উন্নয়ন বৈষম্যের কারণেই কি রাসেলস ভাইপার নিজ বসতি হারাল?

, যুক্তিতর্ক

মো. শহিদুল ইসলাম | 2024-07-05 19:08:18

বাংলাদেশে নানা উৎপাত আর সহিংসতার খবরের মধ্যে চলমান সময়ে আরেকটি খবর যুক্ত হয়েছে। তা হলো চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার। রাসেলস ভাইপারকে কেন্দ্র করেই সাপ নিধনে কিছু মানুষের মধ্যে উৎসাহ দেখা দিয়েছে। যা খুবই হতাশাজনক।

সাপ প্রকৃতির বন্ধু, মানুষেরও বন্ধু। প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যময় নানা প্রাণের মধ্যে সাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি। আঞ্চলিক বা ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথিবীতে নানা বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, জাতি, পেশা এবং প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহার গড়ে উঠেছে। প্রতিটি স্থানই একেকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে। যদি সারা পৃথিবীর মাটি, বৃক্ষ, লতা-পাতা, ফসল বৈচিত্র্য, মানুষের আহার, চলন-বলন আবহাওয়া বৈচিত্র্য একরকম হতো তাহলে প্রাণবৈচিত্র্যও হয়তো একই রকম হতো। ভিন্নতা আছে বলেই লোনা পানিতে ইলিশ আর মিঠা পানিতে শিং মাগুর মাছ জন্মে। ভিন্নতা আছে বলেই উঁচু-নিচু মাটি, টিলার প্রাণবৈচিত্র্য আর সমতলের প্রাণবৈচিত্র্যের ধরনও আলাদা।

প্রতিটি ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের রয়েছে আলাদা স্বাধীনতা, আলাদা স্বকীয়তা। আর সেই স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতার বদৌলতে প্রাণগুলো গড়ে তুলে তাদের বাসস্থান ও নিজস্ব সার্বভৌমত্ব। এমন একটি পরিবেশে শুধু একটি নয়, সেই পরিবেশে নানা প্রাণবৈচিত্র্য যা দেখা-অদেখা মিলে একটি বাস্তুতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব গড়ে তোলে। বিভিন্ন প্রাণসমষ্টি পরস্পরের সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে। এই পারিপার্শ্বিক জীবনধারার সার্বভৌমত্বে যখন আঘাত আসে, তখনই কোন প্রাণি হয়তো একেবারে শেষ হয় (বিলুপ্তি), আগ্রাসী হয় নতুবা শেষ করতে বা টিকিয়ে থাকতে নেয় প্রতিহিংসামূলক পন্থা। তৈরি হয় নানামুখী সহিংসতার পরিবেশ।

চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপটিও একটি সার্বভৌমত্বের দাবিদার নিয়ে বেঁচে থাকার কথা। এটি খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। থাকতে পারেনি। নিজস্ব বাসস্থান হারিয়ে চন্দ্রবোড়া নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আজ প্রায় সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু চন্দ্রবোড়া নয় এরকম কতো প্রাণই তার বাস্তুতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব হারিয়ে নিঃস্ব, বিলুপ্ত প্রায় এবং এর কারণেই সহিংসতা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। উন্নয়ন বৈষম্যে যেমন মানুষ ভুক্তভোগী তেমনি আজ সকল প্রাণিকুলও নিঃস্ব, বিপদগ্রস্ত, সহিংস রূপ ধারণ করছে।

ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে ভারতবর্ষের সন্নিহিত জনপদগুলোর মধ্যে বরেন্দ্র ভূমি একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অঞ্চল। যার বিস্তার বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সম্পূর্ণ উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলার অধিকাংশ এলাকাজুড়ে। ভারত এবং বাংলাদেশ মিলে যার মোট এলাকা প্রায় ১০০০০ বর্গকিলোমিটার এবং এটি একটি পুরাতন পলি সংবলিত আদিভূমি হিসেবে পরিচিত। আবহাওয়া, জলবায়ু এবং মাটির ধরণ ও সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রেই এই অঞ্চলটির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। প্রাকৃতিক লীলাভূমি এবং ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত, লাল মাটির উঁচু-নিচু বিস্তীর্ণ মাঠ আর খাল খাড়ি, নদী-নালা, প্রাকৃতিক জলাধারের বৈশিষ্ট্যে ভরপুর ছিলো এই বরেন্দ্র অঞ্চল। যেখানে নানা প্রাণের বৈচিত্র্য আর আন্তঃসম্পর্কের ভিত ছিল অটুট। কিন্তু দিনে দিনে নানামুখী উন্নয়ন বৈষম্যের কারণে বৈচিত্র্যতা আর সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্টি করছে সংকট, ঘাত-প্রতিঘাত। এ জন্যেই বর্তমান সময়ে মানুষ হচ্ছে আদিকাল থেকে বসবাস করা চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) বা অন্যান্য প্রাণের শত্রু আবার সঙ্গতকারণেই চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) সাপও হচ্ছে মানুষের শত্রু।

