বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও বহুমাত্রিক। আবার এই দুই নিকট-প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পর্শকাতরও বটে। ফলে উভয় দেশের সম্পর্ক ভারসাম্য, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে ইতিবাচক পথে অগ্রসর হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য খুবই জরুরি। বিশেষত, উত্তর-পূর্ব ভারত ও পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং মিয়ানমারে অব্যাহত সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উভয় দেশকেই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়াই মঙ্গলজনক। কিন্তু এই সম্পর্ক নষ্ট করতে উভয় দেশের সদিচ্ছার পরেও নানামুখী ষড়যন্ত্র রয়েছে। এজন্য উভয় দেশকেই সজাগ থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ইতিবাচক গন্তব্যে এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ভাষণে ভারতসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তবে সেই সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে। ভারতের সঙ্গে আমরা ইতোমধ্যে বন্যা মোকাবিলায় উচ্চপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আলোচনা শুরু করেছি । দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমি সার্ক রাষ্ট্র গোষ্ঠী পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে সম্মানের সঙ্গে পরিচিত হয়। দেশের পরিকল্পনা যেন দেশের মানুষ কেন্দ্রিক হয়, কোনও নেতা বা দল কেন্দ্রিক নয়।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে কাজ করে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নতুন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি দুই দেশের জন্য প্রযোজ্য শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা অর্জনের জন্য আমরা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করে যাব।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের ক্ষমতার পরিবর্তনের পর পরই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। উভয় দেশই আশা করেছে যে, বাংলাদেশ-ভারতের ঐতিহাসিক ও নিবিড় সম্পর্ক অটুট ও অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এইসব আশাবাদ তখনই সফল হবে, যখন দুই দেশের সম্পর্ক বিনষ্টের নানা ষড়যন্ত্র দমন করা যাবে এবং উচ্চপর্যায় থেকে হটকারিতা পরিহার করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূ-রাজনীতিতে সম্পর্ক উন্নয়নের মাত্রা যেমন আছে, সম্পর্ক অবনতির প্রবণতাও রয়েছে। রয়েছে নানামুখী চক্রান্ত যা বিভিন্ন দেশের সম্পর্ককে বিঘ্নিত করতে প্রকাশ্য ও গোপনে কাজ করে। সরকারগুলোতে এজন্য অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকা অপরিহায।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ্য করা যায়, ভারতীয় মিডিয়ার আচরণের বিষয়গুলো। বাংলাদেশে যখন ছাত্রগণআন্দোলন হয়, তখন তাদের প্রচারণা নিয়ে নানা সন্দেহ দেখা দেয়। বিশেষত, ছাত্র-জনতা, এমনকি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যখন হিন্দু বাড়ি ও মন্দির পাহারা দিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলায় সাফল্য দেখাচ্ছিল, তখন ভারতীয় মিডিয়ায় উস্কানীমূলক প্রচারণা লক্ষ্য করা গেছে। শান্তির পক্ষে না দাঁড়িয়ে অশান্তির প্ররোচণা সে সময় ভারতীয় মিডিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও অবিশ্বাসযোগ্য করেছিল।
হতাশার বিষয় হলো, তৃতীয় শ্রেণির প্রোপাগান্ডা ভিত্তিক নিম্নস্তরের মিডিয়ায় সঙ্গে পুরনো ও পেশাগত সংবাদমাধ্যমও সুর মেলাতে দেখা গেছে। সেই সঙ্কুল পরিস্থিতির পর এখনও ভারতের নানা মিডিয়ায় এমন খবর প্রকাশ পাচ্ছে, যা শুধু আপত্তিকরই নয়, সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। যেমন, ইন্ডিয়া টুডের-এর মতো পত্রিকার ভিডিও রিপোর্টে বলা হচ্ছে, নতুন সরকার ভারতের জন্য হুমকি, নতুন সরকারের অধীনে বাংলাদেশ হয়ে গেছে পাকিস্তান ২.০। এমনকি, কিছু কথিত ‘বাংলাদেশী জঙ্গি‘র সাক্ষাতকার প্রচার করে উত্তেজনাও ছড়ানো হচ্ছে। ভারতের সরকার এসব দেখতে না, এটা বিশ্বাস করা মুস্কিল। ভারতের মাটিতে ও ভারতের মিডিয়ায় এ ধরনের বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে ভারতের সদিচ্ছার বিষয়টি চরমভাবে বিতর্কিত হবে এবং পরিণামে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা কোনও দেশের জন্যই কাম্য বা কল্যাণকর হবে না।
ভারতের দিক থেকে এই বাস্তবতা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের একটি ভারত-বিরোধী রাজনৈতিক স্রোত বহু আগে থেকেই রয়েছে। তাছাড়া, বিগত হাসিনা সরকারকে সাধারণভাবে মনে করা হয় ভারতপন্থী। আর বর্তমানে হাসিনা রয়েছেন ভারতের আশ্রয়ে। ফলে ভারতের মাটিতে বা মিডিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানী তৈরি করা হলে বাংলাদেশের জনমনে এর প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক, যা ভারত-বিরোধিতার মাত্রাকে আরও বাড়াবে।
উচ্চপর্যায় থেকে হটকারি মন্তব্যও অনেক সময় পারস্পরিক সম্পর্কের হানি ঘটায় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণ হয়। যেমনটি হয়েছে সাম্প্রতিককালে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং কে ক্ষমা চাইতে হবে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা ও বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, আপনারা মন্ত্রী আমিও কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেজন্য আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মন বড়। তারা ক্ষমা করতে জানে। সুতরাং বাংলাদেশ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিবেন না সেটা কেউ মেনে নেবে না।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ১২ দলীয় জোটের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ ভারতের আগ্রাসী বক্তব্যের প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। তাছাড়া, ভারত বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে নয় বরং শেখ হাসিনার ‘জমিদারি’ ফেরত দিতে কাজ করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের সরকার বা মিডিয়ার পক্ষ থেকে অহেতুক বিতর্ক ও উস্কানি সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক বক্তব্য বা মিথ্যা প্রচারণা পরিস্থিতিকে নাজুক করবে। সেসব বুমেরাং হয়ে ভারত বিরোধিতায় পযবসিত হবে। ভারত বিরোধীরা সমালোচনা ও বিরোধিতার হাতিয়ার পাবে। সম্পর্ক ভালো করার বদলে নষ্ট করার প্রচেষ্টা বা বিরোধিতা করার অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়ার মতো অপরিপক্ব কাজ কোনও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন ও সুবিবেচনার পরিচয় হতে পারে না। বরং এগুলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিনষ্টের ষড়যন্ত্র স্বরূপ। অতএব, ভারতের মাটিতে বা মিডিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানী ও মিথ্যাচার সম্পর্কে উভয় দেশের সচেতন মানুষ, বস্তুনিষ্ট মিডিয়া ও সরকারকে সর্তক থাকা দরকার এবং নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভারসাম্য, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।