ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ধারাবাহিকতায় পদত্যাগ করতে শুরু করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সরকারের আজ্ঞাবহ এসব উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলা, তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনসমূহকে প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া এসব শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর নৈতিক যোগ্যতা হারিয়েছেন।
সর্বশেষ তথ্যমতে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের অন্তত ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যশূন্য রয়েছে। এতে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ কার্যত অচলাবস্থায় পড়েছে বিশ্ববিদ্যায়গুলো। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ক্লাসও শুরু হয়নি। ইতোমধ্যেই অন্তবর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করতে দ্রুত পদায়ন করা হবে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকশূন্য, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলো চালু করতে হবে। সরকারের উচ্চমহল বলছে, সত্যিকার শিক্ষানুরাগী, যোগ্য এবং প্রশাসনিকভাবে দক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হবে।
দেশের পুরনো ও বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে আসছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নিবার্চনের বিধান আছে। বিধান অনুসারে সিনেট সদস্যদের ভোটে উপাচার্য পদে তিনজনের প্যানেল নির্বাচিত হয়। পরবর্তীতে নির্বাচিতদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যায়ের আচার্য যে কোনো একজনকে নিয়োগ দেন। অবশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের সরাসরি পছন্দে উপাচার্য নিয়োগের রীতি রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ হয়ে আসছে। দক্ষতা ও যোগ্যতার তুলনায় উপাচার্যদের রাজনৈতিক অবস্থান ও দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নই এখানে মুখ্য ও প্রধান যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হতো। সরকারের নানা মহলের মদদে এসব উপাচার্যরা নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বছরজুড়ে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় কর্মী ও স্বজনদের নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসগুলোতে উপাচার্যদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেছেন।
উপাচার্যদের পদত্যাগের পর রেজিস্ট্রারসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও পদত্যাগ করেছেন। এতে করে অ্যাকাডেমিক কাজের পাশাপাশি অন্যান্য প্রশাসনিক কাজেও জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট উত্তোলন, ফলাফল প্রকাশ এসব বিষয় সুরাহা হয়নি। উপাচার্য না থাকায় এগুলো করা সম্ভবও হবে না। এমনকি উপাচার্য না থাকায় বেতন পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ও আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত কর্মচারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন দাপ্তরিক কাজগুলোয়ও ব্যাঘাত ঘটছে। প্রক্টরিয়াল বডি এবং হল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য থাকায় আবাসিক হলগুলোয় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে নতুন করে সেশনজটের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সিনেট-সিন্ডিকেট-অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের পদত্যাগের পর আশার আলো দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। এতদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন তারা। তবে একসঙ্গে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্যও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা দিয়েছে। আগের ধারা ভেঙে এ পদে অরাজনৈতিক অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিকভাবে দক্ষ ও যোগ্য জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের খুঁজছে শিক্ষা প্রশাসন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, উপাচার্য নিয়োগে শিক্ষকদের অ্যাকাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং সততার রেকর্ড বিবেচনায় নিতে হবে। ৭৩ অ্যাক্টের বাইরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের সুস্পষ্ট বিধিমালা থাকা প্রয়োাজন। একটি নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
উপাচার্য এমন একটি পদ যার পুরো পলিসির ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কার্যাবলী আবর্তিত হয়। প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্য একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা আমূল বদলে দিতে পারেন। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসছেন। এসময় দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচলাবস্থা কাটিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারবেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অন্তবর্তীকালীন সরকার বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য শিক্ষক খুঁজে বের করতে সময় নিচ্ছে। কারণ বিগত সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা বেশিরভাগই কোন নির্দিষ্ট দলের হয়ে ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই উপাচার্য হিসেবে পছন্দের প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকে আবার বিভিন্ন মহলে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। সবকিছু ছাপিয়ে যত দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ দেয়া যায়, ততই মঙ্গল। কারণ এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও জাতির একটি বড় অংশের আশা-আকাঙ্ক্ষা জড়িত।
লেখক: নোমান বিন হারুন, সাধারণ সম্পাদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব