ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ভয়াবহ নৃশংসতা, শিশুহত্যা, ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে না দেওয়াসহ আরও নানাবিধ কারণে গোটা বিশ্বে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে ইসরাইলি বর্বরতার প্রতিবাদ হিসেবে দেশটির পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছিল গত প্রায় ছয়মাস আগে। ইসরাইলি পণ্যবর্জনের ডাক অমুসলিম দেশ থেকে শুরু হয়েছিল। সেটা এখন আরও বেশি সরব হয়েছে। মার্চ ২৬ তারিখে জাতিসংঘে যুদ্ধ বন্ধের জন্য সারা বিশ্বের আহবান পাস হয়েছে। কিন্তু পণ্য বর্জনের ঘটনা ইসরায়েলকে অনেকটা বিপাকে ফেলে দিয়েছে। কারণ, তাদের নিত্যপণ্যে ব্যবসা সারা বিশ্বজুড়ে। মানুষ ক্রমাগতভাবে তাদের পণ্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে থাকলে বিপদ অনিবার্য।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের গুঞ্জন শুরু হয়েছিল গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে। ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য নামক একজন সাংবাদিকের থেকে এই আহবান সর্বপ্রথম করা হয়েছে বলে জানা গেছে। শুরুর দিকে এটাকে কেউ ততটা আমলে নেয়নি। কারণ, ভারত এতবড় দেশ, এত বিস্তৃত তাদের পণ্যের বাজার তা শুধু বাংলাদেশের মানুষ বর্জন করলে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু ভারতীয় পণ্য সারা বিশ্বে বসবাসকারী প্রায় তিন কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি এবং দেশে দেশে তাদের সুহৃদরাও বর্জন করতে শুরু করলে ইসরায়েলের মতো অবস্থা শুরু হতে কতক্ষণ?
শুরু থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান দিনে দিনে বেশ জোরদার হয়েছে। আমাদের দেশের কর্ণধার থেকে নীতিনির্ধারণীদের মুখেও ‘শাড়ি, ডিম, তেল, পিঁয়াজু, কাবাব’ ইত্যাদিকে সম্পৃক্ত করে রসালো বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। যেটা আরও বেশি প্রচারিত হয়ে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।
বিএনপির-মতো বড় রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায়নি। কারণ বিএনপি শাসনামলেও অনেক বেশি ভারতীয় নিত্যপণ্য আমদানি করা হতো। পুনরায় ক্ষমতায় এলে ভারতীয় পণ্য আমদানি করতে হবে। তাই এতদিন বিএনপি শুধু নির্বাচন নিয়ে বিরোধিতা করে আসছিল। শুরুতে আমলে না নিলেও বাংলাদেশে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাম্প্রতিক অতিকথনের জেরে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ইস্যুটি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দুজন মন্ত্রী এব্যাপারে বেশি ভূমিকা রেখেছেন। একজন মন্ত্রীর সেদিনের বক্তব্য শুনে একটি পত্রিকা মন্তব্য করেছে- ‘মন্ত্রী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাককে আরও বেগবান করলেন।’‘মন্ত্রিদের এমন বেফাঁস বক্তব্য শুনে হয়তো ভারত সরকার নিজেরাই বিব্রত ও লজ্জাবোধ করছেন।’ভারতের সবাইতো বাংলাদেশের একটিমাত্র রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন না।
অনেক পত্রিকায় এব্যাপারে সংবাদ হয়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনে ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে এমন কথা মন্ত্রির বক্তব্য হিসেবে প্রচারিত হবার পর থেকে অফিসিয়ালি ভারতের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে। তা হলো- ‘ভারত একতরফা আওয়ামী লীগের পক্ষে সহায়তা করেছে।’এখানে ভারতের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের আপামর মানুষের কল্যাণের দিকটি উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই কমবেশি বাংলাদেশের ৬০-৭০ ভাগ মানুষ এটা নিয়ে গোস্বা করেছে। ভারতের বিরোধী দলগুলোও তাদের সরকারের এই পক্ষপাতমূলক আচরণকে মেনে নেয়নি। সেদিন একজন বাজারে গিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন, ‘বাংলাদেশিদের ভারতীয় পণ্য বর্জন শুধু বিজেপি সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, গোস্বা, মান-অভিমান সবকিছুকে কেন্দ্র করে।
বিএনপি এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে দেরি করেনি। কারণ, নানা কারণে, বহু বছর যাবত বাংলাদেশের মানুষ ভারতের ওপর নাখোশ হয়ে আছেন। তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়ার সাথে বেশি সরব হয়ে উঠেছে।
এই ক্ষোভের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত বিষয়গুলো ভারত সবসময় উপেক্ষা করে আসছে। অভিন্ন নদীর পানিবন্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়া, গরু রফতানি নিষিদ্ধ, পেঁয়াজের ওপর বাড়তি কর বসানো ইত্যাদি বাংলাদেশের মানুষ ভালভাবে নেয়নি। ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে বিএসএফের গুলিতে সীমান্তে ১,২৭৩ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১,২৮৩ জন। ফেলানি হত্যার বিষয়টি বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল। এবছর স্বাধীনতা দিবসের দিনেও সীমান্তে দুজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষকে অবহেলা ও হেয় চোখে দেখাটা আজকাল ভারত ফেরত যাত্রীদের মুখে মুখে আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য গেলে বলা হয় তোমরা কেন এখানে আসো? বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ, জুম্মার নামাজে নামাজরতদের ওপর মোদি পুলিশের লাথি, গুজরাটে তারাবির নামাজে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, ইত্যাদি ইস্যু শুধু বিএনপি বা বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ আওয়ামী লীগের সমর্থকগণ নয়- সারা বিশ্বের মুসলিমদের ওপর ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে বিদেশি শিক্ষার্থীরা। কিন্তু মোদি সরকার সেদিকে কর্ণপাত না করে চুপ করে আছেন। বিগত নির্বাচনে মোদি সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ বাংলাদেশের মানুষকে চরমভাবে আহত করেছে। তাই ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ না থেকে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যে অসম অবস্থা বিরাজমান। দুই দেশের বাণিজ্যে ঢেড় পার্থক্য থাকলেও এটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এক হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। শিক্ষার্থী, পুণ্যার্থী ও ভ্রমণকারীর সংখ্যা আরও বেশি।
ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রফতানি বাংলাদেশে হয় ও সেভেন সিস্টারে পণ্য পাঠানো বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সূচিত হয়। ভারত সয়াবিন, পেঁয়াজ, মশলা, কসমেটিকস্ ইত্যাদি বাংলাদেশে রফতানি করে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের মানুষ ৭ লাখ ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ খেয়েছে তার ৭ শতাংশ ভারত থেকে এসেছিল।
কথায় কথায় দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে ভুল করেছি বলে তারা খোটা দেয়। যেটা বাংলাদেশের অনেকে পছন্দ করেন না। সীমান্ত হত্যা, ফারাক্কা ও তিস্তা নদীর পানির ন্যয্য হিস্যা দিতে গড়িমসি নদীপাড়ের ভুক্তোভোগী মানুষের দীর্ঘদিনের কষ্টকে আরও বেশি খোঁচা দেয়। ভারতের ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদকের জন্য বাংলাদেশের কিশোর, যুবসমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
তবে বিএনপি ভারতীয় পণ্যবর্জনের সমর্থন দেওয়ায় ভারত কি বিএনপির প্রতি আরও বেশি হোস্টাইল হবে? তাহলে ভারতের এদেশের মানুষের প্রতি একচোখা নীতির আরও বেশি প্রতিফলন ঘটবে এবং তারা ভারতের প্রতি আরও বেশি বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকবে। যা উভয় দেশের মধ্যে সৎপ্রতিবেশীসুলভ বৈশিষ্ট্যকে ধুলিস্মাৎ করে দেবে।
তাহলে নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী কেন ভারত শুধু একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সহায়তা করলো? তারা একটি দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে এদেশের সিংহভাগ মানুষকে হেয় করেছে। কেড়ে নিয়েছে তাদের অধিকার। এখন একটি দল ক্ষমতায় বসে ভারতের স্তুতি গাইতে গিয়ে নিজেদের গোমর ফাঁস করে দেওয়ায় ভারতের অনেকেই বিব্রত বোধ করছেন। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই তাদের বক্তব্যে অনেকটা বিব্রত হয়ে পড়েছেন।
এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের ইস্যু। ইতোমধ্যে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বিএনপি কি পথহারা পথিকের মতো দিশেহারা হয়ে নিজের গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ করছে? নাকি তামাশা করছে ? কেউবা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা হতে কাজী নজরুলের কপালকুন্তলায় উদ্বৃত বনানী -কুন্তলা ষোড়ষীর বনের বুক চিড়ে বেড়িয়ে পথহারা যুবক-পথিকের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?’ হয়তোবা কারো কারো মনে সেটার উদ্রেক হতে পারে।
কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায় তারাও সেটা ভালভাবে জানেন। পথহারা পথিক বনের মধ্যে দিশেহারা হয়ে সুন্দরের দর্শনে নির্বাক হয়ে যাওয়ায় কোন উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু বিএনপির সামনে সব কিছু পক্ষপাতমূলক, অসুন্দর ও দৃষ্টিকটু মনে হওয়ায় দীর্ঘদিনের নির্বাক গোস্বা হঠাৎ সবাক ক্ষোভে পরিণত হয়ে যাওয়ায় একজন নীতিনির্ধারক কঠিন শীতে উষ্ণতাদানকারী তার গায়ের প্রিয় চাদরটিকে ছুঁড়ে দিয়ে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মাত্র। পাশাপাশি একই ক্ষোভে বিহ্বল বাকিরা সেটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। সাধারণত: এক প্রিয়জনের নির্মম আঘাতে অপর প্রিয়জনের প্রতিবাদের ভাষা এমনই প্রতিঘাত ও ঘৃণা হিসেবে প্রকাশিত হয়। যেখানে পথিক কোন শিশুও নয়, অবুঝও নয় এবং নিজে থেকে পথহারা নয়। তারা ক্ষমতালোভীদের রোষানলে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়ে এটাকেই প্রতিবাদের ভাষা মনে করে।
তাই ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবার জন্য ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে বিএনপির সমর্থন একটি চমৎকার প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের মাধ্যমে বিএনপি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভারতের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক মেসেজ দিতে পারে। যেটা তাদের ভবিষ্যতে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে প্রশস্ত করতে পারে। অনেকে এটা অবমূল্যায়ন করে বিতর্কে অবতীর্ণ হতে পারেন। কিন্তু ইতিহাসের অনেক তুচ্ছ ঘটনাকে তাচ্ছিল্য করার ফলে সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে আসার নজির রয়েছে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।