‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কাজী কাদের নওয়াজের একটি কবিতা। কবিতায় যে চরিত্র এঁকেছেন কবি তাতে আছেন বাদশাহ আলমগীর, শাহজাদা শাহজাহান এবং একজন শিক্ষক। কবিতার ধারাবর্ণনায় দেখা যায়, আলমগীর-পুত্র শাহজাহান শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছেন। এটা দেখে বাদশাহ দূত মারফত ডেকে পাঠালেন শিক্ষককে। শিক্ষক শুরুতে ভয়ে তটস্থ, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে চিন্তা করলেন, তিনি শিক্ষক এবং শিক্ষক হিসেবে এখানে তিনি নীতিকথা শুনিয়ে বলবেন, ভুল কিছু করেননি তিনি।
কবিতার ভাষায় জেনে নিই পরের ঘটনা; “তার পরদিন প্রাতে/ বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।/খাস কামরাতে যবে/শিক্ষকে ডাকি বাদশাহ কহেন, 'শুনুন জনাব তবে,/পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?/বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,/ নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা।'/ শিক্ষকে কন— 'জাঁহাপনা, আমি বুঝিতে পারিনি, হায়,/কী কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?'/বাদশাহ কহেন, 'সে দিন প্রভাতে/দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে/নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,/পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।/নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে/ ধুয়ে দিল নাক কেন সে চরণ, বড় ব্যথা পাই মনে।”
নৈতিকতা আর মূল্যবোধ শেখার দুরন্ত উদাহরণ এ কবিতা। বাদশাহর পুত্র হলেও একজন শিক্ষকের কাছে ছাত্র যে কেবল ছাত্রই, অন্য পরিচয় নাই, এটাই শেখায় এ কবিতা। কবিতাটি শিখেছিলাম আমরা শিক্ষাজীবনের শুরুর পর্যায়ে। শিক্ষার্থীকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মানসে এই কবিতাটি আমাদের শেখানো হতো। কবিতাটি কেবল মুখস্থ করাই ছিল না উদ্দেশ্য আমাদের, ছিল এর অন্তর্নিহিত ভাবকে আয়ত্ত করার প্রচেষ্টা। আমাদের কালে আমাদের বেশিরভাগই শিক্ষকদের মর্যাদা দেওয়া শিখেছি পরিবার থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক থেকে এবং স্বাভাবিকভাবেই সমাজ থেকে।
আমাদের কালে শিক্ষকদের প্রতি আমাদের ভয় উদ্ভূত ছিল অনেকটাই সম্মান থেকে, শিক্ষকদের অবস্থান ভেবে। আর অন্যথা ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা সমাজের অন্য কোথাও কোনো শিক্ষককে অসম্মান করার চিন্তাও করা যেত না। এটা কেউ করলে তার যেমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জায়গা হতো না, তেমনি জায়গা হতো না পরিবারেও। সুদৃঢ় সামাজিক শৃঙ্খলা আমাদেরকে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান-ভক্তি প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছিল।
সে সময় আর শিক্ষকদের মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা বুঝি জাদুঘরে স্থান পাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন প্রায়শই শ্রেণিকক্ষ, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান আর সমাজের নানা জায়গায় শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রথম দিকে এটা সমাজকে নাড়া দিতে সক্ষম হলেও এখন এটা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
শিক্ষক নিগ্রহের এই ঘটনায় সম্প্রতি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ধর্মীয় ও আদর্শিক বিভাজন। ভিন্ন মতাবলম্বী বিশেষ করে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকেরা সামাজিকভাবে, শ্রেণিকক্ষে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন, সে তুলনায় আলোচনা হচ্ছে কমই। প্রতিবাদ দূরের কথা, বরং এটাকে সমর্থন করার লোকের অভাব হচ্ছে না দেশে।
মনে পড়ে, ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করান তৎকালীন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। ওই শিক্ষক ইসলাম ধর্ম ও আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন এমন এক অভিযোগ এনে স্থানীয় একটি মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, এবং এরপর সেলিম ওসমান শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করান।
এই ঘটনায় সারাদেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছিল। দেশের সকল শ্রেণির মানুষের বড় একটা অংশ রাজপথে নেমে এসেছিল। কান ধরে ওঠবস করার প্রতীকী প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এনিয়ে কমিটিও গঠন করেছিল। হাইকোর্টেও গিয়েছিল বিষয়টি।
