গত জুলাইয়ের শুরুতে শিক্ষার্থীরা চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সামনে রেখে রাজধানীর শহবাগ চত্বরে নেমে পড়েছিল। তাদের কারো গলায় ঝোলানো ছিল ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’। কারো গলায় ছিল- ‘ভেঙ্গে ফেল, কোটার ঐ শিকল’লেখা কার্ড ঝুলানো।
এগুলো খুব স্বাভাবিক দাবি ও যৌক্তিক আন্দোলন ভেবে তখন কেউ ততটা গা করেনি। কেউ কখনও ভাবেননি যে এর দ্বারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কি বুঝাতে চেয়েছিল এবং আসলেই দেশে কি ঘটতে পারে! আগষ্টের পাঁচ তারিখে তাদের ভাবনাটা এমন একটি বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়ে ফেলে জাতিকে নতুন কিছু অন্বেষণের সন্ধান দিতে বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের জাতীয় করি নজরুলের শিকল ভাঙ্গার গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’অথবা অনুপ্রেরণা সঙ্গীত ‘চল চল চল, উর্দ্ধ গগণে বাজে মাদল’এবং কবিগুরুর ‘ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’ অথবা ‘রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী’। এসবকিছুই বিমূর্ত আহবান থেকে এক বাস্তবাতার আকরে পরিণত হয়ে আজ আশার আলো দেখাচ্ছে। এগুলো শুধু কবিতার তত্বীয় পংক্তিমালা নয়, যুগে যুগে বার বার এসব কথা ছন্দ হয়ে ফিরে আসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তরুণের আহবানে দীপ্ত শিখা হয়ে। গত ৫, ৬, ৭ জুলাই তারিখে উন্মত্ত ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছিল জাতিকে কে পরিচালনা করছে ? কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? ইত্যাদি।
তখন অনেকের কাছে সবকিছু কিছুটা গোলেমেলে মনে হলেও গণমাধ্যমে সংগ্রামী সমন্বয়কারী তরুণদের দৃঢ়চেতা বক্তব্য, সৎসাহস, কন্ঠের অমিততেজ ও দেহ-মনের সৌষ্ঠব ভঙ্গিমার সম্মিলিত জোর এবং নৈতিক অবস্থান দেখে শুনে জাতি ধীরে ধীরে তাদের প্রতি আশ্বস্ত পড়ে। যা জুলাই ৮ তারিখে একটি অন্তবর্তীকালীণ সরকার গঠনে বাস্তব রূপ নেয়।
এর মধ্যিখানে তাদেরকে কেউ টলাতে পারেনি। একটি গুরুত্ত্বর্ণ বিষয় তাদের সবার বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল যেটা হচ্ছে- তাদের প্রত্যেক সমন্বয়কারীর মধ্যে সুষ্ঠ কো-অর্ডিনেশন এবং অখন্ড চেতনায় একই সুরে কথা বলার দক্ষতা ও যোগ্যতা।
তারা আমাদের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী। তারা অসীম অগাধ মেধাবী ও ন্যায়পরায়ণ। কোন গুজবে তারা কেউ কান দেয়নি। কোন প্রকার ভয়-ভীতি ও প্রলোভনে তারা সাড়া দেয়নি। তারা সবসময় কয়েকজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের নিকট পরামর্শ নিয়েছে এবং প্রিয় শিক্ষকরা তাদেরকে সবসময় আগলে রেখেছেন।
সকার নানা প্রকার অন্যায়, অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা চালালেও তারা ছিল দুর্বার, দুর্দাম, অনড়। নিজের মৃত্যুকে তারা একবিন্দুও ভয় করেনি। ডিকেটটিভ পুলিশের ভয়ংকর কৌশলের কাছে তারা মাথা নত করেনি, অত্যাচারিত হয়েও মুখ ফুটে বলেনি কোন কথা। বত্রিশ ঘন্টা অনশন করে জানিয়ে দিয়েছে তাদের অবিচল অবস্থানের কথা। ঐ কয়দিন অবরুদ্ধ থাকার সময় প্রকাশ করেনি কোন ধরণের নৈতিক ও মানসিক দুর্বলতা।
বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীর মানুষের নজর ছিল তাদের দৃঢ় অবস্থানের উপর। মানুষের অশেষ দোয়া, আশা, ভালবাসা সবকিছুই তাদের মাতার উপর মেঘের সুশীতল ছায়া হিসেবে সবসময় বইছিল যেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ দল বেঁধে তাদেরকে উদ্ধারের জন্য গিয়ে হেনস্থা হয়েছে ডিবি-র কাছে। কথা বলতে না পেরে চরম মনোকষ্ঠ নিয়ে ফিরে এলেও শিক্ষকদের সাথে গোটা জাতি সেই মনের কষ্ট ভাগ করে নিয়ে আন্দোলনকে প্রবল গতিবেগে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। যেটা হঠকারী আটককারীদের বোঝার শক্তিতে কুলায় নি। বরং তারা অন্যায় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বার বার রং ট্রিগার চেপে মানুষের মনকে তিক্ত করে ক্ষমতাসীনদের ভিত উল্টানোকে ত্বরান্বিত করে তুলেছিল।
এর ফলে শ্যামল সবুজ বাংলাদেশের বুকে ইতিহাসের এক করুণ, রক্তিম অধ্যায় রচিত হয়ে গেছে। শুরুটা করেছিল অবিশ্বাস্য সাহসী, অমিততেজী শহীদ আবু সাঈদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে মডার্ণ চত্ত্বরের নিকটে বুক পেতে বুলেট ধারণ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করার মাধ্যমে। এটাই দেশের জন্য তারুণ্যের আত্মত্যাগ, তারুণ্যের গৌরবদীপ্তমাখা অহংকার। যা হয়তো কেয়ামত পর্যন্ত এই জাতি স্মরণ করতেই থাকবে।
এরপর যা ঘটে গেছে তাকে নতুন করে বলার অপেক্ষা নেই। শত শত কচি প্রাণের অকালমৃত্যু গণমানুষের মুঠোফোনের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর প্রতিটি কর্ণারে। নিয়ন্ত্রিত ও সরকারী পোষা গণমাধ্যমের কপটতায় প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা গোপন করা হলেও তা বেশীদিন গোপন থাকেনি। এমনকি ইন্টারনেট ও মোবাইল ডাটা সার্ভিস বন্ধ করে দিয়ে এ আন্দোলনের সংবাদ ও তথ্য প্রচারে হীন প্রচেষ্টা চালানো হলেও সেটা গোপন করা যায়নি। বিদেশী সূত্রের গণমাধ্যমের দ্বারা মানুষ পরবর্তীতে জানতে পেরেছে।
তাদের নির্মম মৃত্যুর ফলে শত শত লাশ আর আহতদের পরিবারের আহাজারি, কান্না, বিলাপ আর অভিমাপে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠার পরও ভাড়াটি গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাকারীরা। পালিয়ে যাবার মুহূর্তে অগ্নিকান্ডে দেশের সম্পদ ধ্বংস করে প্রলয় চালাতে কুন্ঠিত হয়নি তারা।
দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজদেরকে মোটাতাজা করণে লিপ্ত করে দেশকে বৈষম্যের আখড়া বানানোর কুশীলবরা অনেকে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি আঁচ করে আগেভাগেই দেশ ছেড়ে আত্মগোপনে সটকে পড়তে শুরু করলে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরী হয। হত্যা, খুন, ডাকাতি চলে কয়েকদিন ধরে। দেশের মানুষ পাড়ায় পাড়ায় দলবেঁধে সেসব ডাকাতদেরকে প্রতিহত করতে থাকে। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে রাত জেগে পাহারা বসানো হয়।
গত কয়েকদিন ধরে দেশের অচলাবস্থা নিরসনে সবার আগে স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা রাস্তায় নেমে পড়েছে। তারা প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় ধ্বংসস্তুপের ডেবরিজ সরিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে নেমে পড়েছে। মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে জাতীয় সংসদ ভবনের গোটা চত্ত¡রকে পরিস্কার করে হাজার হাজার মোমবাতি জ্বালিয়ে দ্বিতীয় স্বাধীনতা উদযাপনে শরিক হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ছেলে-মেয়ে উভয়েই একত্রে রাজপথে নেমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে অংশগ্রহণ করেছে। যা হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল।
এখন একটি অন্তবর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, জাপানের মতো আমাদের দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের পার্ট টাইম কাজের অভাব হবে না। জাপানে আন্ডার গ্রাজুয়েট ও গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের ভর্তির পর নবীন বরণ বা ওরিয়েন্টেশনের সময় বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী চাকরিদাতা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা চাকরি মেলার আয়োজন করেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিসিপ্লিনের জ্ঞান অনুযায়ী ব্যবহারিক কাজের সন্ধান ও সুযোগ পান। যারা এর বাইরে থাকে তারাও ছুটি অথবা রাত্রিকালীণ সময়ে পার্টটাইম কাজ করে পড়াশুনার জন্য অর্থ উপার্জন করার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। এমনকি যারা পড়াশুনা শেষ করে নির্দিষ্ট গবেষণাকর্ম করতে চান তাদেরকেও অগ্রীম চুক্তি সই করার মতো ব্যবস্থা সেখানে নেয়া হয়। আমাদের শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ম কমানোর জন্য এসব আগামী দিনের কর্মমুখী পরিকল্পনায় বর্তমান তরুণ মেধাবীদেরকে দিয়ে নীতি-মডেল তৈরী করতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো বর্তমান তরুণরা ছাত্রসংসদকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতির পক্ষে। তারা লেজুড়বৃত্তি দলীয় রাজনীতির ঘোরবিরোধী। শিক্ষাঙ্গণে রাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি সকল পেশাদারী প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অফিস আদালতে তোয়াজ-তোষণের রাজনীতি বন্ধ করে সকল সেক্টরে নিজস্ব গবেষণা সেল চালু করতে হবে। মেধা উন্নয়নের মাধ্যমে নিজস্ব কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য তরুণদেরেকেই ভাবতে হবে। আমাদের দেশে বছরে শ্রমবাজারে সংযুক্ত হয় ২০ লক্ষ নতুন তরুণ। তাদের স্কিল থাকে না। ফলে বেকারত্ব, হতাশায় ডুবে যায় শিক্ষিত তরুণরা। এটা আমাদের দেশে চাকরি ও আয়বৈষম্য সৃষ্টি করে দারিদ্র বাড়ায়। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট চাকরি প্রাপ্তিতে বৈষম্য ঠেকানোর ফলেই সূচিত হয়ে বিগত আওয়ামী সরকার পতন ঘটিয়েছে। সুতরাং দিনের আলো বাকী থাকতেই আগামী দিনের শিক্ষত বেকার ও সকল তরুণদের কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবতে হবে। এই চিন্তার ভার বর্তমান তরুণদেরকেই দিতে হবে, নিতে হবে।
সাম্প্রতিক আন্দোলন ঠেকানোর ঘটনাপ্রবাহে যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা খুব দ্রুত পুষিয়ে ওঠা কঠিন। নিজের উপর নিজের দায়িত্ব কি সেটা ভুলে যাওয়ায় সবার সামনে গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট অপেক্ষা করছে। এই দেশটা আমাদের সবার। কোন দেশের মাটি তার সন্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। তাই সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ভেদাভেদ ভুলে সবাই মিলে মিশে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেশের কল্যাণে নতুন উদ্যমে আবারো কাজ শুরু করি-আজকের দিনে এটাই হোক সবার লক্ষ্য।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd