এরভিং গফম্যানের তত্ত্ব ও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম

, যুক্তিতর্ক

মো. বজলুর রশিদ | 2024-06-30 18:55:08

এরভিং গফম্যান ছিলেন একজন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, যিনি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে কাজ করেছেন।

তার সবচেয়ে বিখ্যাত তত্ত্ব হলো ড্রামাটার্জি বা নাটকীয় উপস্থাপনা তত্ত্ব, যা তিনি তার বই দ্য প্রেজেন্টেশন অব সেলফ ইন এভরি ডে লাইফ-এ বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।

গফম্যানের মতে, সামাজিক জীবন একটি নাটকের মঞ্চের মতো। প্রত্যেক ব্যক্তি একজন অভিনেতা এবং সমাজ একটি মঞ্চ। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং এই পরিস্থিতিগুলোতে তারা বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন।

গফম্যান এই তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে মানুষ তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করেন। ড্রামাটার্জি'র মূল ধারণাটি হলো- সামাজিক উপস্থাপনা

এরভিং গফম্যানের 'ড্রামাটার্জি' তত্ত্বে মূল ধারণাটি হলো- সামাজিক উপস্থাপনা



একজন ব্যক্তি কীভাবে তার পরিচয় এবং ব্যক্তিত্ব অন্যদের কাছে উপস্থাপন করেন, সেটাই গফম্যানের মূল আলোচনার বিষয়। তিনি বলেন, যখন মানুষ অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া (Interaction) করেন, তখন তারা দুটি প্রধান এলাকায় থাকেন- সামনের মঞ্চ (front stage) এবং পেছনের মঞ্চ (back stage)।

সামনের মঞ্চে, মানুষ তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন করেন এবং তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্বকে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করেন। এখানে তারা তাদের সেরা দিকগুলো প্রদর্শন করেন এবং একটি নির্দিষ্ট ইমেজ বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। পেছনের মঞ্চে, মানুষ তাদের আসল সত্তা প্রকাশ করেন এবং তাদের আসল ‘ব্যক্তিত্ব’ দেখা যায়। এখানে তারা আরেকটু স্বাভাবিক এবং অপ্রতিষ্ঠিতভাবে আচরণ করেন।

গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং মানব আচরণের অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার কাজ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষ নিজেদের উপস্থাপন করেন এবং কীভাবে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার (Social Interaction) মাধ্যমে তাদের পরিচয় গঠন করেন।

এরভিং গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব এবং সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তার তত্ত্বটি আজকের ডিজিটাল যুগেও কতটা প্রাসঙ্গিক! সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম, যেমন- ‘ফেসবুক’, ‘ইনস্টাগ্রাম’, ‘টুইটার’ (এক্স) এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম আধুনিক সমাজে মানুষের আচরণ এবং নিজস্ব পরিচয়ের উপস্থাপনা নিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্বের প্রধান ধারণা হলো- সামাজিক জীবনে মানুষ নিজেকে এক ধরনের অভিনয়শিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করেন। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে এই উপস্থাপনাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সামনের মঞ্চ
বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে, ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইল তৈরি করেন, ছবি পোস্ট করেন, স্ট্যাটাস আপডেট করেন এবং বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার করেন। এই সবকিছুই গফম্যানের ‘সামনের মঞ্চ’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে মানুষ তাদের সেরা দিকগুলো তুলে ধরেন এবং একটি নির্দিষ্ট ইমেজ বজায় রাখার চেষ্টা করেন।

সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ নিজেদের জীবনের সুখকর মুহূর্তগুলো বেশি শেয়ার করেন, যা তাদের পরিচয়ের একটি পছন্দনীয় এবং আকর্ষণীয় দিক প্রকাশ করে। তারা বিভিন্ন ফিল্টার এবং এডিটিং টুল ব্যবহার করে নিজেদের ছবি এবং ভিডিওগুলো আরো সুন্দর করে তোলেন, যা বাস্তব জীবনের চেয়ে কিছুটা আলাদা হতে পারে। এইভাবে, তারা একটি নিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত পরিচয় উপস্থাপন করেন, যা তাদের অনুসারী এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়।

পেছনের মঞ্চ
গফম্যানের পেছনের মঞ্চ ধারণাও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক। অনেক সময় মানুষ তাদের প্রাইভেট মেসেজিং (ব্যক্তিগত বার্তা) বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ব্যক্তিগত চ্যাটের মাধ্যমে তাদের আসল চিন্তা এবং অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন। এখানে তারা আরেকটু স্বাভাবিক এবং কম নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকেন, যেটি পেছনের মঞ্চের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

অভিনয় ও আত্মপ্রতারণা
ড্রামাটার্জি তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘অভিনয়’ এবং ‘আত্মপ্রতারণা’। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ অনেক সময় নিজেদের জীবনকে অন্যদের চোখে আরো আকর্ষণীয় এবং সফল দেখানোর চেষ্টা করেন, যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নাও থাকতে পারে। তারা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক ইমেজ বজায় রাখতে চেষ্টা করেন, যা অনেক সময় তাদের আসল অবস্থার চেয়ে ভিন্ন হতে পারে।

গফম্যানের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা
সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে গফম্যানের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা আমাদেরকে এই ডিজিটাল যুগে ‘মানব আচরণ’ এবং ‘সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা’ বুঝতে সাহায্য করে। এটি বোঝায় যে, মানুষ কীভাবে তাদের অনলাইন উপস্থিতি তৈরি করেন এবং কীভাবে তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের পরিচয় এবং ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করেন।

ড্রামাটার্জি তত্ত্বের সমালোচনা
এরভিং গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হলেও এর কিছু সমালোচনাও রয়েছে। সমালোচকেরা বিভিন্ন দিক থেকে এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা এবং অস্পষ্ট দিকগুলো তুলে ধরেছেন।

প্রথমত, গফম্যানের তত্ত্বটি অতিরিক্তভাবে পারফরম্যান্স বা অভিনয়-কেন্দ্রিক। এটি মানুষের প্রতিদিনের ‘জীবনের জটিলতা’ এবং ‘গভীরতা’কে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হতে পারে। সামাজিক জীবনকে শুধুমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কারণ, মানুষের আচরণ এবং ব্যক্তিত্ব অনেক বেশি জটিল এবং বহুমুখী। এছাড়া, প্রত্যেক ব্যক্তি সর্বদা সচেতনভাবে তাদের আচরণ এবং পরিচয় পরিচালনা করেন না। অনেক সময় মানুষ ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ ও ‘অসচেতনভাবে’ কাজ করেন, যা গফম্যানের তত্ত্বে পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায় না।

দ্বিতীয়ত, গফম্যানের তত্ত্বে সামাজিক কাঠামো এবং ক্ষমতা সম্পর্কের বিশ্লেষণ কিছুটা অনুপস্থিত। এটি সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলিকে পর্যাপ্তভাবে বিবেচনা করে না, যা মানুষের আচরণ এবং পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে, এই বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যেখানে ক্ষমতা এবং সামাজিক কাঠামো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

তৃতীয়ত, গফম্যানের তত্ত্বে সাধারণ মানুষের জীবনের সাধারণ বিষয়গুলো অবহেলিত হতে পারে। তিনি প্রধানত ‘নাটকীয়’ এবং ‘বিশেষ পরিস্থিতিগুলো’ নিয়ে কাজ করেছেন, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বিষয়গুলোকে প্রতিফলিত করে না।

চতুর্থত, এই তত্ত্বটি আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল যুগের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই নয়। যদিও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের প্রেক্ষিতে ‘ড্রামাটার্জি’ তত্ত্ব অনেকাংশে প্রাসঙ্গিক, তবে আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়।

গফম্যানের তত্ত্ব ‘সমাজবিজ্ঞান’ এবং ‘মানব আচরণ’-এর অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে এর সীমাবদ্ধতা এবং সমালোচনাগুলোও বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা ‘মানুষের আচরণ’ এবং ‘সামাজিক মিথস্ক্রিয়া’ সম্পর্কে আরো গভীর এবং সুসঙ্গত ধারণা পেতে পারি।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর