বিষয়টি কিছুটা বিদ্রূপাত্মকই বটে। ২০২৪ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির অবসানের আন্তর্জাতিক দিবস (আইডিইএ) উপলক্ষ্যে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় ইউনেস্কো সম্মেলনে যখন যোগ দিয়েছিলাম আমি বাংলাদেশে তখন স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘হত্যার অভিযোগ’ আনা হয়। যাদের মধ্যে অন্তত চারজন এখন কারাগারে।
এসব অভিযোগ এতটাই প্রহসনমূলক এবং ভিত্তিহীন যে, এর ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে আদ্দিস আবাবা সম্মেলনে তখনও এই প্রসঙ্গটি সম্মেলনে উত্থাপিত হয়নি।
ইউনেস্কো সম্মেলনে যা উঠে এসেছে তা হল, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলিতে যেখানে সাংবাদিকরা কেবলমাত্র সহিংস আক্রমণের মুখোমুখিই হননি বরং প্রতিপক্ষের আক্রমণকারীদের দ্বারা অনেক জায়গায় লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়েছেন। যদিও আক্রমণকারীরা সরকারের কাছ থেকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তিই ভোগ করে আসছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে গাজায় সাংবাদিকদের নির্বিচার হত্যার সাম্প্রতিক ইতিহাস সবচেয়ে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। দ্য গার্ডিয়ান এবং এনবিসি নিউজের মতো গণমাধ্যম ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্র অনুসারে, ৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৩৪-১৪৭ জন সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মী, ১২০ জন শিক্ষাবিদ এবং ২২৪ জনেরও বেশি শ্রেণিপেশার মানুষ নিহত হয়েছেন। অন্তত বলতেই হবে, পশ্চিমা মিডিয়া এবং মিডিয়া সুরক্ষা সংস্থাগুলি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই অপরাধের বিষয়ে যে আশ্চর্যরকম নীরবতা তা সত্যিই লজ্জাজনক।
সম্মেলনে ইউনেস্কো এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের দ্বারা উপস্থাপিত একটি যৌথ গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, ‘অনেক সাংবাদিক স্বাধীন, নির্ভরযোগ্য এবং যাচাইযোগ্য তথ্য তৈরি করার জন্য মৃত্যু, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, বেআইনি আটক এবং অপহরণ সহ চড়ামূল্য দিয়েছেন।’
সংঘাতপূর্ণ এলাকায়, ২০২২-২০২৩’র মধ্যে সাংবাদিকদের হত্যার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সংঘাতের সম্মুখীন বেশিরভাগ আফ্রিকার দেশগুলিতে এ ঘটনা ঘটেছে (গাজার ঘটনা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি), যেখানে ২০২৩-২০২৪ অন্তত ১৪ জন সাংবাদিক নিহত হন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) অনুসারে, ২০২৪ সালে একই অঞ্চলে ১৪ জন সাংবাদিক নিখোঁজ এবং ৩২ জন সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে। ১২টি সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশে, মানহানি, সেন্সরশিপ লঙ্ঘন, রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবেদন করা, ধর্মীয় অবমাননা ইত্যাদির অভিযোগে কমপক্ষে ৪৭ জন সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে।
পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের জন্যও একটি নতুন বাস্তবতা উঠে আসছে। জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়গুলি যেমন ঘন ঘন ঘটছে, তেমনি সাংবাদিকরা তাদের কাজের জন্য গুরুতর হুমকি এবং চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০২৪ সালের মে মাসে, বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম দিবসের জন্য ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উল্লেখ করা হয় পরিবেশগত সমস্যাগুলি কভার করা সাংবাদিকদের ৭০ শতাংশ পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে আক্রমণের শিকার।
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও এই অবস্থা একইরকম হতাশাজনক। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) অনুসারে ১৯৯২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হওয়া মামলার কোনোটিরও বিচার হয়নি।
প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ‘গত আড়াই দশকে, অন্তত ১৩ জন সাংবাদিক হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলি দৃশ্যত সময়ের আবর্তে হারিয়ে গেছে। অভিজ্ঞতাগুলি সবার জন্য প্রায় একই। তদন্তের মাধ্যমে নেতিবাচক আবর্তে ধাবিত করা। এ যেন এক গোলকধাঁধা বিচারিক জগাখিচুড়ি! এক্ষেত্রে তদন্তের যেমন শেষ নেই, অপরাধীদের খুঁজে বেরও করারও তাড়া নেই—সব মিলে সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সংস্কৃতি!
আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে, সাংবাদিকদের জন্য উদ্বেগের একটি নতুন কারণ নেমে এসেছে-ব্যাপক হারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা। এক মাস আগে প্রকাশিত আমার কলামে লিখেছিলাম, ‘...ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও রাজশাহীতে ১২৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা, খুনের চেষ্টা ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে।’
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে মামলা দায়ের বন্ধ হলেও যাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে মামলা রয়েছে তারা ভুক্তভোগী রয়েই গেছেন। যদিও তারা কারারুদ্ধ নন, তবে তাদের জীবিকা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। অনেকের পেশাগত জীবন সম্পূর্ণ ধ্বংসের সম্মুখীন। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তারা প্রতিনিয়ত পুলিশ কর্তৃক তুলে নেওয়ার বা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং পেশার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ক্রমাগত ভয়ের মধ্যে থাকছেন। এতে প্রভাবিত হয়েছে তাদের পরিবারের দৈনন্দিন জীবনও। তাদের সন্তানরা স্কুলে যেতে কিংবা পরীক্ষায় বসতে ভয় পাচ্ছে।
এরই মাঝে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কয়েকদিন আগে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘গণহারে মামলার দায়েরে সরকার বিব্রত।’ তিনি এও বলেছিলেন যে, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার এবং পূর্ববর্তী শাসনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই মামলাগুলি দায়ের করছে-সরকার নয়।
তবে তা সত্ত্বেও গণহারে মামলা সরকার কর্তৃক যদি নাও করা হয় কিন্তু তা বন্ধ করা হবে বা দায়ের করার আগে নিদেনপক্ষে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হবে-আইন উপদেষ্টার বিবৃতিতে তা অনুপস্থিত ছিল। সাংবাদিকতায় ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকায়, বিশেষ করে একজন কলামিস্ট হিসেবে, আমরা আশা করেছিলাম এবং এখনও আশা করি, তিনি (আইন উপদেষ্টা) সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই কাল্পনিক হত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’ (সিপিজে) এর সিইও জোডি গিন্সবার্গ সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করে যে ইমেল করেছেন যা এই নিবন্ধে উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমটি হল ‘দমনমূলক আইনের উপর অবিলম্বে স্থগিতাদেশ আহ্বান, যা বাংলাদেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে ক্ষুন্ন করে। যার মধ্যে রয়েছে দণ্ডবিধির অধীনে ফৌজদারি মানহানি এবং ১৯২৩ সালের ঔপনিবেশিক যুগের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-বাতিল বা সংশোধনী স্থগিত। এটি অবশ্যই তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।’
বাংলাদেশের নতুন যাত্রার শুরুতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার প্রতিফলিত করবে। ইতিহাস আমাদের পথ দেখায় যে, যখনই আমরা নতুন করে শুরু করার সুযোগ পাই, তখন আমরা প্রায়শই অতীতের উপর খুব বেশি এবং ভবিষ্যতের উপর খুব কম চিন্তা করি। এই সময়টি ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে, কারণ অধ্যাপক ইউনূসের সরকার দূরদর্শী পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমসহ ছয়টি নতুন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। আমরা আশা করি, মিডিয়া সংস্কার কমিশন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনকে স্পষ্ট করতে একটি আইনি কাঠামো তৈরি করবে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের একটি স্থায়ী উপাদান করে তুলবে।
আমরা ‘সাংবাদিকদের কৃতকর্মের প্রতিশোধ নিতে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা শত শত ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার বা বাতিলে’ সিপিজে-এর পরামর্শগুলিকেও অকুণ্ঠ সমর্থন করি৷ বিগত সরকারের দায়ের করা অনেক মামলা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, যার উদ্দেশ্য ছিল নির্দিষ্ট গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের শাস্তি দেওয়া। এগুলো অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের মামলা প্রত্যাহারও হওয়া উচিত।
বর্তমান সরকারের আমলে দায়েরকৃত হত্যা মামলার ক্ষেত্রে প্রমাণ ছাড়াই সেগুলো পর্যালোচনা করে খারিজ করার চেষ্টা করা উচিত। এই ধরনের পদক্ষেপগুলি একটি মুক্ত সংবাদপত্রের প্রতি বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে বলেই আমি মনে করি।
যদিও ১৬৭ জন সাংবাদিকের ‘এক্রিডিটেশেন’ প্রত্যাহারের সবশেষ ঘটনার পর দৃশ্যমান বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে আমরা এখনও আশা করি যে, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম একটি নতুন ভোর দেখবে এবং সমগ্র বিশ্বে শেষ পর্যন্ত বাকস্বাধীনতা বিকাশ লাভ করবে।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
দ্য ডেইলি স্টার থেকে ভাষান্তর: আশরাফুল ইসলাম