কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে উদ্ভূত অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অবজ্ঞা বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ।
চলমান সংকট নিরসনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা এবং কোন ধরণের প্রতিশোধের মনোবৃত্তি পুষে না রাখা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন গণবিস্ফোরণে রূপ নেওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দেশের নাগরিক সমাজেরও সমালোচনা করেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, আমাদের নাগরিক সমাজ শুধু বিভক্তই নয়, বেশির ভাগই রাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়ার মোহে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
বুধবার দুপুরে বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ড. মাহবুব উল্লাহ। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: কোটা সংস্কার আন্দোলন সংঘাতময় পরিণতি পাওয়ায় উদ্ভূত অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ এসেছে। স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এর নির্দেশনা নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন...
ড. মাহবুব উল্লাহ: পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এবং ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্ষদ হচ্ছে সিন্ডিকেট। অতীতে আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি সেটা হলো এই ধরণের কোন সংকট সৃষ্টি হলে ভাইস-চ্যান্সেলর সিন্ডিকেটের মিটিং ডাকেন। সেখানে আলোচনা-পর্যালোচনার পর ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকাল বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করে দিতে হবে কিনা সেটা তারা সিদ্ধান্ত নেন। এবার বলা যেতে পারে ইউজিসির মাধ্যমে যেটা হল তা মনে হচ্ছে না, সাধারণ যে নিয়ম বা কনভেনশন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটির যে স্বায়ত্বশাসন রয়েছে সেইটাকে অবজ্ঞা প্রকাশ করা হল। এটা মোটেও কাম্য ছিল না। সরকার তো খুব ভালো করেই জানে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ যে পর্ষদ গঠিত হয়, এর পেছনে সরকারের নিজস্ব কর্তৃত্ব অনেকখানি আছে। সেটা পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হোক। এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য নিয়োগেও সরকারের পূর্ব অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সরকারের সম্মতি ছাড়া এগুলো হয় না। সরকার নির্দেশনা দিয়েই কাজটা করতে পারত এই বলে যে, এ ধরণের পরিস্থিতিতে ইউনিভার্সিটিগুলো বন্ধ রাখা উচিত। তখন নিশ্চয়ই ভাইস-চ্যান্সেলর দ্বিমত করতেন না। ভাইস-চ্যান্সেলরগণ যেহেতু সবাই একই লাইনের লোক..তো সেই পথে না গিয়ে..মনে হচ্ছে যে এক ধরণের খুব তাড়া ছিল। তড়িঘড়ি করে কাজটা করতে হবে। নিঃসন্দেহে এটা অতীতের সকল কনভেনশন ও যে সমস্ত দৃষ্টান্তের সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বার্তা২৪.কম: গতকাল মঙ্গলবার কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সংঘর্ষে ৬ জন নিহত ও বহু আহত হয়েছেন। ছাত্র আন্দোলনে এই রক্তপাত কি এড়ানো যেত না?
ড. মাহবুব উল্লাহ: কোটার প্রশ্নে ছাত্ররা যে অবস্থান নিয়েছে...সেই ২০১৮ সাল থেকে, কখনও তারা বলেনি সম্পূর্ণভাবে কোটা প্রত্যাহার করতে হবে বা বাতিল করতে হবে। তারা বলেছেন কোটার সংস্কার চান। এবং এমন একটা সংস্কার চান যেটা মেধার মূল্যায়নে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করবে। মোটামুটি সরকারি মহলের অনেকেও এর যথার্থতা স্বীকার করেন। এই অবস্থায় যেহেতু এটা যথার্থ সেহেতু সরকার গোড়া থেকে যেটা করতে পারতো, সেটা হলো ছাত্রছাত্রীদের আশ্বস্ত করা এই বলে যে, ‘তোমাদের দাবির যথার্থতা আমরা অনুধাবন করতে পারছি। তবে বিষয়টি সমাধান করতে গেলে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার আছে। সেই ভিত্তিতেই তোমাদের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান দেব।’
সেখানে যাদের কোটা পাওয়া উচিত, যৌক্তিতা আছে তাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা রেখে বাকী সব বাদ দেওয়া। অনেকে যেটা বলেন যে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? তাহলে তাদের সংখ্যানুপাত কত হয়, এবং সেই অনুসারে সেটা করা। ছাত্ররা বলেছেন যে কোটা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হতে পারে। রাজনৈতিক দল বিএনপির কেউ কেউ বলেছেন, এটা দশ থেকে পনের শতাংশ হতে পারে। যাহোক এটা তো একটা আলাপ আলোচনা করে সমঝোতার পরিবেশে সহানুভূতির পরিবেশে জিনিসটা করা যেত। তারপরে যা ঘটলো তা অনমনীয়তার ব্যাপার। দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। অনেক প্রাণ চলে গেল, অনেকে আহত হল। তবে এটাও মনে রাখতে হবে গত কয়েক দিনের যে ঘটনাবলী তা নিছক কোটা সংশ্লিষ্ট সরকারের ঔদাসীন্যের জন্য নয়। বরং এটা বলা যায় যে, দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত যে বিক্ষোভ সঞ্চিত হচ্ছিল তার কোন বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছি না নানা কারণে; সেই জন্য একটা বিস্ফোরণ হয়ে গেছে। তার চাইতেও দুঃখজনক হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে যেভাবে পেটানো হয়েছে এটা একটা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে সভ্য দেশে কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। তারপরেও সেখানে বহিরাগতরা, ছাত্র নয় এমন অনেককে ব্যবহার করা হয়েছে। আমি এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছিলাম, পরে শিক্ষকতা করেছি, আমাদের জানা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বাইরের লোক দিয়ে ছাত্রআন্দোলন দমন করা, এটা কখনো হয়নি। এটা খুবই নিন্দনীয়, দুঃখজনক-যা মেনে নেওয়া যায় না। তারপরও বলব সকলের সুমতি হোক। যাতে আমরা একটা সুষ্ঠু সমাধানে আসতে পারি। এবং দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও সহনশীলতার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যায়। যেখানে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ সবাই তাদের মনের আনন্দে নাগরিক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে।
বার্তা২৪.কম: বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সার্বিক অবস্থার উত্তরণ কি উপায়ে হতে পারে বলে মনে করেন...
ড. মাহবুব উল্লাহ: উত্তরণ তো কঠিন ব্যাপার। দেশে একটা ইস্যু এলে আরও অনেক ইস্যু জড়িয়ে যায়। সেটা হয় আমাদের বালখিল্যতার জন্য। আমরা সঠিকভাবে সমস্যাগুলো হ্যান্ডেল করতে পারি না, সে কারণে এগুলো ঘটে। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ-সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ খুলবে আমরা জানি না। কবে নাগাদ সরকার বুঝবে বা উপলব্ধি করবে যে খোলার মত পরিবেশ হয়েছে। এই দিক থেকে বললে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের অনেক ক্ষতি হবে। সেশনজট সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজস্ব আন্দোলন চলছে। সেই আন্দোলনও সুরাহা হওয়ার পথে বেশি আলো আমি দেখছি না। কিভাবে সুরাহা হবে সেটা ঠিক বুঝতেও পারছি না। কথা হচ্ছে যে, এটা সুরাহা করার জন্য সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে আন্তরিকতা এবং কোন ধরণের প্রতিশোধের মনোবৃত্তি পুষে না রাখা। মন থেকে সব কালিমা ধুয়ে মুছে খোলা মন নিয়ে আন্তরিকতা সঙ্গে সমাধানে উদ্যোগী হওয়া। যদিও সেটা যে খুব সহজ হবে তা মনে করা কঠিন। কারণ রক্তপাত হয়ে যাওয়ার পর যেটা দাগ বা ক্ষত সৃষ্টি হয় সেই ক্ষত সহজে মোছা যায় না। মানুষের শরীরে ক্ষত হলে চিকিৎসায় ক্ষত হয়ত শুকিয়ে যায় কিন্তু দাগ থেকে যায়। এটাই হল চিন্তার বিষয়।
বার্তা২৪.কম: সংকটের উত্তাপ প্রশমনে সরকারের বাইরে নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে কিভাবে দেখেন?
ড. মাহবুব উল্লাহ: দেশের সুস্থ ও সহনশীল পরিবেশ তৈরি করার ব্যাপারে সিভিল সোসাইটি একটা বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ বিভক্ত। শুধু বিভক্তই নয়, এর বেশির ভাগ রাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়ার মোহে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। অথচ পাকিস্তান আমলে, এমনকি বাংলাদেশ সৃষ্টির পরেও আমরা লক্ষ্য করেছি, এখানকার নাগরিক সমাজ; বিশেষ করে বিদ্বৎসমাজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, বিভিন্ন পেশাজীবীরা, শিল্পী-কবি সাহিত্যিকরা বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আজকে যাদের জাতির বিবেক হিসাবে দায়িত্ব পালন করার কথা তারা প্রায় নিশ্চুপ। নিশ্চুপই নয়, তারা অন্যায়ের প্রতি প্রশ্রয়শীল। এটা খুবই দুঃখজনক, বেদনাদায়ক এবং এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া উচিত। আমি আশাকরব আগামী দিনে বিবেকবান এমন অনেক মানুষ সৃষ্টি হবে।