শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে মায়েরা কত কৌশলই না নেন। কেউ কল্পলোকের পরীকে নামিয়ে আনেন, কেউবা ডাকাতের গল্প শুনিয়ে জেগে থাকা শিশুকে ঘুমের জগতে নিয়ে যান। গ্রামীণ জনপদের নিকষ অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকা আর দূরে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকে মায়ের মুখে বলা গল্পগুলো সত্যিই এক ভীতি জাগানিয়া অবস্থার সৃষ্টি করতো। স্মৃতি হাতরে এমন বহু গল্পের কথা মনে করা যাবে।
তবে এক সময়ের বনাঞ্চল ঘেরা গাজীপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলিতে মায়েরা যেসব গল্প তাদের শিশুদের শোনাতেন তার অনেক কিছুই বাস্তবেও প্রমাণ মিলত। তখনকার দিনে ডাকাতের গল্পে শিশুরা সত্যিই ভীষণ ভয় পেত আর মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তো।
অধুনা ভাওয়ালের শ্রীপুরের বিধাই-আবদার, গফরগাঁওয়ের ডুবাইল কিংবা ভালুকার হজঙগাঁওয়ে ছিল দুর্ধর্ষ সব ডাকাতদের আখড়া। গফরগাঁওয়ের বাগড়া গ্রাম থেকে বিস্তীর্ণ চারণভূমি পেরিয়ে মশাখালী যেতে ডাকাতদের খামারের অস্তিত্ব বাস্তবেই ছিল। সেসব স্থানে মানুষ দিনের বেলায় যেতেও ভয় পেত।
উপরের যে গল্প তা তিন-চার দশক আগেকার। বর্তমানে নগরায়নের তাণ্ডবে বনাঞ্চল নিঃশেষ হওয়ার পথে। বিদ্যুতের আলো পৌছে গেছে দূরগ্রামের শেষপ্রান্তেও। সমাজের এই যে রূপান্তর তা জনমানসে কেমন প্রভাব ফেলেছে তার স্বরূপ দেখতে চাইলে আমরা দৃষ্টিপাত করতে পারি, সিলেটের কানাইঘাটের ফুটফুটে শিশু মুনতাহাকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
যদি খুব মনে করার চেষ্টা করি তবে শৈশবের দিনগুলিতে কালেভদ্রে এমন নির্মমতার কথা শোনা যেত। কিন্তু তা ঘটতো একেবারেই পেশাদার ডাকাত কিংবা খুনীদের দ্বারা। সেই পরিস্থিতি উল্টে গিয়ে এখন নিত্যদিনই এমন পৈশাচিকতার খবর সংবাদপত্রে আসছে।
খবরে জানা গেছে, শিশুটি নিখোঁজের ঘটনায় গতকাল (শনিবার) রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিবেশী মার্জিয়া আক্তারকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। মেয়ে আটকের পর মার্জিয়ার মা রাতেই ডোবায় পুঁতে রাখা মুনতাহার লাশ তুলে পুকুরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশীরা পুকুরে লাশ ফেলে দেওয়ার আগেই আলিফজানকে ধরে ফেলে করে।
পুলিশ গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, ৫ বছরের শিশু মুনতাহার গলায় রশি প্যাঁচানো ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে শিশুটিকে হত্যা করা হয়। আটক মার্জিয়া ও আলিফজানকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাথমিকভাবে হত্যার দায় স্বীকার করে জানিয়েছে, মুনতাহার বাবার সঙ্গে তাঁদের বিরোধ ছিল।
প্রকাশিত খবরে বোঝা গেল, এই হত্যাচক্রে নারীরা যুক্ত ছিলেন। এও জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া মার্জিয়া নিহত শিশুটির গৃহশিক্ষকও ছিলেন। আমরা অবশ্যই আশাকরি, পুলিশি তদন্তে নিশ্চয়ই হত্যার বিস্তারিত কারণ উদঘাটিত হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যা প্রতীয়মান হচ্ছে তাতে সমাজের প্রান্তিকে পৈশাচিকতার বিস্তার কি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা বোঝে নিতে খুব কষ্ট হওয়া কথা নয়। মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতির কি চরম পর্যায়ে পৌছালে বাবার প্রতি আক্রোশ চরিতার্থ করতে একটি ফুটফুটে শিশুকে হত্যার টার্গেট করতে পারে!
সমাজের এই বিৃকত রূপান্তর নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা আদৌ কোন গবেষণা করছেন কিনা আমাদের জানা নেই। তবে মস্তিষ্ক বিকৃতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয় যে আমাদের সব শুভপ্রবৃত্তিকে পরাজিত করেছে তা না মেনে নেওয়ার কোন কারণ নেই। মায়ের হাতে কিংবা বাবার হাতে সন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন ইত্যাদি অঘটন এত ব্যাপকহারে ঘটে চলছে যে একটির ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটি ঘটনা আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
আলোচিত পুলিশ দম্পতি হত্যায় তাদেরই মেয়ে ঐশীর সম্পৃক্ত থাকার খবর কি চাঞ্চল্যই না সৃষ্টি করেছিল! কিন্তু সময়ের স্রোতে আরও কত ঐশী আমাদের সমাজ তৈরি করে ফেলেছে, তার খবর হয়ত আমরা রাখিনি। হয়ত মুনতাহা হত্যা তদন্তে আরও রোমহর্ষক বিবরণ প্রকাশ্যে আসবে। পাঁচ বছরের শিশুটি অন্তিম মুহূর্তে কি বলেছিল? একরত্তি মেয়েটির মৃত্যু কিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল? কয়জন অংশ নিয়েছিল সেই কিলিং মিশনে? ইত্যাদি বহু জিজ্ঞাসার জবাব আমাদের মনে কি দাগ ফেলবে? প্রকৃতঅর্থে শিশু মুনতাহার হত্যা কোন একক ঘটনা নয়। সার্বিক বিচারের এটি বহু ঘটনারই সমষ্টি। পচে যাওয়া সমাজের নগ্ন স্বরূপ এটি।
অনেকে বলছেন, আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন মানুষের এই কুপ্রবৃত্তিকে প্রকট করে তুলছে। বাঙালি যে কোন কিছুই দ্রুত গ্রহণ করতে পারে, এই দুর্ণাম ধরে নিয়েও যদি আমরা বিচার করি-তবে পৈশাচিকতাকে উসকে দেওয়া বিনোদনমাধ্যমের বিষয়ে আমরা কি কিছু ভেবেছি? লোক দেখানো ধর্মাচারণের যে প্রবল প্রবণতা সমাজকে গ্রাস করছে, আমরা কি সেই বিষয়ে কোন প্রশ্ন তুলেছি? এমন বহু প্রশ্নের পাহাড় ঠেলে আমরা বলতেই চাই, আমাদের রাষ্ট্র অনাগত মুনতাহাদের রক্ষায় আদৌ কি সচেষ্ট হবে?