রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে হঠাৎ উদ্যেগী হয়েছে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যু তোলার পর মামলার ডকুমেন্ট সংযোজনের গতি শুরু হতেই মিয়ানমার সুর পাল্টিয়েছে। তারা এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায় বলে জানিয়েছে। কিন্তু ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশ থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলার কাজ শুরু হতেই ভয় পেয়ে মাত্র এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চাওয়ার সংবাদটি অবান্তর ও হাস্যকর মনে হচ্ছে। তবুও অনেকে মনে করছেন, এটাকে যেহতেু মিয়ানমার পাইলট প্রকল্প বলছে সেহেতু প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আপাতত শুরু হোক। তবে সেটা হতে হবে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের শর্তে।
বৈশাখের প্রাকৃতিক রঙের মাঝে শুরু হয়েছে দারুণ খরা ও দাবদাহের। এর সাথে চারদিকে শুরু হয়েছে অগ্নিকাণ্ডের ভয়। তবে আরও অনেক আগেই আরসা-আরএসও আধিপত্যের আগুন বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তকে দারুণভাবে দগ্ধ করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছে। আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেনশন (আরএসও) নামক সশস্ত্র গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত করে পরিবেশকে অশান্ত করে ফেলেছে। শান্তি উবে গেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার অধিবাসীদের মধ্যে। সাথে গোটা দেশেকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে এই ক্রমবর্ধিষ্ণু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা।
নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তে ব্যাপকভাবে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেবার পর একমাস না পেরুতেই কক্সবাজারের কালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন দেবার ঘটনা ঘটেছে। কালুখালি ক্যাম্পের ঘরাবড়ি পুড়িয়ে দেবার বিষয়টি কিছুটা অভিনব। এই ক্যাম্পে যেসব ঘরে আরএসও যোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছিল সেগুলোকে টার্গেট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরসা বেছে বেছে আরএসও নিয়ন্ত্রিত বসতিতে আগুন দেবার পরিকল্পনা করলেও পরে নির্বিচারে পুরো ক্যাম্পে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুন নেভাতে যাওয়া দমকল কর্মীদেরকে বাধা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় যারা আগুন নেভাতে এগিয়ে গিয়েছে তাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক বিষয়টির জন্য স্বাধীনতাকামী আরসাকে নিয়ে চারদিকে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা এখন বাংলাদেশের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে বিবেচিত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে তাগিদ আছে কিন্তু ত্যাগ নেই। গেল বছর ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে বাংলাদেশের ভূমিকার স্বীকৃতি মিলেছে। ওই পদক্ষেপ মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা ছাড়াও রাজনৈতিক পরিসরে রোহিঙ্গা ইস্যুকে চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করছে। কিন্তু বৈশ্বিক মনোযোগ ভিন্নদিকে। বিশ্বনেতারা ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনার দোহাই দিয়ে অর্থনৈতিক মন্দার কথা বার বার উল্লেখ করায় মানবিক সহায়তাদানকারী পিছুটান দিয়েছে। ইউরোপে অর্থনৈতিক সংকট ঘণীভূত হওয়ায় সেখানকার ডোনার এজেন্সীগুলোর অর্থায়ন বন্ধ হবার উপক্রম। এমন সময় নতুন ডোনার খুঁজে না পাবার অজুহাতে জাতিসংঘের বিষেশায়িত সংস্থাগুলোর নিয়মিত অনুদান তথা অর্থায়ন কমে যাবার সংবাদ যেন একটি বজ্রাঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অর্থায়ন কমে যাওয়াটা খুবই উদ্বেগের। তিনি জানান, আমাদের তহবিলের অবস্থা বেশ আটসাঁট। আমাদেরকে বলা হয়েছিল ৯০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভাসানচরে সরিয়ে নেবার জন্য আমরা যুক্ত হব। এই প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান আছে। এই মুহূর্তে ৩০ হাজার শরণার্থী রয়েছে এবং এই প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। গোয়েন লুইস আরো বলেন, একইসঙ্গে ভাসানচর ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জের।
অর্থ্যাৎ, ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য অর্থ দিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু তমব্রু ও কক্সবাজারে বার বার সহিংস ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করার জন্য বাড়তি অর্থায়ন প্রয়োজন। যেটা সার্বিকভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপর অর্থায়ন কমে যাবার জন্য বেশ নাজুক হয়ে পড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য ডোনাররা সহানুভুতি প্রকাশ কররেও তারা এখন অনেকটা নির্লিপ্ত। কারণ তাদের মধ্যে আর্থিক সক্ষমতা ও সমন্বয় কমে গেছে।
অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে রোহিঙ্গাদেরকে মানবিক সহায়তা দিতে দিতে সরকারের অবস্থাও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থায়ন দুটোই কমে যাবার ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান নিয়ে কর্তৃপক্ষ বেশ বিচলিত। এমন সময়ে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ক্যাম্পে বার বার সন্ত্রাসী হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বসতি পুড়িয়ে দেবার বিষয়টি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের পূণর্বাসনে নিমিত্তে আরো বেশি আর্থিক সংকটের মুখোমুখি করে তুলেছে।
স্থানীয় কিছু সংগঠণ নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তে পুড়িয়ে দেয়া বসতি কালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরএসও নিয়ন্ত্রিত বসতিতে আগুন দেবার ঘটনা জরিপ করে তালিকা তৈরি করেছে। তারা এখন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। তবে এর জন্য পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থা নেই। নিজেরা বার বার মারামারি করে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে বসতি জ্বালিয়ে দেবে তার জন্য অর্থায়ন করতে অনেকেই আগ্রহী নয়। অনেকে পাশ কাটিয়ে সেকথা প্রকাশও করতে চাচ্ছে না।
অন্যদিকে বলা হচ্ছে, সরকারি তহবিল নিয়ে কর্তৃপক্ষ আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছে না। কারণ এজন্য সরকারের কোন বাড়তি বাজেট নেই। একটি পত্রিকা উল্লেখ করেছে, শুধু ডলারের সংকট সামলানোই নয়; সরকার এবার খরচের টাকার টানাটানিতেও পড়েছে। রাজস্ব আদায়ে নাজুক অবস্থা। কৃচ্ছ্রসাধনে মেগা প্রকল্পের টাকা কাটছাঁট করেও অপচয় কমানো যাচ্ছে না। নিত্য খরচ মেটাতে ব্যাংক থেকে বেড়েছে ধারকর্জ। টাকা ছাপিয়েও খরচ সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে। ...সরকারের ভেতর এখন রীতিমতো হিমশিম অবস্থা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) টাকা নেওয়ার পরও এখন নতুন করে বিশ্বব্যাংকের কাছে খরচের টাকার জন্য হাত পাততে হয়েছে। বাজেট সহায়তা হিসেবে সংস্থাটির কাছে ৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে।
অর্থ্যাৎ, এই সময়ে বাজেটবিহীন কোন খাতে বাড়তি অর্থায়ন করার মতো পরিস্থিতি সরকারের নেই। তাই রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে আশ্রয়হারা হয়ে গেলে সেজন্য সরকারও বেশ বিব্রত। এ পর্যন্ত ক্যাম্পে ঠাঁই নেয়া ১২০০০ উদ্বাস্তু আগ্নিকাণ্ডে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে ভাসমান হয়ে পড়েছে।
এছাড়া তারা মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ও মানব পাচার, ধর্ষণ, খুন হাইজ্যাকিং ইত্যাদি নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন নিজেরা সংঘাতে জড়িয়ে থাকায় ক্যাম্পগুলোর অবস্থা মোটেই ভাল নয়। সারাক্ষণ সেখানে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে।
অন্যদিনে হাজারো চেষ্টা ও তদবিরের ফলে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নেবার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না। মার্চের প্রথম সপ্তাহে কাতারে বসে আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই অভিযোগ করেছেন। সেখানকার জান্তা সরকারের হাত বেশ লম্বা। জান্তা সরকারের পিছনে লবিং করার ব্লক বেশ শক্তিশালী। তারা অনেকেই বাংলাদেশের উন্নতি হোক সেটা মনেপ্রাণে চায় না। রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের বিপক্ষে একটি খেলনা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকায় এর আশু কোন সমাধান আশা করা উচিত নয়।
তবে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যু তোলার পর মামলার ডকুমেন্ট সংযোজনের গতি শুরু হতেই মিয়ানমারের সুর পাল্টানোর কারণ হলো ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সাথে করা চুক্তি নিয়ে টালবাহনা করার খেসারত। তারা এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায়। কিন্তু ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশ থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল পাঁচ বছরের আগে। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে ১২ লাখ হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা জোড়ালো করার কাজ শুরু হতেই এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চাওয়ার সংবাদটি হাস্যকর ও অবান্তর। তবুও অনেকে মনে করছেন, এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবার পিছনে উদ্যোগটি চীনের। চীন ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এই উদ্যোগকে কিছুটা এগিয়ে নিয়েও সফল হয়নি। এবারে চীনের প্রচেষ্টায় ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত আট দেশের কূটনীতিককে নিয়ে বৈঠক করেছে তারা। এছাড়া মিয়ানমারের মংডু ও সিটওয়ে শহরের অন্তবর্তীকালীন শিবিরগুলোকে পরিদর্শন করানো হয়েছে।সিটওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩০ রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের দেখভালের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন কমে গেছে এবং আমাদের নিজস্ব খরচের টান পড়েছে। এমতাবস্থায় প্রত্যাবাসন অন্তত: শুরু হোক।
বাংলাদেশ নিজেদের আর্থিক উন্নতির কথা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে সিদ্ধহস্ত। অন্যদিকে সেসব উন্নতির সংবাদ আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বিশ্বগণমাধ্যমে দ্রুত কভারেজ পায়। তাই বিশ্ববাসী জেনে ফেলেছে আমাদের ব্যাপক উন্নতির কথা। অন্যদিকে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের নিকট আমাদের সরকার বারবার ধর্ণা দিয়ে ঋণ ও সাহায্য প্রাপ্তির দরখাস্ত করে চলেছে- এমন দ্বিবিধ অবস্থান দেখে ডোনাররা রীতিমতো কনফিউজড্ হয়ে পড়ছে। তারা বাংলাদেশকে সাহায্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে নিজেদের অবস্থানকে রীতিমতো গুলিয়ে ফেলছে!
এমন নাজুক অবস্থার যাঁতাকলে ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সমস্যা, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ-দূষণ, দারিদ্র, ভিক্ষাবৃত্তি, জাতীয় নির্বাচনের ঝামেলা সবকিছুই। চারদিকে নানা সমস্যায় নিপতিত হলেও বুঝেও না বোঝার ভান করে আত্মউন্নতির কথা প্রচার করছি। যেটা নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতাবঞ্চিত কোটি কোটি মানুষ ভালভাবে গ্রহণ করছে না।
অপরদিকে অবুঝ কৃষকের ডিমপাড়া মুরগিটি জবাই করে গভীর রাতে অতিথি আপ্যায়নের মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছি আমরা নিত্যদিন। তাইতো আধিপত্যের অগ্নিভয় দেখানো আরসাকে সামলাতে সাহস করছি না আবার সার্বিক অর্থায়ন কমায় রোহিঙ্গা নিয়ে মহাসংকট মাথায় নিয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছি। এই উভয়সংকটের মধ্যে মাত্র ১০০০ রোহিঙ্গা ফেরতের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়াটা আপাতত: মন্দের ভাল অথবা শুধু কূটনৈতিক চাপের ধোকা বা চালাকি বলে মনে হয় কি?
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।