এর বাইরে শত শত ঘটনা ঘটেছে দেশে যেখানে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থী, পরিচালনা কমিটি এবং নানা মহল থেকে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এসব প্রায়ই আলোচনা হয়েছে। তবে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টি বর্তমানে যেভাবে ধারাবাহিকভাবে ঘটছে তাতে একদিকে যেমন প্রথাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হচ্ছে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষকতার মহান পেশাকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন বিষয়টি এত ঘন ঘন ঘটছে যে, এনিয়ে আলোচনা হচ্ছে কমই।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সরকার পতনের পর থেকে দেশে ছাত্ররাই সর্বেসর্বা হিসেবে অনুভূত হচ্ছে। ছাত্রদের শক্তি বৃদ্ধির এই সময়ে তাদের নানা দাবি যেভাবে একের পর এক মেনে নেওয়া হচ্ছে, তাতে তারা নিজেদের আরও শক্তিশালী ভাবতে শুরু করেছে। তারা সচিবালয়ে হানা দিয়ে দাবির মুখে এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাও বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে আসতে পেরেছে। তারা রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদেরকে রাষ্ট্রের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের দাবির মুখে দেশের বিচারব্যবস্থার ওলটপালট হয়েছে, তাদের দাবিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়েছেন, তাদের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, পদত্যাগ করতে হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট অপরাপরদের।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ নতুন নয়। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এই পদগুলোতে ‘সাদা দলের’ শিক্ষকেরা নিয়োগ পেতেন। আওয়ামী লীগের আমলে এই জায়গায় নিয়োগ পেয়েছেন ‘নীল দলের’ শিক্ষকেরা। যে সরকারই ক্ষমতায় গেছে তারা নিজ নিজ আদর্শের শিক্ষকদের পদায়ন করেছে, বিবিধ সুযোগসুবিধা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলেও এটা ব্যতিক্রম ছিল না।
সরকারপতনের পর নীল দলের এই শিক্ষকেরা তাদের কর্তৃত্ব হারিয়েছেন সর্বত্র। এখন তাদের সরানো হয়েছে, এবং ইতোমধ্যে যাদেরকে সরানো হয়েছে, সেই জায়গায় দখল পেয়েছেন সাদা দলের শিক্ষকেরা। ফলে ‘সংস্কার’ নামে যা বলা হচ্ছে, সেটা আদতে মুখের পরিবর্তন, এক মতাদর্শকে সরিয়ে আরেক মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা।
এটা গেল রাজনৈতিক দিক। কিন্তু এরবাইরে যা হচ্ছে সেটা হচ্ছে, চাপ দিয়ে অনেক শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা। অনেক শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করতে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণের খবর আমরা জেনেছি। এটা করছে শিক্ষার্থীরাই। শিক্ষকদের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রকাশের যে নৈতিকতা সেটা বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে।
সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি দেখা গেছে আরেক ভয়াল কর্মসূচি। শিক্ষকদের প্রতি ‘জুতা নিক্ষেপ গেমস কর্মসূচি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজম্যান্ট বিভাগের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীর ব্যানারে এই কর্মসূচিতে ওই বিভাগের একাধিক শিক্ষকের নামোল্লেখ করে তাদের ছবিতে জুতা নিক্ষেপের মতো একটা কর্মসূচির ফটোকার্ড সামাজিক মাধ্যমে বহুল প্রচার হয়েছে। বিষয়টি সুবিবেচনাবোধ থাকা মানুষদের কাছে বিব্রতকর একটা কর্মসূচি হলেও অনেকের কাছে এটা ছিল আনন্দের মুহূর্ত বা ঘটনা। বিষয়টি আমাদের হতাশা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট, বিশেষ করে এই ধরনের কর্মসূচির সমর্থকদের নামের পাশে যখন সামাজিক মাধ্যমে ইতিবাচক ভাবমূর্তি থাকা লোকজনেরাও সমর্থন করে প্রচার করে থাকে। এসব দেখে কেবল আক্ষেপ প্রকাশ করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার থাকে? এসব নিয়ে আমরা সত্যি বিব্রত, হতাশ ও লজ্জিত।
যেকোনো জাতিকে সুশিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা শিক্ষা দিতে অগ্রণী ভূমিকায় থাকেন শিক্ষকেরা। মা-বাবা সন্তানদের জন্ম দেন ঠিক, কিন্তু শিশুর ‘দ্বিতীয় জন্ম’ হয় শিক্ষকদের মাধ্যমেই। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ ছিল, কিন্তু এটা এখন লুপ্তপ্রায়। পরিবর্তিত দেশ পরিস্থিতিতে শিক্ষকেরা যে কতখানি কোণঠাসা এবং শঙ্কার মধ্যে সাম্প্রতিক শিক্ষক নিগ্রহের ধারাবাহিকতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো প্রতি বছরের ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। ইউনেসকোর সদস্যভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এদিনটি পালন করা হয়ে থাকে। কিন্তু নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ শিক্ষক সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের সম্মানের বাস্তবতার চিত্রায়ন করছে না।
জায়গায়-জায়গায় আমরা শিক্ষক নিগ্রহ দেখছি, কিন্তু ‘প্রতিবাদে কী হয়’ ভেবে নিজেদের প্রতিবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। ফলে কিশোর বয়েসিরা শিক্ষকদের মানসম্মানকে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষকতা পেশায় আছেন যারা তারা কখন কীভাবে কার দ্বারা আক্রান্ত হন এ আশঙ্কায় দিন যাপন করছেন। এ সত্যি ভীতিকর পরিস্থিতি।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। কিশোর-যুবারা আগামীর নেতৃত্বের অংশ, ঠিক এখানে চিন্তাকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদেরকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে এগিয়ে আসতে হবে। যারা শিক্ষক নিগ্রহের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিতে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে, কঠোর হতে হবে অভিভাবকদেরও।