রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা হলেও তাদেরকে সেদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাদের নিজস্ব রাজ্য আরাকানের নামও বদলে রাখা হয়েছে রাখাইন রাজ্য। রোহিঙ্গাদের গণহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিতাড়িত করা পর মিয়ানমার এখন জোরোসোরে প্রচার করছে যে, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিকই নয়। তারা অবৈধ ভারতীয়/মুসলিম/বাঙালি অভিবাসী। এখন বলা হচ্ছে তাদের আদিবাস ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, যেখান থেকে তারা মিয়ানমারে গিয়েছিল।
ভারতীয় গবেষক শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি ৫ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে ‘রোড ফর রাখাইন: আনসার্টেইন ফেট অব রোহিঙ্গা‘ শিরোনামে এক লেখায় জানাচ্ছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দ্বারা "অবৈধ বাঙালি অভিবাসী" হিসাবে বিবেচিত হয় কারণ তারা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়।
দিল্লির অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি রোহিঙ্গা বিষয়ে একাধিক লেখার রচয়িতা এবং মিয়ানমার সরকারের নানা ভাষ্য ও তথ্যাবলি তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন, মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে, তাদের কার্যত রাষ্ট্রহীন করে দেয়। ফলে তারা শিক্ষা, চলাফেরার স্বাধীনতা, পেশা, এমনকি বিবাহের মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। তারা সময়ে সময়ে এলোপাতাড়ি গ্রেপ্তার, জোরপূর্বক শ্রম এবং সম্পত্তি দখলের সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক গণহত্যার শিকার হয়ে দেশত্যাগেও বাধ্য হয়।
রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও দেশ থেকে বিতাড়নের বিষয়গুলোকে জায়েজ করতে মিয়ানমার গোড়া থেকেই তাদেরকে অবৈধ ভারতীয়/মুসলিম/বাঙালি অভিবাসী বলছে। যদিও সাবেক বার্মা ও মিয়ানমারের ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ইতিহাসে দেখা যায়, বার্মার রাজনৈতিক ইতিহাসে রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। ব্রিটিশের কবল থেকে বার্মাকে মুক্ত করতেও রোহিঙ্গারা বীরোচিত ভূমিকা পালন করেছে ও সে দেশের শাসনতান্ত্রিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। তবে পরবর্তীতে এই সংখ্যালঘু মুসলিম জাতিগোষ্ঠী বার্মার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রধান জাতিগুলোর দ্বারা বৈষম্য ও নির্যাতন কবলিত হয় এবং নানা সময়ে আক্রান্ত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে আসতেও বাধ্য হয়, যাদের সিংহভাগই বাস করছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে।
বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বার বার বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। রাষ্ট্রহীন ও নাগরিকতাহীন উদ্বাস্তু হিসাবে কমপক্ষে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছে। এদের কারণে বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট নানামুখী সমস্যা ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে জটিল আকার ধারণ করছে। এরই মাঝে এখন বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের আদিবাস ছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, যেখান থেকে তারা মিয়ানমারে গিয়েছিল।
কেন রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভূত বলা হচ্ছে? এই বিষয়টি নতুনভাবে ধীর লয়ে বলা হলেও বাংলাদেশের নীতি নির্ধারক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের তরফে তা মোটেও উপেক্ষা করার বিষয় নয়। কারণ, বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে থেকেই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান, যা সাম্প্রতিক সময়ে আরও তীব্র ও সংঘাতময় হয়েছে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের মতো আরেকটি তৃতীয় পক্ষকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার মতলব খুবই মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এতে:
১) মিয়ানমারের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বদলে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভূত বলে সেখানে পাঠানোর ব্যাপারে চাপ দেওয়ার সুযোগ বাড়বে।
২) পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি জাতিগত উত্তেজনা রোহিঙ্গাদের কারণে আরও অগ্নিগর্ভ হতে পারে।
৩) এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার পর্যন্ত প্রসারিত বাংলাদেশের কৌশলপূর্ণ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা চরম নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।
এসব কারণে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের নানা পদক্ষেপ, বক্তব্য ও কৌশল বাংলাদেশের তরফে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষা করে কার্যকরী প্রতি-ব্যবস্থা গ্রহণের কোনও বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে:
১) রোহিঙ্গারা যে অনাদীকাল থেকে মিয়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের ভূমিপুত্র বা আদিবাসী, তার ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত হাতে রাখতে হবে।
২) রোহিঙ্গা জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি যে মিয়ানমারের মূল জাতিসত্তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার দালিলিক প্রমাণগুলোকে তুলে ধরতে হবে।
৩) নির্যাতিত হয়ে নিছক আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ ও ভূখণ্ডের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যে আদৌ কোনও সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই, এই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করতে হবে।
৪) আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিজ দেশের রোহিঙ্গা নাগরিকদের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরতে হবে।
৫) রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এরই সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশকে পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে, যাতে সেখানকার সশস্ত্র ঘটনার প্রভাব রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে না পারে। যদিও এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলে মিয়ানমারের সরকার বিরোধী আরাকান আর্মি-এর কর্তৃত্ব ও প্রভাব যতই বাড়ছে রোহিঙ্গারা ততই বিপদে পড়ছে। কারণ, আরাকান আর্মি কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে, মিয়ানমারে তথা রাখাইনে যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
শুধু তাই নয়, সেখানকার সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে প্রতিদিনই অল্প অল্প করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানকার গোলা-বারুদ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূমিতে এসে জান-মালের ক্ষতি সাধন করছে। উপরন্তু কক্সবাজার টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকারকালে বাংলাদেশের জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক জলসীমানা লংঘন করার মতো ঘটনাও আকসার ঘটছে মিয়ানমারের তরফে।
ফলে পুরো পরিস্থিতিকে মিয়ানমার নাজুক করছে এবং অমীমাংসিত রেখে নানা ধরনের জাতীয় ও আঞ্চলিক বিপদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এমতাবস্থায়, ভবিষ্যতহীন রোহিঙ্গা নাগরিকদের যে বিপুল অংশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছে, তাদের পদক্ষেপ ও মনোভাব নজরে রাখা আবশ্যক। অনিশ্চয়তার কারণে তারা কোনও হটকারি পথে অগ্রসর হলে কিংবা কোনও সুযোগ সন্ধানী পক্ষ তাদেরকে বিপথগামী করে উত্তেজনা ও সংকট বাড়িয়ে তুললে তার দায় কে নেবে? স্বদেশে ফেরার কোনও আশা না দেখে মিয়ানমারের কথা মেনে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে নজর দিলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
আশার কথা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক ফোরামে সরব আছে। এটি একটি ভালো দিক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিপদ আরও বাড়লে আশার জায়গা দখল করবে হতাশা ও অনিশ্চয়তা। ফলে সরকারের তরফে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গা বিষয়ে অধিকতর মনোযোগ দেওয়ার দরকার আছে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।