সাপ মানুষকে কামড় দিয়ে মেরে ফেলছে আবার প্রতিদিন সাপকেও মানুষ মেরে ফেলছে। প্রকৃতির আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রতি বাধা সৃষ্টি করাতে, মানুষই ডেকে আনছে এই সংকট। আজ থেকে এক দশক আগেও এই চন্দ্রবোড়া এবং মানুষের সংকট ছিল শুধু বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মধ্যে। এখন এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলাদেশে।

২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণি জ্ঞানকোষে এই চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপকে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন এবং বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। কিন্তু কী এমন হলো যে এই মহাবিপন্ন প্রাণিটি ছড়িয়ে পড়ল প্রায় গোটা দেশেই।

এর জন্য আঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য দায়ী নয়তো? আমরা কেন সেই দিকটি সামনে নিয়ে আসছি না? আমরা কেন আমাদের আসল সত্যকে লুকিয়ে রেখে আগামীতে আরও মহাবিপর্যয় ডেকে আনার চেষ্টা করছি? আজ হয়তো চন্দ্রবোড়া আগামীতে হয়তো অন্যকোন বিষয় দেখা দেবে। লুকোচুরির এ খেলা বন্ধ না করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই দেশের জনসাধারণ, কৃষক এবং নিম্নগোত্রের মানুষরাই। যারা আমাদের উৎপাদনের মুল চালিকা শক্তি।

আমরা যখন বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং প্রাণবৈচিত্র্যের অনুসন্ধান করতে থাকি, তখন দেখা যায় এই চন্দ্রবোড়া অপরিচিত কোন প্রাণি নয়। এটি খুবই পরিচিত একটি প্রাণি। চন্দ্রবোড়া থাকতো চন্দ্রবোড়ার ঘরে, আর মানুষ থাকতো মানুষের ঘরে। সকলের মিলেমিশে একটা সংসার ছিল। চন্দ্রবোড়া শুকনো এলাকার সাপ, চন্দ্রবোড়া উঁচু নিচু আইল আর টিলার সাপ, চন্দ্রবোড়া গর্তে থাকতে পছন্দ করে না, আইলের নিচে থাকতে পছন্দ করে। সাপটির খাবারের পছন্দের তালিকায় ইঁদুর আর ছোট ছোট ফড়িং, পোকামাকড়। সাপটি গর্তে থাকতে পছন্দ করে না, পানিতে থাকতেও না। এই সাপ বেশি দূর আহার করতেও যায় না। নিজের এলাকার এবং গণ্ডির মধ্যেই থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু তার এই ভালোবাসার জায়গাটি যখন আমরা দখল করলাম, তার খাদ্য এবং বাসস্থানের সংকট সৃষ্টি করে তুললাম, তখনই নিজেকে রক্ষার জন্য চন্দ্রবোড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারিদিকে।

শস্য-ফসলে রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের কারণে ইঁদুর আর এখন জমিতে থাকতে পারে না। বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু নিচু টিলা আইল কেটে যখন সমান করা হলো, তখন চন্দ্রবোড়া তার বাসা হারাল। ছোট বনজঙ্গল ঝোপঝাড় সবই উজাড় করে চাষাবাদ করা শুরু হলো। নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেলো চন্দ্রবোড়া। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা প্রয়োজন যে, ইংরেজদের শাসন আমল থেকে অদ্যাবধি বরেন্দ্র অঞ্চলের (বাংলাদেশ ও ভারতসহ) যে উন্নয়নযজ্ঞ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তাতে এই অঞ্চলের ভৌগলিক, প্রাণবৈচিত্র্য এবং স্থানীয় পরিবেশকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চিকন-সরু চালের লোভে এবং নীল চাষের জন্য ইংরেজরা এই অঞ্চলে ঝোপঝাড় কেটে জমিতে কৃষকদের জোর করে চাষাবাদ করাতো। দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চলে অনৈতিক শোষণ আর জুলুমবাজ উন্নয়ন। পানি উন্নয়নের কথা বলে সেই সময় ১৯৬২ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম শিব নদের উৎসমুখ নওগাঁ জেলার মান্দার বৌদ্দিপুরে বন্ধ করে দিয়ে নদীটিকে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ইতিহাসও ভুল করে যখন উপস্থাপন হয়, তখন নতুন প্রজন্ম জানে না তার সঠিক ইতিহাস।

প্রসঙ্গত যে, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতে যখন শিব নদীকে মান্দার একটি বিল থেকে উৎপন্নের কথা বলা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ একটি ভুল তথ্য। নদীটি মূলত নওগাঁর আত্রাই নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এরকম নানা ও বহুমাত্রিক কাজের কারণে গোটা বরেন্দ্র অঞ্চল দিনে দিনে ঝুঁকি আর সংকটের দিকে এগিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আরেকটি সংকট ১৯৭৫ সালে বরেন্দ্রর বুক চিঁরে যাওয়া রক্তের শিরার মতো গঙ্গা তথা পদ্মার বুকে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি নিয়ে ভারতে বরেন্দ্র অঞ্চল অংশে, যেখানে শুকনো খরা, সেসব অঞ্চলের পানি ছড়িয়ে দিয়ে উন্নয়ন কাজ করা। অন্যদিকে ভাটিতে পানির অভাবে বাংলাদেশের নদী জলাভূমিগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং ভূ-উপরস্থ পানির উৎস কমে যাবার ফলে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল অংশে পাতাল থেকে পানি উত্তোলনের মহাপরিকল্পনা করা হয়। এই দীর্ঘ সময়ে জোর করে বা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব না দিয়ে উন্নয়ন কাজ করার ফলে ভারত কিংবা বাংলাদেশ দুই অংশে জড়িয়ে থাকা বরেন্দ্র অঞ্চলের যে আপন বৈচিত্র্য তা কমে গেছে। আর সংকটগুলো এভাবে বাড়তেই আছে। এখানে ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থানের দারুণ এক সংকট তৈরি হয়েছে। রবিশস্য বা কম পানি নির্ভর শস্য ফসল বাদে যখন অধিক ধান ফলাতে গিয়ে এখানে পাতালের পানি তুলে গোটা শুকনো বরেন্দ্র অঞ্চলকে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে। উঁচু নিচু টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। উপর্যুপরি ফসল ফলাতে দেদারছে রাসায়নিক কীটনাশকের প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক পুকুর-দিঘি জলাধারগুলোতে রাসায়নিক কীটনাশকের মাধ্যমে মৎস্য চাষের নামে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করা হয়েছে।

যার ফলে এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যের যে সহাবস্থান তা বিনষ্ট হয়েছে। হয়তো কোন প্রাণের আধিক্য বেড়েছে, আবার কোন প্রাণ একেবারেই প্রায় বিলুপ্ত বা কমে গেছে। বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ লতা পাতার গাছও কমেছে, উন্নয়নের নামে বৃক্ষ কর্তন করা হয়েছে, কমেছে প্রাকৃতিক বন জঙ্গল। যেসব বড় গাছে ঈগল, পেঁচাসহ কতো ধরনের পাখির বসবাস ছিল। উন্নয়নের নামে সকল প্রাণের খাদ্যচক্রের সার্বভৌমত্ব লুণ্ঠিত করা হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কিছু এলাকা শুকনোই থাকতে হবে, পরিত্যক্ত থাকতে হবে, থাকবে, তা এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যর জন্যই। তা একান্তই এই অঞ্চলের মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণের জন্য। কেন প্রতি ইঞ্চি মাটিতে ফসল ফলাতে হবে, কেন শুধু মানুষের খাদ্যের জন্য তা করা হবে! মানুষ তখনই সুখে থাকবে যখন অন্যান্য সকল প্রাণকে সে সুখে থাকতে সহায়তা করবে। বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে। আর যখন তার উল্টোটা ঘটানো হচ্ছে, তখনই চন্দ্রবোড়া মানুষের শত্রু হয়েছে, মানুষ চন্দ্রবোড়ার। আমাদেরকে ভাবতে হবে এই বিষয়গুলো নিয়ে। বরেন্দ্র অঞ্চলের যে ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য সেটিকে গুরুত্ব দিয়েই এই অঞ্চলের উন্নয়ন করতে হবে। তা না হলে সংকট আরও বাড়বে। এই পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়, এখানে সবাইকে নিয়ে সবাই বাঁচতে হবে। তা না হলে মানুষই সব থেকে বেশি সংকটের মুখে পড়বে।

