‘তুমি কে আমি কে— রাজাকার রাজাকার’; মধ্যরাতে দেশের ক্যাম্পাসে-ক্যাম্পাসে এমন স্লোগান ওঠেছে কাল। অবিশ্বাস্য ধৃষ্টতায় স্বাধীন বাংলাদেশ লজ্জিত হয়েছে পুনর্বার। এ লজ্জা দিয়েছে তারা, যাদেরকে আমরা সোনালী ভবিষ্যতের আধার ভাবি; সেই শিক্ষার্থীরা। অনতি-তরুণ এই শিক্ষার্থীদের হাতে থাকার কথা আগামীর বাংলাদেশ, অথচ তারা প্রকাশ্যে দেশবিরোধী স্লোগানে প্রকম্পিত করছে দেশের শিক্ষাঙ্গন।
ধারণা করা হচ্ছে এর শুরু স্বাধিকার-স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর বুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সকল ক্যাম্পাসে এমন স্লোগান ওঠেছে। ধারণা করছি, এমন ন্যক্কারজনক স্লোগান বাদ যায়নি কোন ক্যাম্পাসেই। ফলে এটাকে কোন ক্যাম্পাসের কোন গোষ্ঠীর অতি-উৎসাহী, অতি-বিপ্লবী স্লোগান ভাবার কারণ নাই। বরং বলা যায়, এটা পূর্ব পরিকল্পিত এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব থেকেই নির্দেশিত।
নিজেদের ‘রাজাকার’ দাবিকে হালকাভাবে দেখার অবকাশ নাই। কারণ এই একটা শব্দের সঙ্গে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ত্রিশ লক্ষ শহিদ এবং দুই লক্ষের অধিক নারীর সম্মানহানির ইতিহাস আছে। বাংলাদেশে একাত্তরে যে জেনোসাইড চালিয়েছিল পাকিস্তানিরা তার প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিল রাজাকার গোত্রীয়রা। তারা পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশের জেনোসাইড সংঘটনে ছিল চাকরি করা অংশ। আদর্শিক ভাবে ছিল যেমন পাকিস্তানি, তেমনি ছিল তাদের আর্থিক প্রাপ্তিও। সেই রাজাকার গোষ্ঠী একাত্তরের ভূমিকার জন্যে ক্ষমা চায়নি, বরং সময়ে-সময়ে এ নিয়ে গর্ববোধও করেছে।
একাত্তরের রাজাকাররা তাদের কৃতকর্মের জন্যে এখনো গর্ব করে। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারাসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারা এখনো প্রকাশ্যে বলে থাকেন, পাকিস্তান থাকলে বুঝি ভালো হতো। দেশবিরোধী এই অংশের আদর্শিক অনুসারী, উত্তরাধিকাররা নানা বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানকে এখনো তাদের দেশ ভেবে থাকেন। তারা অনুসরণ-অনুকরণ করেন পাকিস্তানকে এখনো। সময়ে-সময়ে তাই দেখা যায় তাদের থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহিদদের অপমান, জেনোসাইডে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য, এবং বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কটাক্ষ।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ নিয়ে দেশে কোন আইন নেই। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে অপমানজনক কথা বললে নির্দিষ্ট কোন কারণে কাউকে আইনে মুখোমুখি হতে হয় না। অথচ জেনোসাইড ডিনাইয়াল প্রিভেনশন অ্যাক্ট নামের একটা আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দেশে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানো হচ্ছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ সেই দাবিকে পাত্তা দিচ্ছে না। ফলে চাইলেই কেউ প্রকাশ্য সভায়, প্রকাশ্য স্লোগানে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করতে পারছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করতে পারছে, এবং দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে নিজেদের ‘রাজাকার’ দাবি করে স্লোগান দিতে পারছে।
কাল রাতের আঁধারে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে স্লোগান দিয়েছে সেটা ধৃষ্টতা, সেটা একাত্তরকে অস্বীকার করা, সেটা একাত্তরের জেনোসাইডের প্রমাণিত অংশীদার রাজাকারদের বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা। ঘৃণিত শব্দ রাজাকারকে মহিমান্বিত করার এই চেষ্টা অমার্জনীয় অপরাধ, কারণ এই শব্দের সঙ্গে সরাসরি যোগ জেনোসাইডের, এই গোষ্ঠী সরাসরি জড়িত ত্রিশ লক্ষ লোকের হত্যা এবং দুই লক্ষের অধিক নারীর সম্মানহানির সঙ্গে।
বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের নিজেদের এই ‘রাজাকার’ দাবি করা। তবে দেখা যাক কী বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী? চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এত ক্ষোভ কেন’ এমন প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি কোটা পাবে না তাহলে কী রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে? সেটা আমার প্রশ্ন। দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা খেয়ে না খেয়ে কাদামাটি মাখিয়ে তারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল বলেই আজ দেশ স্বাধীন। আজ সবাই বড় বড় পদে আসীন। নইলে তো ওই পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে চলতে হতো।’
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশ যথার্থই প্রশ্ন রেখেছেন। একজন নাগরিক হিসেবে আমরাও মনে করি, রাজাকারদের সন্তানেরা নয়, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরাই চাকরি পাওয়ার অগ্রাধিকার রাখে। যে রাজাকার ও তাদের সন্তান-নাতিপুতিরা দেশটাকেই স্বীকার করে না, বাংলাদেশের চাইতে এখনো যারা পাকিস্তানকেই নিজেদের দেশ ভাবে, তারা কোনোভাবেই বাংলাদেশে সুযোগসুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে না। বাংলাদেশে কিছু পেতে হলে আগে দেশকে স্বীকার করতে হবে তাদের। কিন্তু সেটা তারা যখন করেনি, তখন কোন যুক্তিতে রাষ্ট্র তাদের জন্যে সুযোগ সুবিধা রাখবে।
যদিও বাংলাদেশে রাজাকারদের তালিকা, তাদের সন্তান ও নাতিপুতিদের রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা থেকে দূরে রাখার কোন আইন নেই, বিধিমালা নেই, নির্দেশনা নেই; আছে কেবল বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও নাতিপুতিদের জন্যে সুযোগ। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করেছিল সরকার। এরপর ওই পরিপত্রের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রিটের নিষ্পত্তিতে যে কোটা ফিরেছিল সেটাও অদ্যকার আন্দোলনের পর রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে স্থগিত হয়ে গেছে। কোটা নিয়ে সরকার কঠোর নয়, বরং সরকারও আন্দোলনকারীদের দাবির সঙ্গে অনেকটাই একমত। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে, যদিও এই মন্তব্য বিতর্কিত নয়, তবু এটাকে ভিন্নার্থে বিশ্লেষণ করে নিজেদের ‘রাজাকার’ দাবি করে শিক্ষার্থীরা যে স্লোগান দিয়েছে, এতে পুরো বিষয়টিকে জটিল করে তুলবে।
এখন তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা পাকিস্তানিদের জেনোসাইডের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশীদার ছিল, তাদের তালিকা প্রকাশ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। জরুরি হয়ে পড়েছে রাজাকারদের সন্তান ও নাতিপুতিদের বিষয়ে কী অবস্থান হবে রাষ্ট্রের সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
‘রাজাকার’ ঘৃণিত এক শব্দ। মীরজাফর নাম যেমন রাখে না কোন অভিভাবক তাদের সন্তানদের, রাজাকার দাবিও প্রকাশ্যে করতে লজ্জা পায় বেশিরভাগই। কিন্তু দেশবিরোধী এই শব্দকে মহিমান্বিত করার হঠকারী এ স্লোগান দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে তারা তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ, আদর্শকে সামনে নিয়ে এসেছে। যদিও তারা সভা-সমাবেশ-অবস্থান কর্মসূচিতে জাতীয় পতাকা উড়াচ্ছে, মাথায় বাঁধছে পতাকা; কিন্তু এটা যে লোকদেখানো ‘তুমি কে আমি কে— রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে প্রমাণিত হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চাইতে গিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করছে—এসবকে শুরুতে বিশাল আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন রূপ ভাবা গেলেও নিজেদের ‘রাজাকার’ দাবির পর এখন আর এভাবে সহজভাবে দেখার সুযোগ কমে এসেছে। এমন না যে এটা কোন একটা ক্যাম্পাসে অতি-উৎসাহী বিচ্ছিন্ন কোন অংশ করেছে, এই স্লোগান যখন দেশের ক্যাম্পাসে-ক্যাম্পাসে উঠেছে, তখন বিষয়টি আর সাধারণ থাকছে না। বরং এটাকে পরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে।
এই প্রজন্মের তরুণদের কেউ ‘রাজাকার’ থাকার কথা নয়, এদের পূর্বপুরুষদের কেউ দেশবিরোধী রাজাকার ছিল কিনা এটা আমরা নিশ্চিত নই। তবে এরা একাত্তরের সেই ‘রাজাকারদের’ আদর্শিক অনুসারী হিসেবে অদ্য নিজেদের দাবি করছে। তাদেরকে কেউ ‘রাজাকার’ বলছে না, কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের ‘রাজাকার’ ভাবছে, প্রচার করছে। যারা নিজেদের ‘রাজাকার’ বা দেশবিরোধী দাবি করে তাদেরকে জোর করে আমরা বাংলাদেশের স্বপক্ষের তবে বলি কীভাবে?
চিরায়ত সেই দ্বন্দ্ব তাই ফিরে আসে, ‘রাজাকার’ ও তাদের আদর্শিক অনুসারীদের কীভাবে দেখবে রাষ্ট্র—সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বুঝি এসেই গেল!