই একইধরনের সহায়তা পেয়ে আসছেন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের কাছ থেকে। এছাড়া সরকারি দল-বিরোধী দল নির্বিশেষে সিটি কাউন্সিলরদের সঙ্গে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। সে কারণে বিএনপি দলীয় মেয়র হলেও আরিফ নির্বিঘ্নে তার কার্যকাল অতিবাহিত করে যাচ্ছেন।
সিলেটে মেয়র আরিফের জনসমর্থনের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা আছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে সিলেট সিটি পুনরুদ্ধার করতে নতুন কোন মুখ, যার সাথে খুব বেশি সখ্য নেই মেয়রের। এছাড়া আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক এখানে প্রভাব রেখেছে। ভোটারদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এখানে আওয়ামী লীগ বেছে নিয়েছে প্রবাসী এই প্রার্থীকে।
আনোয়ারুজ্জামান আগে সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন। সিলেট-২ সংসদীয় আসনে একাধিকবার মনোনয়ন চেয়ে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। এবার তাকে যেখানে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ সেই এলাকার বাসিন্দাও নন তিনি। তবু স্থানীয়দের টপকে তিনিই অর্জন করতে পেরেছেন মনোনয়ন। তার এই মনোনয়নপ্রাপ্তিতে কি সিলেটে ‘প্রবাসীদের ক্ষমতায়নের’ আরেক ধাপ পেরুল?
সিলেটের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য একে আব্দুল মোমেন দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এরপর সংসদ সদস্য হয়েছেন, হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য গণফোরামের মোকাব্বির খানও লন্ডন প্রবাসী ছিলেন। সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবও দীর্ঘদিন লন্ডন ছিলেন। এখন তারা সকলেই দেশে আছেন যদিও, তবে এটা যে কেবল জনপ্রতিনিধি হওয়ার কারণেই এটা বলাই বাহুল্য! অর্থাৎ সিলেটের ছয়টি সংসদীয় আসনের অর্ধেক জনপ্রতিনিধিই (সাবেক) প্রবাসী। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
সিলেটে প্রবাসীদের এই ‘ক্ষমতায়ন’ ইতিবাচক, নাকি নেতিবাচক সেই আলোচনার চাইতে জরুরি হলো এসবের মাধ্যমে কি স্থানীয় রাজনীতিবিদদের রাজনীতির প্রতি অনীহ করা হচ্ছে না—এই প্রশ্ন! দলের দুর্দিনে যারা হাল ধরেন, সুদিনে কেন তাদের মূল্যায়ন করা হবে না—এই প্রশ্ন জোরেশোরেই ওঠেছে। ত্যাগের রাজনীতিকে কি তবে নির্বাসনে পাঠানোর আয়োজন চলল?
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। শেখ রেহানা কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকের নির্বাচনী প্রচারে তিনি অনেক শ্রম দিয়েছেন এটাও সত্য। তিনি সিলেটে আসেন মাঝেমাঝে, সিলেটের বিভিন্ন কমিটি গঠনে প্রভাব রাখেন, ভোটাররা তাকে না চিনলেও নেতাকর্মীরা তাকে চেনে এটাও সত্য—তবে তিনি স্থানীয় পর্যায়ের সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ নন। তার মনোনয়নপ্রাপ্তিকে অনেকেই ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ বলছেন, যা আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে আর যাই করুক গৌরবান্বিত করেনি।
এখন দেখার বিষয় তিনি কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন, নির্বাচনে নেতাদের কীভাবে নিয়ে আসেন! নির্বাচন পর্যন্ত তিনি যদি ‘অতিথি’ তকমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন, তবে আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে অংশ নিন বা না-ই নিন, সিলেটে আওয়ামী লীগের জন্যে সুসংবাদ কঠিন হয়ে যেতে পারে!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।