২০১৫ সালে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বারসিক) এই চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার বিষয়ে জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রথম তথ্য সংগ্রহ করে একটি ডকুমেন্টেশন করে। বরেন্দ্র অঞ্চল তথা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার প্রবীণ, বিশেষজ্ঞ এবং জনমানুষের সাথে কথা বলে তাদের মতামতেই এই নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। যাতে আমি নিজে প্রত্যক্ষভাবে কাজের সাথে সংযুক্ত হই। কী ছিল সেই সময়ের মানুষের কথাগুলো? আমার প্রত্যক্ষ জানা মতে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপটির প্রথম দেখা মেলে ১০ জুন ২০১৩ সালে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের বরেন্দা গ্রামে। উক্ত গ্রামের কৃষক আব্বাস আলীর দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে আনোয়ার আলী সেসময় চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) সাপের কামড়ে মারা যায়। সেসময় সাপটির ছবি এবং কামড়ের ধরণ দেখে ডাক্তার এবং বিশেষজ্ঞরা এটিকে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার হিসেবে সনাক্ত করেন।

এরআগেও আমাদের একটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার জুমার পাড়া শিবরামপুর গ্রামের এক আদিবাসী নারী চন্দ্রবোড়া সাপের দংশনে মারা যায়। সেসময় পর্যন্ত সাপটিকে পরিচিত এবং চিরচেনা চন্দ্রবোড়া হিসেবেই জানতো বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু মিডিয়াতে সাপটিকে যখন রাসেলস ভাইপার নামে প্রকাশ করা হলো, তখনই ঘটলো আতংক আর বিভ্রান্তি। জনমনে তখন এটিকে বিদেশি কোন সাপ বলে ভয় পেতে থাকে। সাপটিকে হত্যার হারও বাড়লে আবার এখন এটি প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ল। সেই সময়েই পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস (বারসিক) উদ্বেগজনক এই বিষয় নিয়ে সাপ বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার এবং প্রাণবৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা শুরু করে। যাতে ভবিষ্যতে এই সংকটটি সমাধানে পৌঁছানো যায়। সেসময় ২০১৫ সালে সাপ বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ, বোরহান বিশ্বাস রমন, প্রাণবৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাস, রাজশাহী মেডিকেলের ডা. আবু শাহীনসহ, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন মিলে চন্দ্রবোড়া সাপের প্রতিরোধ ও বৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় করণীয় দিকগুলো তুলে ধরা হয়। কিন্তু সেই সময়ের পরামর্শগুলো কাজে লাগালে আজকের এই যে দেশ ব্যাপী আতঙ্ক এবং যে হারে সাপ হত্যা করছে মানুষ, আবার সাপও হত্যা করছে মানুষকে তা কিছুটা হলেও রক্ষা পেতো।

চন্দ্রবোড়ার বর্তমান সংকট উত্তরণে তাই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। কৃষি বিভাগ, বনবিভাগ এবং স্বাস্থ্য বিভাগ মিলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাপের থাকার বাসস্থান ঠিক রাখতে বন ও কৃষি বিভাগে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পর্যন্ত এর চিকিৎসা ও সাপ না মারতে জনসচেতনতার উদ্যোগ নিতে হবে। সাথে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথেও এই সংকট প্রতিকার করতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

মো. শহিদুল ইসলাম: গবেষক, বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর