পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমবর্ধমান হিংসা, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের দায় কার?

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমবর্ধমান হিংসা, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের দায় কার/ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমবর্ধমান হিংসা, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের দায় কার/ছবি: সংগৃহীত

১০/১২ দিনের মধ্যে আবার উতপ্ত হয়েছে পাহাড়। থেমে থেমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নাজুক হচ্ছে। সেখানে ক্রমবর্ধমান জাতিগত হিংসা, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ বাড়ছে। পাহাড়ে বার বার অশান্তি ও উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার কারণ কি? এসব অপকর্মের দায়-দায়িত্ব কার? প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনে জাতিগত অসন্তোষের মতো মারাত্মক সমস্যার প্রতিবিধান করা অতি জরুরি।

বিশেষ করে, শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ২৭ বছর পর আবার পাহাড়ে সংঘাত ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা সত্যিই চিন্তার বিষয়। শান্তিচুক্তি হয়েছিল একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে। সেখানে এখন ৫/৬টি সশস্ত্র গোষ্ঠী নানা দাবিতে সোচ্চার। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, তুচ্ছ বা সাধারণ ঘটনা, যা বিচার-সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব কিংবা মামলা-মোকাদ্দমার মাধ্যমে সুরাহা করা যায়, সেগুলোও ভয়াবহ গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আকার ধারণ করছে।

বিজ্ঞাপন

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, কোনও ঘটনার পর পরই দুই পক্ষের উত্তেজিত লোকজন খণ্ড খণ্ড পক্ষে বিভক্ত হয়ে সদরে মহড়া দিতে শুরু করে। দুই পক্ষের তরফে আক্রমণাত্মক স্লোগান দেওয়া হয়। উভয় পক্ষের উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে গিয়ে অনেক সময় সরকারি দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিবর্গও আক্রান্ত হন। সবগুলো ঘটনাতেই শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ঘটনার পরবর্তী বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি থাকে বেশ উত্তেজনাকর। উভয় পক্ষের সাধারণ মানুষ ও তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১ অক্টোবর পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ঘটনার পর পাহাড়ি ও বাঙালিরা খাগড়াছড়ি সদরে মুখোমুখি অবস্থান নেন। দুই পক্ষই পৃথক মিছিল বের করে। সদরের মহাজনপাড়ার কয়েকটি দোকানেও ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া একটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি–বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত হয়। তখন নিহত মামুনের স্ত্রী হত্যা মামলা করেন পলাতক তিন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে মামুনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি–বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে আগুন দেওয়া হয় দোকানপাটে। সংঘাতে দীঘিনালায় ধনঞ্জয় চাকমা নামের এক ব্যক্তি মারা যান। ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি সদরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে রুবেল ত্রিপুরা ও জুনান চাকমা নামের দুজন মারা যান। ২০ সেপ্টেম্বর এ ঘটনার জের ধরে রাঙামাটিতে সংঘর্ষ হয়। সেখানে দোকানপাট ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। অনিক কুমার চাকমা নামের একজন মারা যান। ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। পরে তা তুলে নেওয়া হয়। এসব ঘটনায় দুই জেলায় পাঁচটি মামলা হয়।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, জাতিগত অসন্তোষ ও গোষ্ঠীগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা-উত্তেজনা কেবলমাত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমাধানের বিষয় নয়। সমাজে যদি হিংসা, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের বীজ থাকে, তাহলে সেটা বৃদ্ধি পাবেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সাময়িকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও সমস্যার বীজ উৎপাটন করা সম্ভব নয়। ফলে সমস্যার বীজ থাকায় পাহাড়ে বার বার তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।

প্রশ্ন হলো, এসব ঘটনার দায় কার এবং এসবের কারণ কি? সমস্যার সমাধন কল্পে তা জানা দরকার। আমরা জানি, পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীনতার পর সশস্ত্র পথে চলেছিল। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তা নিয়মতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হয়। এটা অবশ্যই একটি রাজনৈতিক সাফল্য। কিন্তু চুক্তি সম্পাদিত হলেই রাতারাতি শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপিত হয় না। এজন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার দরকার হয়, যার মাধ্যমে মানুষে মানুষে হিংসা ও অবিশ্বাস কমে স্থিতিশীলতা আসবে।

পাহাড়ে সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি স্থাপনের কাজটি অবহেলিত রয়েছে। চুক্তির ফলে পাহাড়ি ও বাঙালি নেতারা বিভিন্ন পদ-পদবী নিয়ে মত্ত হয়ে আছেন। সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য কেউ এগিয়ে আসেন নি। সবাই গোষ্ঠী ও দলগত রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ফলে বৃহত্তর সমাজও বহুধা বিভক্ত। দলের নামে, গোষ্ঠীর নামে, জাতির নামে বিরাজমান তাদের মধ্যকার এই বিভক্তি দূর করা হয় নি বলেই একে অপরের মুখোমুখি হতে পিছ পা হয় না।

আশ্চযের বিষয় হলো, পাহাড়ে হিংসা ও গোষ্ঠীগত দাঙ্গা হলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হাতে হাত রেখে একবারের জন্যও মৈত্রী সমাবেশ করতে পারেন নি। সর্বদলীয় কোনও সম্প্রীতি পদযাত্রা বা মিছিলও সেখানে হয় নি। একে অপরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস নিয়ে দল ও গোষ্ঠীগুলো বাস করছে সেখানে।

অথচ শান্তিচুক্তির পর বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধন করাও প্রয়োজন ছিল। দরকার ছিল গোষ্ঠী ও দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আয়োজন করা। পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা ও আদান-প্রদানেরও আবশ্যকতা ছিল। তাহলে হিংসা ও বিদ্বেষ হ্রাস পেয়ে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমে আসতে পারতো।

সামাজিক ও সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ ও নাগরিক সমাজের। হতাশাজনকভাবে লক্ষ্যণীয় যে, তারা সবাই নিজ নিজ গোষ্ঠী ও দলগত ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে এতোই মগ্ন যে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও শান্তির চিন্তা কিংবা প্রচেষ্টা তাদের কাছ থেকে মোটেও দেখা যায় নি। এতে বিভেদের দেয়াল বেড়েছে এবং প্রায়ই নানা ঘটনায় পিটিয়ে মারাট ঘটনা ঘটছে বা গোষ্ঠীগত দাঙ্গা হচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় সাধারণ মানুষের জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতিও হচ্ছে। এবং পাহাড়ে থেমে থেমে উত্তেজনা ও ভায়োলেন্স ছড়িয়ে পড়ছে। সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা।

দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর ১৪৪ ধারা জারি বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান গ্রহণ সাময়িকভাবে পরিস্থিতি শান্ত করলেও এটি কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। বিষয়টি এমন নয় যে, কয়দিন পর পরই অশান্তি হবে আর সরকারি বাহিনী গিয়ে শান্তি স্থাপন করে দিয়ে আসবে। বরং পুরো বিষয়টিই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিষয় এবং সামাজিকভাবে সকলের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মনোভাবের উপর নির্ভরশীল। সমাজের মানুষ যদি নিজেরা নিজেদের স্বার্থে শান্তি বজায় রেখে নিজেদের জান ও মালের সুরক্ষা নিজেরা না করেন, তাহলে কোনও বাহিনীর পক্ষেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া সম্ভব নয়। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাদেরকেই, যারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

শান্তিচুক্তির এতো বছর পরেও পাহাড়ে গোষ্ঠীগত দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হওয়া কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কয়দিন পর পরই সেখানে দুইপক্ষের যুদ্ধংদেহী আচরণও কাম্য নয়। বিশেষ করে, সাধারণ মানুষের মৃত্যু, নাগরিকদের বাড়িঘর ও দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। একটি স্বাধীন দেশে মধ্যযুগীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামার চিত্র বিবেকবান কোনও মানুষই মেনে নিতে পারে না। রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বকে এগিয়ে এসে হিংসা ও অবিশ্বাসের দেয়াল ভাঙতে হবে এবং সকলকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তা না করে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থে হিংসা ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়ায় তাহলে শান্তির সবুজ পাহাড় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, যা কারো জন্যই মঙ্গলময় ও কল্যাণকর হবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।