পাশের দেশ মিয়ানমারে কঠোর ও নিবর্তনমূলক সামরিক শাসনের বজ্রআঁটুনি ভেদ করে সব খবর বাইরের মুক্ত পৃথিবীতে আসতে পারেনা। প্রবল সেন্সরকৃত খবরের তলানি থেকে যতটুকু আঁচ করা যায়, তাতে দেশটির স্বৈরতন্ত্রী, অগণতন্ত্রী ও মানবাধিকার বিরোধী কুশাসনের রক্তরঞ্জিত মুখচ্ছবি বিশ্ববিবেককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে। শুধু মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই নয়, জাতিগত ও ধর্মগত অপরাপর জনগোষ্ঠীকেও কচুকাটা করা হচ্ছে দেশটিতে। মিয়ানমারে গৃহদাহের আগুন প্রশমিত করতে সামরিক জান্তাকে অবশ্যই প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনায় বসতে এবং ক্ষমতা থেকে সরতে হবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও সেখানে সামরিক জান্তার বলদর্পিত নিপীড়নকারী আচরণ মোটেও কমছে না এবং আমজনতার অবর্ণনীয় দুর্দশারও অবসান ঘটছে না।
গত মাসের শেষের দিকে মিয়ানমারের বিভিন্ন অংশে সে দেশের উপজাতিগত জনগোষ্ঠী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ করে। এর থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, দেশটিতে সামরিক শাসকদের হাত ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে ও শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সংখ্যালঘু উপজাতি গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত থ্রি ব্রাদারহুড নামের একটি সংগঠন চীন সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের একাধিক এলাকা দখল করেছে এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সেখানে নাকাল হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে।
একইভাবে, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত, অস্থিরতার পরিপূর্ণ রাখাইন স্টেট এবং চীন স্টেটেও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে পিছু হটতে বাধ্য হওয়ার পর সামরিক জান্তা এবার পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে যুদ্ধবিমান থেকে নিজদেশের জনগণের উপর নারকীয় হামলা চালাচ্ছে, যার ফলে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু সাধারণ মানুষ।
এহেন গৃহদাহের চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সেনা কর্তৃক নিয়োজিত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, 'এই সমস্যাটি তথা প্রতিবাদকারীদের আন্দোলন ও তৎপরতা সাবধানতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।' মুখে বললেও কার্যক্ষেত্রে সামরিক জান্তা মানবাধিকারের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন নয়। দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে যে নির্মমতার মাধ্যমে জাতিগত নিধনের মুখোমুখি করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে, সেভাবেই অন্যান্য সংখ্যালঘু ও প্রতিবাদকারীদের নির্মূল করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে সেনা কর্তারা যখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আং সান সুকির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়, তখন তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল নিজেদের স্বৈরশাসন কায়েম করতে শক্তির অবাধ ব্যবহার করা। সেনা কর্মকর্তারা সু কি সহ অধিকাংশ গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিবিদদের কারাবন্দী করে এবং বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যাপক বলপ্রয়োগ শুরু করে। তারপর থেকে সেনার আক্রমণে ৪,০০০-এরও বেশি নাগরিক এবং গণতন্ত্রপন্থী নেতার মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ২০,০০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। নানা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এমনটাই দাবি করেছে। খোদ জাতিসংঘের অনুমান, মিয়ানমারে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন।
সামগ্রিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নিজেদের পক্ষে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সামরিক জান্তার হিংসাত্মক পদক্ষেপ কোনও কাজে আসছে না। বরং আক্রমণের মুখে সাধারণ মানুষ, বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আরও কোণঠাসা হয়ে মরিয়া মনোভাবে লড়ছে। অবশেষে সবাই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
দেশ হিসেবে মিয়ানমারের ইতিহাস বড়ই রক্তরঞ্জিত। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু উপজাতি সম্প্রদায় হিংসার মুখোমুখি। তবে অতীতে মূল জনগোষ্ঠী বার্মিজ সমাজের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সু কির নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রপন্থী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে সু কির শান্তিপূর্ণ বাধা প্রদানের উপায় খারিজ করা হয়। তার পরিবর্তে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সরকার, সামরিক শাখা তৈরি করা হয় এবং তারা উপজাতিগত বিদ্রোহীদের সাথেও হাত মিলিয়েছে। এই পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, সামরিক শাসকরাও সেটা আগাম আন্দাজ করতে পারেননি। বিগত দুই বছর ধরে সেখানে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখা দিয়েছে। বিদ্রোহীরা দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভুখণ্ডে নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। একাধিক ফ্রন্ট উন্মুক্ত রেখেছে, সামরিক জান্তার উপর সামরিক চাপ বজায় রেখেছে। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তারা ক্রমশ সমালোচনার মুখে পড়ছেন। জেনারেল মিন আং লাইঙ্গের প্রশাসন যে ক্রমশ মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তা বিদ্রোহীদের নয়া আক্রমণ এবং ভুখণ্ড হাতছাড়া হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
সামরিক জান্তার হাতে কোনো সহজ বিকল্প নেই। সামরিক সমাধানের সম্ভাবনাও আর নেই। সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ আলোচনা উন্মুক্ত রয়েছে। তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে পথেও অগ্রসর হয়নি। যদিও বৈচিত্রপূর্ণ নয়া প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা সামরিক কর্মকর্তাদেরকে রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে তারপর শান্তি ফেরাতে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের দাবি, এমন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয়, গণতান্ত্রিক সিস্টেম তৈরি করা, যেখানে সংখ্যালঘু উপজাতিদের আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
কিন্তু যদি মিয়ানমারে শান্তি না এসে অব্যাহতভাবে হিংসা চলতে থাকে, বিশেষত ভারত এবং চীন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, তাহলে এর আঞ্চলিক প্রভাবও দেখা যাবে। আসিয়ান সহ অন্যান্য প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলোরও তখন সংঘর্ষবিরতি আনতে, সেদেশে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতে ফিরিয়ে আনতে অর্থপূর্ণ আলোচনার পথ সুগম করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হবে।
এহেন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে সরকারি টিভি চ্যানেল ‘গ্লোবাল নিউজ লাইট অব মিয়ানমার’-এ প্রচারিত এক খবরে বলা হয়েছে, চীন ও মিয়ানমারের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, দু’দেশের জন্য লাভজনক যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়ন, সীমান্তে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৈঠকের বিষয়ে চীনা দূতাবাস বা সে দেশের সরকারি সংবাদ সংস্থার তরফে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে ‘স্থিতিশীলতা’ ফেরানোর অছিলায় মিয়ানমারে চীনা পিললস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ঢুকতে পারে বলে মনে করছেন ভারতের অনেক সামরিক এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে চাপে থাকা জান্তা সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমারকে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করতে পারে চীনের শি জিনপিং সরকার। যা নয়াদিল্লির পক্ষে অস্বস্তির কারণ হতে পারে। কেননা, ভবিষ্যতে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)-এর ধাঁচে রাখাইন প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিয়াউকফিউ বন্দর মারফত বঙ্গোপসাগরেরর ‘নাগাল’ পেয়ে যাবে চীনের লালফৌজ।
এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ, সীমান্ত পেরিয়ে মিজ়োরামেও মিয়ানমারের সমস্যার আঁচ লাগে প্রায়ই আর গৃহযুদ্ধের জেরে পাঁচ হাজারেরও বেশি মিয়ানমারের নাগরিক আশ্রয় নিয়েছেন মিজ়োরামে। অন্যদিকে, ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের অন্তত পাঁচটি প্রদেশ দখল করেছে বিদ্রোহী জোট। চীনগামী মূল সড়কটিও তাদেরই দখলে। এর ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতএব, মিয়ানমারে জান্তা শাসনে সৃষ্ট গৃহদাহের বিপদ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ছড়িয়ে পড়ার আগেই সকলে মিলে থামানো দরকার। আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।