রাষ্ট্র ও সরকারে একই ভূত বিরাজমান



মযহারুল ইসলাম বাবলা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের আমলাতন্ত্র নির্ভর ও শাসিত সরকারের শাসনামলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং বেসরমারিক আমলাদের আরব্য রজনীর মতো অর্থবিত্ত, সম্পদের সংবাদগুলো আমাদের ক্রমাগত হতবাক করে দিচ্ছে। দু’চারজনের সংবাদেই আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছে না, পুরো আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতির এবং অর্থ লুণ্ঠনের বিষয়াদি। সাবেক আইজি’র বিষয়ে একটি দৈনিকে তার অর্থ সম্পদের তালিকা প্রকাশের ফলে তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন বাধ্য হয় তদন্ত করে মামলা দায়ের করতে। অথচ যার বিরুদ্ধে অর্থবিত্তের, সম্পদের পর্বত সমেত অভিযোগ তিনি নির্বিঘ্নে অর্থকড়ি গুছিয়ে দেশ থেকে ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাকে কোনোরূপ বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার অবর্তমানে কিছুদিন লেখালেখির পর বিষয়টি অন্যান্য বিষয়ের মতো আমাদের স্মৃতি থেকে লোপাট হয়ে যাবে। যেমনটি এ যাবৎ কালের রোমহর্ষক ঘটনাগুলো হারিয়ে গেছে। অপরাধীরা নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন জীবন-যাপন করছেন। আইজি সাহেবের পলায়নের ঘটনার পর ক্রমশ গণমাধ্যমে সেটা প্রায় চাপা পড়েছে।

গত কুরবানি ঈদে ১৫ লক্ষ টাকায় খাসি কেনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং কুরবানিতে কোটি কোটি টাকার পশু কুরবানি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় ওঠে। ইফাত নামক ছেলেটির ১৫ লক্ষ টাকার ছাগল কেনার ঘটনার পর একে একে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের পুত্র ইফাতের ছাগল কেনার সূত্র ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক মতিউর রহমানের অবৈধ পন্থায় অর্থবিত্ত, সম্পদের বিবরণের খতিয়ান সম্প্রতি দেশজুড়ে তোলপাড় করছে। দুই স্ত্রী’র নরসিংদী ও ফেনিতে সম্পদের পরিমাণ এবং অবকাঠামোগুলোও নজিরবিহীন। করোনায় আক্রান্ত মতিউর দ্বিতীয় স্ত্রীকে খালি চেক স্বাক্ষর করে দেয়। ওই চেকের মাধ্যমে তিনশত কোটি টাকা দ্বিতীয় স্ত্রী’র হাতিয়ে নেবার সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের গাড়ির বহর। রাজকীয় জীবনাচার। প্রথম স্ত্রীকে কলেজের অধ্যাপনা থেকে ছাড়িয়ে অর্থের জোরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বসানো ইত্যাদি ঘটনাগুলো রূপকথাকেও হার মানায়। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার এবং কানাডায় আমলাদের স্ত্রীদের নামে বাড়ি কেনার হিড়িকে কানাডায় বাংলাদেশি নারীদের মালিকানার বাড়িগুলোকে ‘বেগম পাড়া’ হিসেবে গত ক’বছর ধরে প্রচারণা চলছে। মতিউরের ক্ষেত্রেও কানাডায় সম্পদ ক্রয়ের এবং সন্তানদের সেখানে পাঠিয়ে দেবার ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। এখনও মতিউর অধরা। তবে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে দুদক। এখনো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন, আগের মতোই। নিজেকে রক্ষা করতে ইফাতকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করার ন্যায় ঘৃণিত মিথ্যাচার করতেও দ্বিধা করেনি।

প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধ লুণ্ঠন অনাচারের যে চিত্র জনসমক্ষে ক্রমাগত প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের বিষয়ে সরকারের উপেক্ষার কারণ কী! কারণ আমরা জানি এই সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনায় এনেছে এবং রেখেছে আমাদের দুই আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এটা জলের ন্যায় পরিষ্কার। তাই সরকার আমলাদের বিরুদ্ধে তাদের অপরাধের বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে পক্ষান্তরে ওই অনাচার-দুর্নীতিকেই পক্ষান্তরে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সরকার সংশ্লিষ্টরাও ধোয়া তুলসি পাতা নয়। তাদের অবাধ লুণ্ঠন, দুর্নীতিও আকাশ ছোঁয়া। অর্থাৎ আমাদের শাসকশ্রেণি সম্পূর্ণ রূপে দুর্নীতিতে, লুণ্ঠনে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কে কাকে আটকাবে! রাষ্ট্র এবং সরকার দুটি আলাদা সত্তা। রাষ্ট্র স্থায়ী কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার ৫ বছর মেয়াদি। জনগণ নির্ধারণ করে কোন দল রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। সেটা নির্বাচনে নির্ধারিত হয়। এটাই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিধি ব্যবস্থা। বাস্তবে আমাদের দেশে ওই ব্যবস্থা কার্যকর নেই বরং উপেক্ষিত। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রে এবং সরকারে অর্থাৎ পুরো শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরে নেই স্বচ্ছতা, নেই জবাবদিহিতা, নেই নিয়ন্ত্রণ। আর কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সবাই তো অভিন্ন পথযাত্রী। সর্ষে ভূত থাকলে তো সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়ানো যায় না। আমাদের শাসকশ্রেণির দশা ঠিক তেমনই। একের পর এক আমলা, পুলিশ, সরকারি দলের রাজনীতিকদের রোমহর্ষক দুর্নীতি, অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনা ফাঁস হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈ চৈ হবে। আরেকটি ঘটনা আগের ঘটনাকে চাপা দিয়ে দেবে। একের পর এক ঘটতে থাকা ঘটনায় আর কত প্রতিক্রিয়ামুখর থাকবে মানুষ এবং গণমাধ্যম! আগে নৈতিক পথে উপার্জন এবং অনৈতিক পথে উপার্জন নিয়ে সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেত। এখন সেটা দেখা যায় না। কে কিভাবে, কোন উপায়ে হঠাৎ সম্পদশালী, বিত্তবান হয়ে উঠলো এ নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। বরং বলা হয় তিনি ভাগ্যবান আল্লাহর ইচ্ছায় এবং আশীর্বাদে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।

কাগজের মুদ্রা-টাকার যে রঙ রয়েছে, সেটা আমাদের সকলেরই জানা। পরিমাণ ভেদে টাকার রঙও ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। এই রঙ বৈচিত্র্যপূর্ণ তো বটেই এবং বহু রঙের সমাহারে। টাকাকে দুই পৃথক রঙে বিভক্তিকরণের সামাজিক আচার ছিল এবং আছেও। বর্ণিল রঙের এই টাকাকে আমাদের সমাজে সচরাচর সাদা-কালো দুই পৃথক রঙে চিহ্নিত করার অলিখিত নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং রয়েছে। সেটা বহুকাল-যুগ পূর্ব থেকেই। অতীতে সামাজিক মান-মর্যাদার প্রশ্নটিও প্রচলিত টাকার রঙের ওপর নির্ভর করতো। অর্থাৎ ব্যক্তির অর্থ বৈধ না অবৈধ সেটা নির্ধারিত হতো ব্যক্তির অর্থ বা টাকা সাদা না কালো নির্ধারণের ভিত্তিতে। হঠাৎ বিত্তবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিংবা আয়ের সঙ্গে সম্পদ ও ব্যয়ের অসঙ্গতিতে সামাজিক জীবনে ওই ব্যক্তিকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি হতো। জন্ম দিত নানা জল্পনা-কল্পনার।

আমার কৈশোরের একটি ঘটনা স্মরণ করছি। সরকারি উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার কয়লা আমদানি করতো, কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল। আমদানিকৃত সে কয়লা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বার্জ যোগে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে পরিবহনে বেসরকারি ঠিকাদার নিয়োগ করা হতো। বার্জে করে কয়লা পরিবহনের জনৈক ঠিকাদার আমাদের এলাকায় বসবাস করতেন। হঠাৎ ব্যক্তিটির অস্বাভাবিক আর্থিক উন্নতিতে কৌতূহলী স্থানীয়দের মধ্যে এক প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রমাণ যোগ্য তথ্যের অভাবে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলেনি। সেজন্য অবশ্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। অচিরেই ঠিকাদারের বাড়িতে পুলিশ এসে ঠিকাদারকে ধরে নিয়ে যায়। ঠিক দুইদিন পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ঠিকাদার বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু প্রকৃত রহস্য আর চাপা থাকেনি। দ্রুত সেটা পুরো এলাকায় চাউর হয়ে গিয়েছিল। ঠিকাদার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কয়লা পরিবহনের জন্য ১৪টি বার্জে কয়লা ভর্তি করে ঢাকার পরিবর্তে অন্যত্রে কয়লা নামিয়ে পাচার করে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জানায় কয়লাসহ পরিবহনকৃত ১৪টি বার্জ নদীতে ডুবে গেছে। সরকারি পণ্য তসরুপের অভিযোগে ঠিকাদারকে আটক করে পুলিশ। তবে তার দ্রুত অব্যাহতিতে মজার কথাও প্রচার পেয়েছিল। তার এই অপকীর্তির সঙ্গে সরকারি দফতরের লোকজনও জড়িত ছিল। এমন কি বার্জ ডুবেছে কিনা সেটা তদন্তে সরকারি দফতর যাদের নিয়োগ করেছিল; ঠিকাদার ও সরকারি কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তাদের বখরা দিয়ে সমঝোতা করে ফেলে। পরিশেষে তদন্ত নাটকের যাবনিকা এবং ঠিকাদার বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তবে ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠানকে কয়লা পরিবহনের কাজ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। শাস্তি কেবল এটুকুই তিনি পেয়েছিলেন।

সামাজিক ভাবে এলাকায় তিনি ‘কয়লা চোর’ খ্যাতি কিন্তু লাভ করেন। এমন কি তার সন্তানেরা পর্যন্ত কয়লা চোরের খ্যাতি মাথায় নিয়ে নত মুখে এলাকায় চলাচলে বাধ্য হয়। তাদের একতলা বাড়ি দ্রুত চারতলায় রূপান্তরিত হয়। এবং এলাকায় বাড়ি, জমি-সম্পত্তি কেনায় যেন ঠিকাদারের হিড়িক পড়েছিল। স্থানীয় কাউকে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে আর দালালের শরণাপন্ন হতে হতো না। বিক্রেতা স্বয়ং ঠিকাদারের নিকট হাজির হলেই ন্যায্যমূল্যে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে পারতো। এতে এলাকায় ঠিকাদারের সম্পত্তির পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সেই পাকিস্তানি আমলে রিক্শাযাত্রী ঠিকাদার-পরিবার রিক্শার পরিবর্তে মাজদা গাড়ি হাঁকায়। অর্থ-বিত্ত, সম্পত্তি বৃদ্ধিতেও কিন্তু সামাজিক মর্যাদা তাদের বৃদ্ধি পায়নি। বরং কয়লা চোরের নামকরণে তাদের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারে মসজিদ-মাদ্রাসায় অঢেল অর্থ প্রদান করে সমাজে নিজেকে মর্যাদাবান রূপে প্রতিষ্ঠার কৌশলী উদ্যোগ ঠিকাদার গ্রহণ করেছিল। এই কৌশলটি তার অপবাদ ঘুচাতে সহায়তা করেছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে না হলেও নেপথ্যে ঠিকাদারের কুখ্যাতির গুঞ্জন কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি ঘটেনি। সেটা বহুকাল টিকে ছিল।

টাকার রঙ নিয়ে সমাজে এখন আর উচ্চ-বাচ্য কেউ করে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করা হয় মাত্র। শর্তাধীনে সে ক্ষেত্রে পরিত্রাণের সুযোগও করে দেয় স্বয়ং রাষ্ট্রই। আয় বহির্ভূত অর্থকে আয়ভুক্ত বা বৈধতা প্রদান করার সুযোগ দেয়া হয়, রাষ্ট্রকে অর্থদণ্ড প্রদানে। অর্থাৎ কালো টাকাকে সাদায় রূপান্তরিত করার রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক (!) ব্যবস্থাধীনে। তাই এখন টাকার পরিমাণগত রঙই টাকার পার্থক্য নির্ধারণ করে, সাদা-কালোর বিভাজনে নয়। টাকা এখন টাকাই, সে যে উপায়ে অর্জিত হোক না কেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভে বাধাপ্রাপ্ত হয় না। ঘৃণা-ধিক্কারের যোগ্যও থাকে না, বিপরীতে পায় নিষ্কণ্টক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি। এতে করেই সমাজে ও রাষ্ট্রে অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয় কে কত বেশি অনৈতিক পন্থা গ্রহণে অর্থশালী হতে পেরেছে। আমাদের রাষ্ট্রের তথাকথিত সেবকগণ এবং রাজনীতিকরা ওই একই পথের যাত্রী হিসেবে জনগণের উপার্জিত অর্থ হাতিয়ে বিত্তশালী হচ্ছে, বিদেশে অর্থ পাচার করে চলেছে। যতদিন জনগণের সরকার দেশে প্রতিষ্ঠা না পাবে; ততোদিন এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া থামবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

ভারতে সত্তরোর্ধ্বদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা : বাংলাদেশ কি ভাবছে?



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সত্তরোর্ধ্ব বয়স্ক নাগরিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। গত বৃহস্পতিবার দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এই ঘোষণা দেন। আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের অধীনে বিনামূল্যে এই চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে বলে জানান দেশটির রাষ্ট্রপতি।

পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মুর্মু আরও বলেন, আয়ুষ্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা প্রকল্পের অধীনে ৫৫ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে দেশে ২৫০০০টি জন ঔষুধী কেন্দ্র খোলার কাজও দ্রুত গতিতে চলছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাবলিক অর্থায়িত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পটির অধীনে দরিদ্র পরিবারগুলো ৫ লাখ পর্যন্ত রুপি বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য দেয়া হচ্ছে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্যও খবরটি বিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে। আমরা জানি যে, কোন দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের একটি অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে সেই দেশের জনগণের সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। সুনির্দিষ্ট কিছু রোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্য এসেছে, মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। কিন্তু সার্বজনীন স্বাস্থসেবা নিশ্চিতে বাংলাদেশ এখনো মাইলকফলক স্পর্শ করতে পারেনি, এটিও বিবেচনায় নিতে হবে। যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা ৬৯ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় নিজেরাই নির্বাহ করেন। গবেষণা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দরিদ্র পরিবারগুলো অনেক সময় তাদের শেষ সহায়-সম্বল ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু অনেক সময়- সব বেঁচেও তারা তাদের স্বজনদের সুস্থ করে তুলতে পারেন না। উল্টো ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে শহরের অলি-গলি বা বস্তিতে ঠাই নেন। খোঁজ নিলে এমন দৃষ্টান্ত অজস্র দেয়া যাবে। গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর তথ্য বলছে, নিতান্তই অপারগ হয়ে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে ধারদেনা, ফসলি জমি বা ভিটেমাটি বিক্রি বা বন্ধক রাখেন শতকরা ৫৮ ভাগ মানুষ। এই সংখ্যাকে উদ্বেগজনক বললেও অত্যুক্তি হবে।

প্রায় দেড়শ’ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে স্বাস্থ্যসেবায় নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যয় ৬৩ শতাংশ। সেক্ষেত্রে ভারতে ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশের জন্যও এটি অনুসরণযোগ্য বার্তা হতে পারে।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা নেওয়া নাগরিকদের একটি বড় অংশই সত্তরোর্ধ্ব। এই সংখ্যার একটি বড় অংশ আবার দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সেই বিচারে প্রবীণদের চিকিৎসাসেবায় আনুকূল্য প্রদান যেমন রাষ্ট্রের মানবিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটাবে তেমনি সার্বজননীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের যে লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের তা অর্জনেও অগ্রগতি আসবে।

সার্বজনীন চিকিৎসাসেবা প্রদানে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার রয়েছে তার জনগণের কাছে তা অর্জনে শাসকদের আন্তরিকতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আলোচিত স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার বিল নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি সে বিষয়ে অনড় ছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অবশ্য প্রেসিডেন্ট বারাব ওবামার স্বাস্থ্যসংস্কার প্রস্তাবের সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে বিদ্রুপের কিছু নেই। এ প্রস্তাবনায় মমতা আছে।’

আমরা লক্ষ্য করছি যে, সাম্প্রতিক দশক বা বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে অকাঠামো বা যোগাযোগ উন্নয়নে যে বিপুল বরাদ্দ রাখা হয়, অপরদিকে স্বাস্থ্যসেবা কিংবা শিক্ষার মত খাতগুলো সেখানে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পায়। তবে বৈশ্বিক উন্নয়ন মানদণ্ডের নিরিখে স্বাস্থ্যখাতকে উপেক্ষার সুযোগ নেই, এ কথা জোর দিয়েই বলা যাবে।

জনগণের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির যে অধিকার তা স্বীকার করে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অন্য সকল উন্নয়ন প্রাধিকারের সঙ্গে সমান গুরুত্বে স্বাস্থ্যখাতকে বিবেচনার কোন বিকল্প নেই। সরকারকে ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ৭০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের বিনামূল্যে সব ধরণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ভারতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশও।

;

রাখাইনে সংঘাত ও সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ পরিস্থিতি



ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)
ছবি: বার্তা২৪, ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

ছবি: বার্তা২৪, ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চলমান যুদ্ধের কারণে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জনপদে অনেকদিন ধরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং এলাকার জনগণ আতঙ্কে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংঘর্ষের কারণে ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ভেতরে গোলা এসে পড়ে ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে এই গোলাগুলির ঘটনা স্থলভাগ থেকে জলসীমার দিকে বিস্তৃত হচ্ছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। রাখাইন রাজ্যের এই অশান্ত পরিস্থিতি শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

আরাকান আর্মি (এএ) বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত বুথিডং শহরের দখল নিয়েছে এবং রাখাইনের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

