বাংলাদেশের নগরসমূহ, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে যানজট ও পরিবহন সংকট। বর্তমান পরিস্থিতিতে, একটি পরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। নগর পরিবহনের এই সংকট নাগরিক জীবনকে কঠিন করে তুলছে। এছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি কমিয়ে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ঢাকার যানজট একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকেন। এর ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মঘণ্টা অপচয় হয়, যা অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতায় বড় ধরনের ক্ষতি করছে।
পরিবহন সমস্যার আরেকটি গুরুতর প্রভাব হলো বায়ু দূষণ। ঢাকার বায়ুর মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে অনেক নিচে। যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া ও গ্যাস বায়ুর গুণমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা নাগরিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
নগর পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা দেশের অর্থনীতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। যানজটের কারণে পণ্য পরিবহন দেরি হয়, উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইসব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
নগর পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। একটি কার্যকরী ও টেকসই নগর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে-
গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন: আধুনিক ও সাশ্রয়ী গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (BRT), এবং ট্রাম সিস্টেমের মতো আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এগুলি নাগরিকদের সহজ, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী যাতায়াতের সুযোগ প্রদান করবে।
সাইকেল ও পদযাত্রার প্রচার: ছোট দূরত্বের যাতায়াতের জন্য সাইকেল ও পদযাত্রাকে উৎসাহিত করতে হবে। সাইকেল লেন ও পায়ে চলার পথ উন্নয়ন করে একটি পরিবেশ-বান্ধব ও স্বাস্থ্যকর যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ: যানজট কমানোর জন্য আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। ট্রাফিক সংকেতের সমন্বয়, ইলেকট্রনিক টোল সংগ্রহ, এবং স্মার্ট ট্রাফিক লাইট ব্যবহারের মাধ্যমে যানজট কমানো যেতে পারে।
সড়ক নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন: নগরের সড়ক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করতে হবে। নতুন সড়ক নির্মাণ, ওভারপাস ও আন্ডারপাস তৈরি, এবং বিদ্যমান সড়কগুলির প্রশস্তকরণ করে যানজট কমানো সম্ভব।
পার্কিং ব্যবস্থার উন্নয়ন: নগরীর বিভিন্ন স্থানে সুসংহত পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। সঠিক পার্কিং নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে রাস্তা দখল কমিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
নগর পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। সরকার, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নগরীর ভবিষ্যত উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং সেগুলি সময়মতো বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমান নগরায়নের যুগে, পরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নগরায়ন দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে সুষ্ঠু ও কার্যকর নগর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। নগরীর জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং জীবনের গুণমানের ওপর একটি উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার প্রভাব অনেক গভীর।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনা শহরের মতো নগরীগুলোতে যানজট একটি প্রচলিত সমস্যা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং অন্যান্য গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকেন। এর ফলে প্রতিদিন অসংখ্য কর্মঘণ্টা অপচয় হয়। এই সময়ের অপচয় শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা একটি বড় ধরনের পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করে। যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং অন্যান্য দূষণকারী গ্যাস বায়ুর গুণমান নষ্ট করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুললে বায়ু দূষণ কমিয়ে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
নগর পরিবহন ব্যবস্থার সমস্যার কারণে নাগরিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানজট, ধোঁয়া, শব্দ দূষণ, এবং অব্যবস্থাপিত গণপরিবহন ব্যবস্থার কারণে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি পরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থা এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে সহায়ক হবে।
একটি উন্নত ও কার্যকর নগর পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে পারে। পণ্য ও সেবার দ্রুত স্থানান্তর, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, এবং ব্যবসার জন্য একটি সহজ ও সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।
পরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থা একটি সুস্থ, সুশৃঙ্খল এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক। এটি নাগরিকদের জন্য সহজ এবং সাশ্রয়ী যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ তৈরি করে। বিশেষ করে, কম আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সহজে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে তাদের সামাজিক উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
পরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থা একটি সুস্থ, সুশৃঙ্খল এবং টেকসই নগর গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য। এটি শুধুমাত্র নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করবে না, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশের সুরক্ষা এবং সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই, সময়ের দাবি মেনে পরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থার দিকে আমাদেরকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
মো: বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।