পাল্টাপাল্টি হামলায় তেহরান-ইসলামাবাদের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম চার পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারত ইতিমধ্যে স্ব-স্ব অবস্থান জানান দিয়েছে। পাকিস্তান ও ইরানের এই উত্তেজনা প্রশমনে দেশগুলোর অবস্থান যতটা না জোরাল তার চেয়ে বরং চলমান বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের তৈরি করা সমীকরণেই সাবধানী অবস্থান তুলে ধরেছে তারা।
রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মধ্যেই লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হুথি বিদ্রোহীদের হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলা, মিয়ানমারে আরাকান আর্মির উত্থানের মত অসংখ্য উত্তেজনাকর ঘটনায় বিশ্বের স্থিতিশীলতা যখন এমনিতেই ধুঁকছিল সেরকম একটি সময়ে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে এই সংঘাত সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে বিশ্বের শক্তিধর চার রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থানগত কোন সংহতি লক্ষ্য করা যায়নি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি গ্রামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ২ শিশুসহ অন্তত চারজন নিহত হয়। এর ৪৮ ঘণ্টা মাথায় পাকিস্তান বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে ইরানে হামলা চালায়, যাতে চার শিশুসহ ৯ জন নিহত হয়েছে। এরই মধ্যে বুধবার পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে দুই রক্ষীসহ এক ইরানি কর্নেলকে গুলি করে হত্যার খবর এসেছে। ইরানের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযাী, সুন্নি চরমপন্থি গ্রুপ জইশ আল-আদল এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে।
ধারণা করা যায়, সামরিক শক্তিতে ইতিমধ্যেই বিশ্বে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া ইরান তাদের সামরিক বাহিনীর পদস্থ এক কর্মকর্তা হত্যার প্রেক্ষিতে শক্ত প্রতিক্রিয়াই জানাবে। কিন্তু সংঘাতময় বিশ্বে নতুন করে সংঘাতের মাত্রাবৃদ্ধি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকেই ক্রমাগত নাজুক করে তুলবে। আমরা জাতিসংঘ-সহ অন্য বিশ্বসংস্থা বা আঞ্চলিক কোন জোটকেই এখন পর্যন্ত সংকট প্রশমনে কার্যকর কোন পদক্ষেপ বা সংঘাতে জড়ানো দেশ দুটির মধ্যে কুটনৈতিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে দৃশ্যমান কোন তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি না।
বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বিচারে পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের পক্ষ থেকে ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনার বিষয়ে স্ব-স্ব দেশের অবস্থান তুলে ধরে যে বিবৃতি দিয়েছে তাও কোন আশার সঞ্চার করতে পারেনি।
ইরানের বিমান হামলার প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে প্রতিবেশী দেশ ভারত বলেছে, দেশগুলো আত্মরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপ নেয় তা তারা বোঝে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এটি ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি বিষয়। দেশগুলো তাদের আত্মরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপ নেয় তা আমরা বুঝতে পারি। ভারতের ক্ষেত্রে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্সের একটি আপোষহীন অবস্থান রয়েছে।’
অপরদিকে, চীন বৃহস্পতিবার পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা দূর করতে ‘গঠনমূলক ভূমিকা’ পালনের প্রস্তাব দিয়েছে। একজন চীনা মুখপাত্র বলেছেন, তিনি ইসলামাবাদের প্রতিশোধমূলক হামলা সম্পর্কে অবগত নন। তাঁর ভাষ্যে, ‘পাকিস্তান ইরানের উপর হামলা চালিয়েছে, আমি এ বিষয়ে অবগত নই। তবে আমরা এটির প্রতি খুব মনোযোগ দিচ্ছি এবং চীন সবসময় বিশ্বাস করে যে জাতিসংঘের সনদের উদ্দেশ্য এবং নীতি এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক পরিচালনা করা উচিত।’
চীনের মুখপাত্র এও উল্লেখ করেন যে, ‘‘চীন সবসময় বিশ্বাস করে যে জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের নীতির ভিত্তিতে দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক মোকাবিলা করা উচিত। ‘আমরা মনে করি সব পক্ষেরই অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান করা উচিত। ইরান ও পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং প্রভাবশালী দেশ। আমরা আশা করি উভয় পক্ষই সংযম অবলম্বন করতে পারবে এবং প্রয়োজনে উত্তেজনা এড়াতে পারবে, আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত।’’
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরানের কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বী। তারা তাদের পরম্পরা বজায় রেখেই পাকিস্তানের ভূমিতে তেহরানের হামলাকে স্পষ্টভাবে নিন্দা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, গত কয়েকদিনে ইরান তার তিনটি প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌম সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে। উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, তারা (পাকিস্তান) ইরান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে।
রাশিয়া ইরান ও পাকিস্তানকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানো এবং সমাধানের পথে হাটার আহ্বান জানিয়েছে। সামরিক ভাষায় নয়, কূটনীতির মাধ্যমেই বিবাদমান দুই দেশের মতপার্থক্য নিরসনের আহ্বান রাশিয়ার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘এটি দুঃখজনক যে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের দেশগুলোর মধ্যে ঘটনাগুলো ঘটছে। যারা এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে আগ্রহী নয় তাদের হাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।’- রাশিয়ার অবস্থানও স্পষ্ট যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় কোন আশা দেখতে রাজি নন।
সামগ্রিকভাবে এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, পরাশক্তি দেশগুলো তাদের স্ব-স্ব কৌশলী অবস্থানে থেকে ইরান-পাকিস্তানের নবসৃষ্ট সংঘাতের বিষয়ে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। যেকোনো মূল্যে সংকট প্রশমনে তাদের সংহতির কোন বার্তা নেই। অর্থনীতির ক্রমাগত সংকটেরে মাঝে বিশ্বময় নতুন করে যুদ্ধের দামামা যেভাবে বেজেই চলেছে তাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবসভ্যতা কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকবে তা হয়তো আগামীই বলে দেবে।