আমরা জানি কোনো নির্বাচনে যে-ই জিতুক জনগণ জিতবে না। কারণ জনগণের পক্ষের কোনো দল নির্বাচনে জোরালো ভাবে থাকে না। নির্বাচনে যারা লড়ে তারা বুর্জোয়া দল; তাদের ভেতর বিভাজন আছে। ক্ষমতায় যারা ছিল তারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই নির্বাচন দিয়েছে ক্ষমতাসীনদের শাসনের অধীনে অতীতে যত নির্বাচন হয়েছে কোনোটাই সুষ্ঠু হয়নি।
কিন্তু দুই জোটেরই আদর্শগত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। সরকার বলেছিল তোমরা ভোট দাও, আমরা উন্নতি দেব। কিন্তু প্রশ্ন থাকে উন্নতি যে রাস্তায় সেই রাস্তাতেই কি চলেছে? এই উন্নতির অর্থ তো শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে বৈষম্য বৃদ্ধি। উন্নতি যা হচ্ছে সেটা কতিপয়ের। তাদের কেউ কেউ বুলেটের গতিতে উন্নতি করছে, এবং টাকা-পয়সা যা করছে তা বিদেশে পাচার করছে। এই উন্নতিতে বঞ্চিত মানুষ, যাদের সংখ্যা, শতকরা আশি জন, তাদের উপকারটা কোথায়? উন্নতি যে ঘটছে তার কারণ মানুষের শ্রম, আর বঞ্চিত তো হচ্ছে সেই শ্রমজীবীরাই, যাদের শ্রমের দরুন এতো সব উন্নতি। বিরোধীদের আওয়াজটা ছিল গণতন্ত্র উদ্ধারের। কিন্তু গণতন্ত্র তো কেবল ভোটের ওপর নির্ভর করে না, গণতন্ত্রের মূল কথাটাই হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা, তার কথা কি তারা ভাবেছেন?
দেশের প্রতিটি নির্বাচন যে কাজটা বেশ সুন্দর ভাবে করে সেটা হলো বুর্জোয়াদের রাজনীতির ভেতরকার অন্তঃসারশূন্যতার অধিকতর উন্মোচন। টাকার দৌরাত্ম্যের কথা বাদই দিলাম, সেটা তো ঘটেই। কিন্তু দলবদল? সেটা ঘটে কোন টানে? সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের শাসনের অত্যন্ত কঠিন সমালোচক ছিলেন, কিন্তু যোগ দিয়েছিলেন নৌকাতে। তারচেয়েও বড় ব্যাপার তিনি রাজনীতিতে এসেছেন জিয়াউর রহমানের হাত ধরে; ছিলেন বিএনপি’র প্রথম সাধারণ সম্পাদক; দলের প্রার্থী হিসেবে এমপি, মন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছেন। বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলতো; বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন ওই আদর্শের সবচেয়ে নিবেদিত প্রাণ প্রচারক। অপরদিকে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে। চৌধুরী সাহেব যে আওয়ামী জোটে যোগ দিয়েছিলেন সেটা কি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করে? শেষ পর্যন্ত তার কি ধারণা হয়েছিল, জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত ছিল, এবং ওই আদর্শের প্রচারক হিসেবে মানুষকে এতদিন তিনি বিভ্রান্ত করেছেন? তেমন একটা ঘোষণা দিলে তবু বোঝা যেতো যে দলবদলের ব্যাপারটা নিতান্ত সুবিধাবাদিতা নয়, ভেতরে সারবস্তু কিছু আছে।
সুবিধাবাদ জিনিসটা নির্বাচনে বেশ ভালো ভাবেই সামনে আসে, বার বার আসে। গত নির্বাচনেও এসেছে। যার যেদিকে সুবিধা, তিনি সেদিকে গেছেন। গেছেন ইনাম আহমদ চৌধুরীও। শোনা গিয়েছিল বিএনপি’র হয়ে লড়বেন। মনোনয়ন পাননি, না-পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছেন আওয়ামী লীগে। এত কাল যে বিএনপিতে ছিলেন তার কারণ কি? সুবিধা? বিএনপির শাসনামলে তিনি প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই বোর্ডের প্রধান কীর্তি আদমজী পাটকলের বিলোপসাধন। দেশের জন্য কাজটা ছিল ভয়ঙ্কর ক্ষতির, অথচ তিনি বলেছিলেন, পাটকলটি একটা অজগর, সবকিছু গিলে খাচ্ছে, তাকে শেষ না করলে পরিণতি দাঁড়াতো ভয়াবহ। দেশবাসী কিন্তু জানে অজগর যদি থেকে থাকে তবে সেটা হচ্ছে ওই প্রাইভেটাইজেশন; সবকিছু সে গিলে খেয়ে ফেলছে। এবং অজগরপন্থিরা ধারণা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে যে প্রাইভেট মানেই ভালো, আর পাবলিক হচ্ছে জঘন্য।
প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান সাহেব যে আমলাতান্ত্রিক জীবন শেষে রাজনীতিতে এসেছিলেন, এবং দলবদল করলেন তাতে বোঝা গেল তার কাছে প্রাইভেটই আসল বিবেচ্য, পাবলিক হচ্ছে প্রাইভেটের জন্য ব্যবহার্য এজমালি সম্পত্তি। বালাই ষাট, এটা তার একার নীতি হবে কেন, এটা তো বুর্জোয়াদের রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। এই যে এমপি হবার প্রাণপণ চেষ্টা, অঢেল টাকা ঢালা, এর পেছনে উদ্দেশ্য তো একটাই, পাবলিককে ব্যবহার করে প্রাইভেটলি বড় হওয়া। রাজনীতিতে আদর্শহীনতার অভিযোগ অন্যায় নয়, কিন্তু আদর্শবাদ তো একটা আছে, না-থাকলে চলবে কেন? হ্যাঁ, আছে, এবং তার নাম অন্যকিছু নয়, সুবিধাবাদ ছাড়া। সুবিধার টানেই তো এককালের বড় বড় বামপন্থিদের কেউ কেউ চুপসে গিয়ে সরকারি দলে শামিল হয়েছিলেন, সাম্প্রতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তেমন আভাস দেখা যাচ্ছে। সে টান এতো প্রবল যে নিজের কি দশা হবে তা খেয়াল করতে পারেন না; নিজেরা লজ্জা পান না, সে পাট আগেই চুকিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু অনুসারীদের এবং বামপন্থাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলেছেন। একের সুবিধায় দশের অসুবিধা, নিয়ম তো এটাই।
নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কাদা ছোড়াছুড়ি করতে কেউ দ্বিধা করে না। এটাই দাঁড়িয়েছে আমাদের নির্বাচনের অনিবার্য সংস্কৃতি। নির্বাচনে থাকবে যুদ্ধাপরাধীরাও এবং ইসলামপন্থিরাও। তাদের তো এখন প্রবল বাড়-বাড়ন্ত। তাদের গোপন আদর্শও ওই একই, সুবিধাবাদ। যে দিকে সুবিধা বেশি সেদিকেই যাবেন, সে-কাজে তাদের কোনো অসুবিধা নাই।
নির্বাচনের ঢালাও টাকা যা খরচ হয় তার অনেকটাই যায় বেকার যুবকদের হাতে। এদেরকে লুম্পেন বলা হয়। এরা দলের ভক্ত নয়, টাকার ভক্ত। বাংলাদেশে কর্মের সংস্থান বাড়ছে না; মেহনতিদের শ্রমের ওপর নির্ভর-করা উন্নতি কর্মহীনতা কমাচ্ছে না, বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশে বেকার সমস্যার ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি, আতঙ্কগ্রস্ত করার কথা দেশের শাসক শ্রেণিকে, কারণ এই সমস্যা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করবে; নির্বাচন উপলক্ষে লুম্পেনরা হাতে নগদ টাকা পাবে, উৎফুল্ল হবে, কিন্তু নির্বাচন শেষে এরা যখন দেখবে টাকার উৎস শুকিয়ে গেছে, তখন টাকার জন্য তারা নানা রকমের অপরাধে লিপ্ত হবে। ফলে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়বে, খুন-জখম-ধর্ষণের ভয়াবহতা, আগামীতে তা যে আরও বাড়বে; এমনটা না-ভাবার কোনো কারণ নেই।
