বর্তমানে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরগুলোতে সাড়ে ১২ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা বসবাস করছে। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ এই বোঝা টেনে চলছে যা শেষ হওয়া জরুরি।
এর আগে দু’বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহা ও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। বৈশ্বিক সংকটের কারণে দাতাসংস্থা ও দেশগুলোর ত্রাণ তহবিলে চাপ পড়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের পরিমাণ কমে এসেছে এবং তা আগামীতে আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ত্রাণসহায়তা কমে গেলে বাংলাদেশের একার পক্ষে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে না।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতিও দিনদিন খারাপ হচ্ছে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সংঘটিত নানা ধরনের অপরাধ বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকির সৃষ্টি করছে এবং ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যয় বাড়ছে যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ ফেলছে। বাংলাদেশ সরকার বন্ধু রাষ্ট্র এবং দাতা সংস্থাগুলোর কাছে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে যা এখন ও পাওয়া যায় নাই।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদ্যোগী হয়ে মিয়ানমার ৮-৯ মার্চ সেদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ ৮ দেশের ১১ জন কূটনীতিককে মিয়ানমারের মংডু ও সিতওয়ে শহরে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত অর্ন্তবর্তীকালীন ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকা সরেজমিনে দেখাতে নিয়ে যায়। এর পর, ১৫ মার্চ মিয়ানমারের ২২ সদস্যের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে ১৭৭টি পরিবারের ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করে। ১৮ এপ্রিল কুনমিংয়ে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং এর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তৃতীয় এই উদ্যোগ নেয়া হয়। এই বৈঠকের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ প্রত্যাবাসন উপযোগী কি না তা দেখার জন্য ২০ জন রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি গত ৫ মে সেখানে যায়। রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যদেরকে মংডু শহরের আশপাশের ১৫টি গ্রাম, পুনর্বাসনকেন্দ্র, ট্রানজিট কেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামো দেখানো হয়েছে।
তাদের সাথে যাওয়া শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানায় যে, তারা মংডু শহর ও গ্রামে গিয়ে সেখানকার রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেছে, সেখানকার পরিবেশ অনেক ভালো। মংডু শহরে রোহিঙ্গারা অবাধে ঘুরছে ও কাজকর্মে ব্যস্ত রয়েছে। তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাবাদী। রোহিঙ্গাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে তাদের সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখাতে এই সফরের ব্যবস্থা করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল মে মাসে বাংলাদেশ সফরে আসবে। সেসময় প্রতিনিধিদলটি প্রত্যাবাসন নিয়ে আস্থা বাড়াতে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করবে। সবকিছু ঠিক মত চললে মে মাসে ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গার প্রথম দলটি নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় চীন ও মিয়ানমার। এ বছর আরও ৫ ধাপে প্রতিবারে ১ হাজার ২০০ জন করে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই পাইলট প্রকল্প নির্বিঘ্নে বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যাবাসন ও অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলোতে আসিয়ান, ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবে বলে জানা যায়। বর্তমান প্রত্যাবাসন উদ্যোগ ও সম্ভাব্য ছয় হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে আগামী ডিসেম্বরে আরেকটা বৈঠক হবে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চীন কয়েক মাস ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চীনের বিশেষ দূত দেং সি জুন মিয়ানমার সফর করে। গত ৬ এপ্রিল তিনি ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিবের সাথে দেখা করেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানায় যে, চীন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ‘অবিচলভাবে মধ্যস্থতা’র কাজ করছে এবং প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান। চীনের রাষ্ট্রদূতআশা করে যে,আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি টেকসই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং তা হওয়া উচিত। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলছেন যে, গত পাঁচ-ছয় মাসে মিয়ানমার পক্ষের ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে, এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত হবে বলে আশা করা যায়। ৪ মে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে,চীন বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের আরও বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চায়।
রাখাইনের পরিস্থিতি বুঝতে হলে রোহিঙ্গাদেরকে এই প্রত্যাবাসনের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো প্রয়োজন নচেৎ এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে যা কারো কাম্য নয়। অনির্দিষ্টকাল বাংলাদেশে থেকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারের সুযোগ সুবিধা ও নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা বাস্তবসম্মত হবে না কারণ গত ছয় বছরে তা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। রাখাইনদের সাথে মিলেমিশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে যুগ যুগ ধরে বসবাস করতে হবে তাই তাদেরকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।মংডুতে রোহিঙ্গাদের স্বাধীন ব্যবসা–বাণিজ্য এবং মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের সচেতন করা গেলে প্রত্যাবাসনে তাদের আগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা যায়।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার পর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ, আসিয়ান বা বাংলাদেশের বন্ধু কোনো রাষ্ট্রের উপস্থিতির প্রয়োজন হবে কিনা কিংবা তাদের ভূমিকা কী হবে সেবিষয়ে সুষ্পষ্ট কিছু জানা যায় নাই। আসিয়ান মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার জন্য একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার কাজ করছে। এর মাধ্যমে কতজন মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন, কোথায় এবং কি সাহায্যের প্রয়োজন তা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে তাদেরকেও এই উদ্যোগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। এই প্রেক্ষিতে দাতাগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা স্বার্থরক্ষায় কর্মরত সংস্থাগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের মাধ্যমে তারা এই কার্যক্রমে সহায়তা করতে সক্ষম।
বাংলাদেশ চলমান এই দীর্ঘ মেয়াদি মানবিক সংকট উত্তরণে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে পরিবারভিত্তিক এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে আত্মবিশ্বাস যোগাবে এবং একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।এই চলমান উদ্যোগে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে সাথে নেওয়া না হলেও জাপানের সাথে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় জাপান প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত এই মানবিক উদ্যোগে পশ্চিমা বিশ্বের মুখপাত্র হিসেবে সমন্বয়কের কাজ করতে পারে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার পর প্রথম দলের মিয়ানমারে অবস্থানকালীন কি সমস্যা হচ্ছে সেটা জেনে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইনের জনগনের সাথে রোহিঙ্গাদের সুসম্পর্ক স্থাপন ও সহবস্থান নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে কাজ করতে হবে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকার, রাখাইনের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর রোহিঙ্গাদের প্রতি যে কট্টর মনোভাব ও বিরূপ ধারণা ছিল গত ছয় বছরে তা কিছুটা হলেও ইতিবাচক হয়েছে যা আরাকান আর্মি ও এন ইউ জি’র বক্তব্য থেকে জানা যায়। রাতারাতি এই মনোভাব পরিবর্তন সম্ভব না তবে ইতিবাচক দিকে তা চলমান থাকলে একদিন তা বদলে যাবেই।
ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদেরকে আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ চলমান রাখবে বলে জানিয়েছে যা তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে রাখাইনের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। রাখাইনের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেখানে কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি হবে, অর্থনৈতিক সাচ্ছন্দ ফিরে আসলে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান বৈরি মনোভাব কমে যাবে। এই পরিবেশ দ্রুত সৃষ্টি করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা জরুরি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে দাতাগোষ্ঠীও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রথম দিকে আরাকানে তাদের এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। আশা করা যায় যে, মিয়ানমার সরকার ও আরাকানের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সেখানে মানবিক কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে তারা তাদের চুক্তি নবায়ন করে কিংবা নতুন করে চুক্তি করে মানবিক সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে এই প্রক্রিয়ায় কিভাবে সহায়তা করা যায় সে বিষয়ে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে।
পাইলট প্রকল্পটি যেভাবে শুরু হয়েছে সেই পথ অনুসরণ করে এই প্রক্রিয়া যেন সফলতার মুখ দেখে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারে তার জন্য সকলপক্ষকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বৈশ্বিক এই সংকট বৈশ্বিক ভাবে মোকাবিলা করা হোক এবং বাংলাদেশকে এই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য সবার আন্তরিক সমর্থন প্রয়োজন।