১৭ জুন মংডু টাউনশিপের ঘাঁটিগুলো দখলে নিতে সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)। মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক উপমন্ত্রী অং কিয়াও মো জানান যে, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। মংডু শহরে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা আটকা পড়েছেন এবং সংঘাতের কারণে তারা শহর ছেড়ে যেতে পারছেন না।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে আরাকান আর্মি (এএ)-কে ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে। মংডুর অবস্থান নাফ নদীর কাছে হওয়ায় সেখানে আক্রমণে সহায়তার জন্য নাফ নদীতে যুদ্ধ জাহাজগুলো অবস্থান নিয়েছিল।

মিয়ানমার নৌবাহিনী নাফ নদীতে আরাকান আর্মি (এএ)-র উপস্থিতি এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রবেশ বন্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

মিয়ানমার নৌবাহিনীর একাধিক যুদ্ধজাহাজ সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপের কাছাকাছি মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় এবং নাফ নদীর মিয়ানমার সীমানায় অবস্থান অপারেশন পরিচালনা করছে এবং মিয়ানমারের দিকে আরাকান আর্মি (এএ)-র অবস্থান লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করছে। একইসঙ্গে আরাকান আর্মিও (এএ) মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ ও বোট লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করে।

চলমান পরিস্থিতিতে, ৫ জুন সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপ থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রলারে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে গুলি করা হয়। এতে ট্রলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ অবশ্য হতাহত হননি।

এরপর পণ্যবাহী ট্রলারেও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পর পর কয়েকদিন এই ধরনের ঘটনার কারণে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ ১০ দিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকায় টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে যাতায়াত, যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে সেখান বসবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতাসহ খাদ্য সংকটে পড়েন।

মিয়ারমার থেকে গোলাগুলির কারণে জেলেদের সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপে অনেক দিন ধরে নিয়মিত খাদ্যপণ্য সরবরাহ না থাকায় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়। সংকটে থাকা দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য ১৪ জুন কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে জাহাজে করে মালামাল পৌঁছে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের নৌযানগুলিতে কারা গুলি করেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মিয়ানমার সরকার গুলি করার ব্যাপারটি অস্বীকার করেছে। এই ঘটনায় আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরস্পরকে দায়ী করে।

টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে চলাচল করা বাংলাদেশের নৌযানগুলিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু করে এই গুলির ঘটনা ঘটে যে, আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই এসব করা হচ্ছে, তা বোঝাই যাচ্ছে।

সে সময় নাফ নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজ অবস্থান করছিল। ১৫ জুন নাফ নদীর মিয়ানমার অংশ থেকে যুদ্ধজাহাজগুলো গভীর সাগরের দিকে সরে যায় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী বাংলাদেশ জলসীমায় টহল শুরু করে। মিয়ানমার থেকে গুলি ছোড়ার পর কয়েকদিন সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে পণ্য সরবরাহে বাধার সৃষ্টি হলেও এখন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

বাংলাদেশের পর্যটনের আকর্ষণীয় স্থান সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপ

বাংলাদেশের পর্যটনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় এ দ্বীপটি অবস্থিত।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ এবং এর আয়তন ১ হাজার ৯শ ৭৭ একর। সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে চলাচলের সময় বাংলাদেশের নৌযানে গুলির ঘটনায় মিডিয়া বেশ সরব হয়েছে। চলমান ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর ফলে আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী উভয়েই গুরুত্ব পেয়েছে। এতে বেশি লাভ হয়েছে আরাকান আর্মির (এএ)। তারা সংবাদমাধ্যমের ফোকাসে আসতে পেরেছে।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপের নিরাপত্তা
এই ঘটনার পর সেন্টমার্টিন’স দ্বীপবাসী খাদ্য সমস্যা ও আতঙ্কে ভুগছেন; পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে গেছে। একটি শ্রেণি সেন্টমার্টিন’স দ্বীপের নিরাপত্তা নিয়ে নানান ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে।বাংলাদেশের নৌযান লক্ষ করে মিয়ানমারের দিক থেকে চালানো গুলির ঘটনায় সেন্টমার্টিন’স দ্বীপে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সমস্যা ও ভয় এখনও পুরোপুরি কাটেনি।

মিয়ানমারের দিক থেকে যেকোনো পক্ষের আক্রমণ প্রতিহত এবং এর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের কথা বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তে চলা সহিংসতার দিকে নজর রাখছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড। এ বিষয়ে সজাগ রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। এ ব্যাপারে তারা প্রস্তুত রয়েছে এবং পরিস্থিতি খারাপ হলে যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

১৬ জুন (২০২৪) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, মিয়ানমারে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এএ)-র বিরুদ্ধে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করছে।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি (এএ)-র এই সংঘর্ষের কারণে নাফ নদী ও নদীসংলগ্ন মোহনা এলাকায় বাংলাদেশি বোটের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ১২ জুন প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশ তার ভূমির অখণ্ডতা রক্ষায় সবসময় প্রস্তুত এবং আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। বাংলাদেশ মিয়ানমারের যেকোনো পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নৌযানের দিকে গুলি করলে পাল্টা গুলি ছোড়ার কথা জানানো হয়েছে।

মিয়ানমারের গোলা সেন্টমার্টিন’স দ্বীপে পড়ার বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সংঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ আক্রান্ত হলে সেই আক্রমণের জবাব দিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত।

বাংলাদেশ সীমান্তে বর্ডার গার্ড ও কোস্ট গার্ড আছে। তারা পুরো সীমান্ত এলাকায় তদারকি করছে ও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। শুধু সেনাবাহিনীই নয়, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও প্রস্তুত রয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে কোস্ট গার্ড ও বিজিবি তাদের দায়িত্ব পালন করছে এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপের কাছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা যুদ্ধ জাহাজ সব সময় স্ট্যান্ডবাই থাকে। বিজিবি, নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ড ও সেখানে নিয়মিত টহল দেয়। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে যাতে সীমান্তে কোনো বাংলাদেশি আক্রান্ত না হন, সেজন্য দেশটির সরকার ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা হয়েছে বলেও জানান বিজিবি মহাপরিচালক।

বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি (এএ)-র মধ্যে সংঘটিত লড়াইয়ের সময় দুই পক্ষের গোলাগুলি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়ে এবং সীমান্তবর্তী জনগণের জন্য অনিরাপদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা কখনোই কাম্য নয়।

আরাকান আর্মি (এএ)-র আক্রমণে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের বেশকিছু সেনা ও সীমান্তরক্ষী সদস্য পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন মেনে আশ্রয় নেওয়া সব সদস্যকে মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করে।

চলমান সংঘাতে মিয়ানমারে সেনাশাসন বহাল থাকলেও সামনের দিনগুলোতে রাখাইন রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আরাকান আর্মি (এএ) তাদের অবস্থান ধরে রাখবে। রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এখনো চলছে। সম্প্রতি, বুথিডং ও মংডুতে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কাজের জন্য আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরস্পরকে দোষারোপ করলেও এটা যে আরাকান আর্মি (এএ)-ই করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের প্রত্যাশা
মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি হোক, এটা-ই চায়। চলমান পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি (এএ) সংগঠিত এবং রাখাইনে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

চলমান গৃহযুদ্ধ শেষে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো চুক্তি করলেও আরাকান আর্মি (এএ)-র সহযোগিতা ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নাও হতে পারে।

এই সংকট সমাধানে সংশ্লিষ্ট সবার অনানুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মি (এএ)-র সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আরাকান আর্মি (এএ) নিজেদেরকে জান্তা সরকারের চাইতে রোহিঙ্গাদের প্রতি নমনীয় বলে প্রচার করে এসেছে, এটা তাদের প্রমাণ করার এখনই সময়। তবে রোহিঙ্গারা চলমান পরিস্থিতিতে তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি (এএ)-র মধ্যকার চলমান সংঘর্ষে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে আছে। রোহিঙ্গারা যেন আরাকান আর্মি (এএ)-র বিপক্ষে কোনো দলে যোগ দিতে না পারে, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

কৌশলগত প্রাধান্যে সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ
বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরকে ঘিরে কৌশলগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বীপ।

সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা দরকার বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

আরাকান আর্মি (এএ)-কে মোকাবিলায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ ও তার সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। আরাকান আর্মিও (এএ) মিয়ানমারের দিক থেকে গুলি করেছে। এই গুলি বিনিময়ের ঘটনা সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ দখল করার জন্য নয় বরং বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা এ কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার কিংবা আরাকান আর্মি (এএ)-র জন্য সেন্টমার্টিন’স দ্বীপ দখলের চেয়ে রাখাইন রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের দখলকৃত ভূমি সুরক্ষা ও সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই জরুরি। তবে বাংলাদেশকে প্রতিবেশী এই দেশের এ অশান্ত পরিস্থিতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে!

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফ ডব্লিউসি, পিএস সি, এম ফিল (অব.), মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক

;

এরভিং গফম্যানের তত্ত্ব ও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪, মো. বজলুর রশিদ

ছবি: বার্তা২৪, মো. বজলুর রশিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এরভিং গফম্যান ছিলেন একজন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, যিনি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে কাজ করেছেন।

তার সবচেয়ে বিখ্যাত তত্ত্ব হলো ড্রামাটার্জি বা নাটকীয় উপস্থাপনা তত্ত্ব, যা তিনি তার বই দ্য প্রেজেন্টেশন অব সেলফ ইন এভরি ডে লাইফ-এ বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।

গফম্যানের মতে, সামাজিক জীবন একটি নাটকের মঞ্চের মতো। প্রত্যেক ব্যক্তি একজন অভিনেতা এবং সমাজ একটি মঞ্চ। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং এই পরিস্থিতিগুলোতে তারা বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন।

গফম্যান এই তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে মানুষ তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করেন। ড্রামাটার্জি'র মূল ধারণাটি হলো- সামাজিক উপস্থাপনা

এরভিং গফম্যানের 'ড্রামাটার্জি' তত্ত্বে মূল ধারণাটি হলো- সামাজিক উপস্থাপনা



একজন ব্যক্তি কীভাবে তার পরিচয় এবং ব্যক্তিত্ব অন্যদের কাছে উপস্থাপন করেন, সেটাই গফম্যানের মূল আলোচনার বিষয়। তিনি বলেন, যখন মানুষ অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া (Interaction) করেন, তখন তারা দুটি প্রধান এলাকায় থাকেন- সামনের মঞ্চ (front stage) এবং পেছনের মঞ্চ (back stage)।

সামনের মঞ্চে, মানুষ তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন করেন এবং তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্বকে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করেন। এখানে তারা তাদের সেরা দিকগুলো প্রদর্শন করেন এবং একটি নির্দিষ্ট ইমেজ বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। পেছনের মঞ্চে, মানুষ তাদের আসল সত্তা প্রকাশ করেন এবং তাদের আসল ‘ব্যক্তিত্ব’ দেখা যায়। এখানে তারা আরেকটু স্বাভাবিক এবং অপ্রতিষ্ঠিতভাবে আচরণ করেন।

গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং মানব আচরণের অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার কাজ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষ নিজেদের উপস্থাপন করেন এবং কীভাবে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার (Social Interaction) মাধ্যমে তাদের পরিচয় গঠন করেন।

এরভিং গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব এবং সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তার তত্ত্বটি আজকের ডিজিটাল যুগেও কতটা প্রাসঙ্গিক! সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম, যেমন- ‘ফেসবুক’, ‘ইনস্টাগ্রাম’, ‘টুইটার’ (এক্স) এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম আধুনিক সমাজে মানুষের আচরণ এবং নিজস্ব পরিচয়ের উপস্থাপনা নিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্বের প্রধান ধারণা হলো- সামাজিক জীবনে মানুষ নিজেকে এক ধরনের অভিনয়শিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করেন। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে এই উপস্থাপনাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সামনের মঞ্চ
বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে, ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইল তৈরি করেন, ছবি পোস্ট করেন, স্ট্যাটাস আপডেট করেন এবং বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার করেন। এই সবকিছুই গফম্যানের ‘সামনের মঞ্চ’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে মানুষ তাদের সেরা দিকগুলো তুলে ধরেন এবং একটি নির্দিষ্ট ইমেজ বজায় রাখার চেষ্টা করেন।

সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ নিজেদের জীবনের সুখকর মুহূর্তগুলো বেশি শেয়ার করেন, যা তাদের পরিচয়ের একটি পছন্দনীয় এবং আকর্ষণীয় দিক প্রকাশ করে। তারা বিভিন্ন ফিল্টার এবং এডিটিং টুল ব্যবহার করে নিজেদের ছবি এবং ভিডিওগুলো আরো সুন্দর করে তোলেন, যা বাস্তব জীবনের চেয়ে কিছুটা আলাদা হতে পারে। এইভাবে, তারা একটি নিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত পরিচয় উপস্থাপন করেন, যা তাদের অনুসারী এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়।

পেছনের মঞ্চ
গফম্যানের পেছনের মঞ্চ ধারণাও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক। অনেক সময় মানুষ তাদের প্রাইভেট মেসেজিং (ব্যক্তিগত বার্তা) বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ব্যক্তিগত চ্যাটের মাধ্যমে তাদের আসল চিন্তা এবং অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন। এখানে তারা আরেকটু স্বাভাবিক এবং কম নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকেন, যেটি পেছনের মঞ্চের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

অভিনয় ও আত্মপ্রতারণা
ড্রামাটার্জি তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘অভিনয়’ এবং ‘আত্মপ্রতারণা’। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ অনেক সময় নিজেদের জীবনকে অন্যদের চোখে আরো আকর্ষণীয় এবং সফল দেখানোর চেষ্টা করেন, যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নাও থাকতে পারে। তারা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক ইমেজ বজায় রাখতে চেষ্টা করেন, যা অনেক সময় তাদের আসল অবস্থার চেয়ে ভিন্ন হতে পারে।

গফম্যানের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা
সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে গফম্যানের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা আমাদেরকে এই ডিজিটাল যুগে ‘মানব আচরণ’ এবং ‘সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা’ বুঝতে সাহায্য করে। এটি বোঝায় যে, মানুষ কীভাবে তাদের অনলাইন উপস্থিতি তৈরি করেন এবং কীভাবে তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের পরিচয় এবং ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করেন।

ড্রামাটার্জি তত্ত্বের সমালোচনা
এরভিং গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হলেও এর কিছু সমালোচনাও রয়েছে। সমালোচকেরা বিভিন্ন দিক থেকে এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা এবং অস্পষ্ট দিকগুলো তুলে ধরেছেন।

প্রথমত, গফম্যানের তত্ত্বটি অতিরিক্তভাবে পারফরম্যান্স বা অভিনয়-কেন্দ্রিক। এটি মানুষের প্রতিদিনের ‘জীবনের জটিলতা’ এবং ‘গভীরতা’কে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হতে পারে। সামাজিক জীবনকে শুধুমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কারণ, মানুষের আচরণ এবং ব্যক্তিত্ব অনেক বেশি জটিল এবং বহুমুখী। এছাড়া, প্রত্যেক ব্যক্তি সর্বদা সচেতনভাবে তাদের আচরণ এবং পরিচয় পরিচালনা করেন না। অনেক সময় মানুষ ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ ও ‘অসচেতনভাবে’ কাজ করেন, যা গফম্যানের তত্ত্বে পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায় না।

দ্বিতীয়ত, গফম্যানের তত্ত্বে সামাজিক কাঠামো এবং ক্ষমতা সম্পর্কের বিশ্লেষণ কিছুটা অনুপস্থিত। এটি সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলিকে পর্যাপ্তভাবে বিবেচনা করে না, যা মানুষের আচরণ এবং পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে, এই বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যেখানে ক্ষমতা এবং সামাজিক কাঠামো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

তৃতীয়ত, গফম্যানের তত্ত্বে সাধারণ মানুষের জীবনের সাধারণ বিষয়গুলো অবহেলিত হতে পারে। তিনি প্রধানত ‘নাটকীয়’ এবং ‘বিশেষ পরিস্থিতিগুলো’ নিয়ে কাজ করেছেন, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বিষয়গুলোকে প্রতিফলিত করে না।

চতুর্থত, এই তত্ত্বটি আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল যুগের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই নয়। যদিও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের প্রেক্ষিতে ‘ড্রামাটার্জি’ তত্ত্ব অনেকাংশে প্রাসঙ্গিক, তবে আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়।

গফম্যানের তত্ত্ব ‘সমাজবিজ্ঞান’ এবং ‘মানব আচরণ’-এর অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে এর সীমাবদ্ধতা এবং সমালোচনাগুলোও বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা ‘মানুষের আচরণ’ এবং ‘সামাজিক মিথস্ক্রিয়া’ সম্পর্কে আরো গভীর এবং সুসঙ্গত ধারণা পেতে পারি।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

;

দুর্নীতি: একালের ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড সমাচার



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে দুর্নীতি বন্ধে 'বিশেষ কমিশন' গঠন এবং ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিচারে 'ট্রাইব্যুনাল গঠন' করার দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার মতে, 'দুর্নীতির এই মচ্ছব বন্ধ করতে এখনই বিশেষ কমিশন গঠন করুন, দুর্নীতিবাজদের অর্থ সম্পদ বাজেয়াপ্ত, বিচার করে কঠিনতম শাস্তি দিন। ঋণখেলাপী অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন।'

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সরকারের আরেক অন্যতম শরিক ১৪ দল জোটভুক্ত গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন বলেন, 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের নীতিগত অবস্থান সব সময়ই সোচ্চার ও সুস্পষ্ট।' বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিরোধী দল বা সরকার-সমর্থক থেকে শুরু করে আমজনতার দরবার পর্যন্ত 'দুর্নীতি' সর্বাধিক আলোচিত ও ধিকৃত বিষয়। এ কথা এখন আর কারো পক্ষেই অস্বীকার করার উপায় নাই যে, সাবেক পুলিশ প্রধান ও সেনা প্রধানের দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র চূড়া মাত্র, যার সূত্রে বহু ঊর্ধ্বতন সরকারি পদাধিকারীর হাজার কোটি টাকার সম্পদের গোপন জগৎ উন্মোচিত হচ্ছে। এমনকি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিদায়ী বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ পেশাজীবনের শেষপ্রান্তে এসে সবিস্ময়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি, এমনকি শতকোটি টাকার মালিক হন?

সন্দেহ নেই, লাগামহীন দুর্নীতির ঘটনাগুলো দেশবাসীকে হতবাক করেছে। যে কারণে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আট সদস্যের আপিল বেঞ্চের বিদায়ী বক্তব্যে বিচারপতি হাফিজ বলেন, দুর্নীতি আমাদের সব অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা অনেক। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাত থেকে অফিস-আদালতকে মুক্ত রাখতে হবে। রাষ্ট্রকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। তাহলে দেশ উপকৃত হবে। মানুষ অযাচিত বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।

বাংলাদেশের 'দুর্নীতি' দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও আলোচিত বিষয়। মালয়েশিয়ায় 'সেকেন্ড হোম', কানাডায় 'বেগমপাড়া', দুবাই-আবুধাবিতে 'মল-মার্কেট' নিয়ে কথা হলেই বাংলাদেশের দুর্নীতির সূত্র সামনে চলে আসে। দুর্নীতির মাত্রা কোন দেশে কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রতিবছর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই), তাতেও বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান। বিগত ২০২৩ সালের জন্য দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। সেই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই এবং যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে, সেসব দেশের চেয়েও বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বেশি।

ফলে দুর্নীতি যে হচ্ছে, তা আড়াল করা অসম্ভব। বরং এখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিল সমাধি হবে। দুর্নীতিবাজরা সাধুর ছদ্মাবরণে দেশের সম্পদ লুটে নিতে থাকবে। এমনকি, তাদের সন্তানরা লাখ লাখ টাকার গরু-ছাগলের ঘটনা ঘটাবে। কন্যারা কোটি টাকার গাড়ির ফুটানি মারবে। স্ত্রীগণ ডুপ্লেক্স বাড়ি ও রিসোর্টের মালিক বনে যাবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা এখানে দেখলাম পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিকদের ধমক দেওয়া হয়েছে। অনেক মন্ত্রী এ তথ্যকে অনুমান ভিত্তিক বলে অভিহিত করছেন। এগুলো করে সত্য গোপনের চেষ্টা চালালেও প্রকৃত চিত্র ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। মার্কিন ফিনানশিয়াল ইনটিগ্রেটি ইনস্টিটিউশন দেখিয়েছে যে, বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে কানাডার বেগম পাড়ায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের আধুনিক শপিংমল, রিয়েল এস্টেট ও হুন্ডি ব্যবসায়। এই টাকার লভ্যাংশও দেশে আসছে না। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নাই। অথচ প্রবাসীরা বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনীর যে আয় দেশে পাঠায় তার ওপর কর বসানো হচ্ছে। তাদের বিদেশ যাত্রা নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

পরিস্থিতি কতটুকু মারাত্মক হলে স্বয়ং সরকার সমর্থক হয়েও মেনন পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন, 'এই অর্থ সম্পদ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত না দেওয়া, ব্যাংক লুট ও দুর্নীতি। ২০০৯ সালে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার এমন ঋণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। পুণঃতফসিলীকরণ ও অবলোপন ধরলে এর পরিমাণ ৪ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকা দাঁড়াবে। তিনি বলেন, 'ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে "ব্যাংক কমিশন" গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত। পরের অর্থমন্ত্রী তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর এখন ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তুঘলকি কাণ্ড করছে।'

একই কথা বলা যায় কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে। দেখা যাচ্ছে, ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটের টাকাকে যখন সাদা করার জন্য সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের চেয়ে অর্ধেক কর দিয়ে সাদা করার প্রস্তাব করা হয় তখন সেটা সততার জন্য তিরস্কার ও অসততার জন্য পুরস্কারের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে তা কেবল অসাড়ই নয়, সরকারের অতীত অবস্থানের বিপরীত।

দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের ছাপ আজিজ, বেনজির, ছাগলকাণ্ড ছাড়াও সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম খুনের ঘটনায় দৃশ্যমান, যাতে এই দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ—মাদক চোরাচালানি ও অপরাধ জগতের চিত্র বেরিয়ে আসছে। আগেই রাজনীতি ও সংসদে ব্যবসায়ীদের দাপট বেড়েছিল। এবার অপরাধের প্রসঙ্গও যুক্ত হওয়ায় রাজনীতি আরো কোণঠাসা হয়েছে ও দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সংসদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এসব বিষয় গভীরভাবে খতিয়ে দেখা ও আত্মসমালোচনা হওয়া দরকার।

অনেকেই বিশ্বাস করেন, নিষ্ঠুর অলিগার্করা দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই অলিগার্কির স্বার্থ রক্ষার্থে মূল্যস্ফিতি কমিয়ে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংকিং খাতে লুট ও নৈরাজ্য, খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত করেছে। এর থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার, জন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল বর্তমান সময়ের জরুরি কর্তব্য। বাজার সিন্ডিকেট আগের মতো খেলা করছে। মানুষকে তার শিকারে পরিণত করছে। সরকার স্বীকার করছে সিন্ডিকেট রয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো উদ্যোগ নেই।

অতীতেও বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচ পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ হয়েছে। অর্থনীতিবিদগণ সব সময়ই বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই আমাদের প্রবৃদ্ধি আড়াই ভাগ বৃদ্ধি পেত। অতীত আমলের দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে আমাদের সেই কলঙ্ক কিছুটা দূর হলেও ওই সূচকে বাংলাদেশ এখনও শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। বরং সরকারি পদ-পদবী ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির যে চিত্র সম্প্রতি বেরিয়ে আসছে তা দেশের ভাবমূর্তি কেবল নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে হতাশা এবং সার্বিকভাবে জনমনে অনাস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।

এহেন মাত্রাছাড়া দুর্নীতির আর্থ-সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক কারণ থাকলেও এর মনস্তাত্ত্বিক কারণটি মোটেও অবজ্ঞা করার মতো নয়। মন ও মানসিকতার দিক থেকে চরম অসৎ, অসুস্থ ও বিকৃত হলেই কেবল একজন মানুষ মাতাল মহিষের মতো অর্থ ও সম্পদের পিছনে ছুটতে পারে। তার প্রয়োজনের চেয়ে হাজার গুণ বেশি সম্পদ কামানোর জন্য অবৈধ পথে পাগলের মতো আচরণ করতে পারে। অতএব, তাদের অপরাধবৃত্তি ও দুর্নীতিপরায়নতার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনের স্বার্থে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া দরকার। এতে সাদা ও সাধু সেজে লুটপাট ও দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়া কালো বিড়ালদের শনাক্তকরণ সহজ হবে এবং আইনের আওতায় আনাও সম্ভব হবে।

এক্ষেত্র একটি উপন্যাস স্মরণযোগ্য, যার শিরোনাম 'স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড'। উপন্যাসটি হল স্কটিশ লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন রচিত রহস্য আখ্যান। এটি ১৮৮৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। লন্ডনের আইনজীবী গ্যাব্রিয়েল জন আটারসন তার পুরনো বন্ধু ডক্টর হেনরি জেকিল ও তার অশুভ সত্তা এডওয়ার্ড হাইডের মধ্যকার অদ্ভুত ঘটনাবলির তদন্ত এই উপন্যাসিকার উপজীব্য বিষয়। উপন্যাসিকাটির প্রভাব এতটাই যে এটি ইংরেজি ভাষার অংশ হয়ে ওঠে, এবং "জেকিল অ্যান্ড হাইড" শব্দগুচ্ছ দিয়ে এমন কোন ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যার দ্বৈত সত্তা রয়েছে, সাধারণত খুব ভালো কিন্তু মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত রকমের মন্দ।

কাহিনীতে রয়েছে, ডাক্তার জেকিল নিজের ব্যবহারের জন্য একটি ঔষধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন যেটি ব্যবহার করলে তিনি বিপরীত চরিত্রের একজন মানুষে পরিণত হয়ে যাবেন অর্থাৎ তার মনের যেসব খারাপ দোষ রয়েছে সেগুলো মুখ্য হয়ে উঠবে এবং তিনি সেভাবেই ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবেন। আবার আর একটি ঔষধ প্রয়োগ করে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে পারবেন। এভাবেই ডাক্তার তার মধ্যকার ভালো এবং মন্দ এই দুটো স্বভাবকে নিয়ে একই দেহের ভিতর দুটি মানুষকে লালন পালন করতে শুরু করলেন। তিনি খারাপ মানুষটির নাম দিলেন মিস্টার হাইড। এই রকম ভাবে তিনি দিনের বেলায় ডক্টর জেকিল এবং রাতে মিস্টার হাইড হয়ে জীবন যাপন করতে থাকেন।

এক সময় এমন পরিস্থিতি হলো যে তিনি না চাইলেও মিস্টার হাইডে রূপান্তরিত হতে লাগলেন। দেখা গেলো যে তার দ্বিতীয় ঔষধ যা প্রয়োগ করে তিনি মিস্টার হাইড থেকে ডক্টর জেকিল হতেন তা আর কাজ করছে না। ফলে তার মনুষ্যত্বের বদলে পশুত্ব স্থায়ী হতে লাগল। এরই মধ্যে মিস্টার হাইড খুন করে বসলেন এক লোককে। তার মধ্যেকার আত্মগ্লানি থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যা করলেন আসল ব্যক্তি ডক্টর জেকিল।

আমাদের দুর্নীতিবাজগণ প্রকাশ্যে ভালো মানুষ ডক্টর জেকিল আর গোপনে বা তলে তলে মিস্টার হাইড। সবাই তাকে ভালো মানুষ ও উচ্চ মর্যাদার লোক মনে করলেও নীতি, নৈতিকতা ও আচরণের দিক থেকে তার বা তাদের মধ্যে বাস করে এক বর্বর পশু। গৃহস্থের একদিন যখন সত্যি সত্যিই আসে, তখন চোর ব্যাটা ধরা পড়ে। বাংলাদেশে ধৃতর চেয়ে অধরা দুর্নীতিবাজ অনেক বেশি। যারা অবলীলায় উপরের পদে বসে বড় বড় কথা বলে দেশের পকেট কাটছে। জনগণের ভাগ্য ও সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

মন বিশারদগণ বলেছেন, মানুষের রিপুগুলো আসলেই খুব বিচিত্র, শক্তিশালী ও সক্রিয়, যার একদিকে লোভ, লাভ ও লালসা আর অন্য দিকে আছে সংযম ও শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তোলা মন। এই দুই বিপরীত স্বভাবের মধ্যে চলে অবিরাম যুদ্ধ। অশুভ শক্তিকে দমিয়ে রাখাটাই সভ্যতার মাপকাঠি। যে নেতা, ব্যক্তি, সমাজ, শাসক, প্রতিষ্ঠান যত বেশি সংযমের পরিচয় বহন করে, সে বা তারা তত সভ্য।

কিন্তু দুর্নীতি ও স্তাবকতা সভ্য জগৎকে অন্ধকারে ঢেকে রাখতে সদা-উদ্ধত। এরা নিজের স্বার্থে ও ধান্ধায় শাসকের আনুগত্য দেখায়, মানুষকে মূল্যবোধের কথা বলে। বাস্তবে এর কিছুই তারা বিশ্বাস করে না ও প্রতিপালনও করে না। এরা একটি সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আর্থিক কাঠামো, নৈতিক মানদণ্ড, সুরুচি ও সভ্যতাকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় বিপদের বার্তা।

অতএব, সমাজ, প্রশাসন ও পেশার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভেক ধরে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হওয়া ও নীতি-নৈতিকতার লালবাতি জ্বালানো একালের 'ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড'দের থেকে সাবধান!

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; চেয়ারম্যান ও প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;