ইসলামপন্থি দলগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী পুরানো পাপী, তাদের নৃশংসতার খবর আমরা রাখি; কিন্তু হেফাজতপন্থিরা যে-ভাবে কদম কদম এগিয়ে যাচ্ছে, আবার প্রশ্রয়ও পাচ্ছে তাও কম বিপজ্জনক নয়। হেফাজতপন্থিরা নির্বাচনে আসবে না, তারা তলোয়ার নিয়ে রাস্তায় নামবে। শাহবাগের গণজাগরণমঞ্চের সময়ে তাদের নৃশংসতার কিছু নমুনা ঢাকাবাসী পেয়েছিল। তাদের দাবিগুলোর কয়েকটির ভয়াবহতা অতুলনীয়; যেমন ধর্মদ্রোহিতা আইন চালুর দাবি। এই আইন পাকিস্তানে চালু হয়েছে; ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে এটা চালু করবার দাবি কেউ কখনো তুলতে পারবে এটা ছিল কল্পনার বাইরে! কিন্তু হেফাজত সে-দাবি ঠিকই তুলেছিল।
বিগত সরকার তাদের সমর্থন পেতে তাদেরকে ছাড় দিয়েছিল; তাদের-দেওয়া শিক্ষা-সনদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমমর্যাদা দানের বিগত সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেছে। শোনা যায় বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিমূল্যবান কিছু জমিতেও তারা স্থায়ী দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলেছে, সরকার বাধা দেয়নি। কওমী মাদ্রাসার ধারা থেকে হাজারে হাজারে মানুষ বের হয়ে আসছে; করবার মতো কাজ পাচ্ছে না; ফলে লুম্পেনদের বর্ধিষ্ণু বাহিনীতে আগামীতে এরাও যোগ দেবে, ওই বাহিনীর স্ফীতি ঘটাবে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা এখন তেমন শোনা যায় না, আগামীতে হয়তো অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলাও সম্ভব হবে না।
এই সব সম্ভাবনা যে মোটেই সুসংবাদ নয় সেটা বুঝতে কোনো কষ্ট নেই। সবচেয়ে ভালো ভাবে বুঝেছে দেশের ধনীরা। তারা তাই তাদের ভবিষ্যৎ দেশে না গড়ে বিদেশে গড়ে তুলছে। দেশে তারা কওমী মাদ্রাসার জন্য টাকা ঢালে, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পাঠায়, যে-বিদেশ থেকে ওই তরুণরা আর কখনো ফিরে আসে না। না-ফিরুক ক্ষতি নেই, কিন্তু তারা যে দেশের মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার কী হবে?
মূল কথাটা হচ্ছে এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। ব্যক্তি মালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় যাওয়া। সে কাজটা করার নেতৃত্ব দিতে হবে দেশের বামপন্থিদেরকেই। কিন্তু মুস্কিল হলো বামপন্থিরা শক্তিশালী নয়। তাদেরকে শক্তিশালী হতে দেওয়া হচ্ছে না। কোনো সরকার তাদেরকে পছন্দ করে না। বর্তমানের অন্তবর্তীকালীন সরকারও না। আর মিডিয়া তো পুরোপুরিই তাদের বিপক্ষে; তার কারণ হলো মিডিয়ার মালিকেরা সবাই ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে।
ইসলামপন্থি দলগুলো যে রাজনৈতিক ভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে, এবং সামাজিক ভাবে শক্তিশালী হচ্ছে তার প্রধান কারণ কিন্তু এই যে, ধনীদের মতো এরাও, ধনী-গরিব নির্বিশেষে, ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাসী। আগামী দিনে সেক্ষেত্রে ইসলামপন্থি দলগুলোই হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেবে। সেটা যে ভালো কোনো ব্যাপার হবে না তার প্রমাণ মার্কিন আধিপত্যে বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশকে আমরা নিশ্চয়ই মধ্যপ্রাচ্য করতে চাইবো না। দেশের ভবিষ্যৎ যে বামপন্থিদের শক্তির বিকাশের ওপরই নির্ভরশীল সেই সত্যটা ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে; আগামী নির্বাচন তাকে আরও পরিষ্কার করে দেবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়