বাংলাদেশ কী একটি অনুদার সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছে?

, যুক্তিতর্ক

মো. বজলুর রশিদ | 2024-06-18 18:27:53

অনুদার সমাজ বলতে এমন একটি সমাজকে বোঝানো হয় যেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমাজের মধ্যে সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব থাকে। এই ধরনের সমাজে মানুষ সাধারণত ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম, ভিন্নজাতি এবং ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে থাকে।

অনুদার সমাজের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

প্রথমত, অনুদার সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত থাকে। ব্যক্তিরা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে না বা করলে তাকে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে মানুষ তাদের চিন্তাভাবনা বা ধারণাগুলি মুক্তভাবে প্রকাশ করতে ভয় পায়।

দ্বিতীয়ত, এ ধরনের সমাজে ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখা যায়। ভিন্নধর্মী, ভিন্নজাতি, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই অসহিষ্ণুতা প্রায়ই বিভেদ এবং সংঘাতের সৃষ্টি করে।

তৃতীয়ত, অনুদার সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য ও বিভাজন তীব্র থাকে। ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ এবং সমাজের কিছু গোষ্ঠীর প্রতি অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানের কারণে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এতে সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অসমতা ইত্যাদি সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে।

চতুর্থত, অনুদার সমাজে চরমপন্থী মতাদর্শ এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠী তাদের মতাদর্শ প্রচার করতে এবং ভিন্নমতের মানুষদের উপর আক্রমণ করতে তৎপর থাকে। এই ধরনের সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদ সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তিকে ব্যাহত করে।

পঞ্চমত, অনুদার সমাজে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং শত্রুতা দেখা যায়। এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু হিসেবে দেখে এবং এই শত্রুতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

অতএব, অনুদার সমাজে সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির স্বাধীনতা, সম্মান, এবং নিরাপত্তা হ্রাস পায়। সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা, এবং সামাজিক সুস্থতার অভাব থাকে, যা একটি সমাজের উন্নতি এবং অগ্রগতির পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায় যে, কিছু ক্ষেত্রে দেশটি একটি অনুদার সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জটিল, কারণ বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিবেশের বিভিন্ন দিক আছে যা দেশটিকে এখনও উদারতার দিকেও ধাবিত করছে। বাংলাদেশের একটি অনুদার সমাজের দিকে ধাবিত হওয়ার কিছু লক্ষণ এবং কারণ নিচে তুলে ধরা হলো।

প্রথমত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তীব্র বিরোধ ও সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব সাধারণ জনগণের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটাচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়ায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় চরমপন্থা ও উগ্রবাদীর উত্থান বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়াচ্ছে। কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে সহিংসতা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে, যা দেশের উদার সমাজব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, অপপ্রচার এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের প্রচার সমাজে বিভাজন ও ঘৃণা সৃষ্টি করছে। মানুষ সহজেই ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে এবং সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই ধরনের অপপ্রচার ব্যক্তির স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে সীমিত করছে এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার অভাব সৃষ্টি করছে।

চতুর্থত, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক অসাম্য সমাজে অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামাজিক বিভেদকে তীব্র করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও, জনগণের একটি বড় অংশ এখনও দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বৈষম্য সমাজে অসন্তোষ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করছে, যা উদার সমাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তবে, এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উদারতার পক্ষে কিছু ইতিবাচক দিকও নির্দেশ করে। বাংলাদেশে বহু জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থান রয়েছে এবং এ দেশের মানুষ সাধারণত সহনশীল ও সহমর্মী। সরকারের এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রচেষ্টায় সামাজিক স্থিতিশীলতা ও উদারতার উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।

সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের কিছু সংকটপূর্ণ দিক অনুদার সমাজের দিকে ধাবিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। তবে, এর সঙ্গে দেশের উদারতা ও সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ এবং নেতাদের উদারতা, সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সেইসাথে, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক বিভাজন হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র এভাবেই বাংলাদেশ একটি আরও উদার এবং সহনশীল সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

মো: বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর