মানবতার কথা চিন্তা করে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই রোহিঙ্গারা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আসাম রাজ্যে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনকে তাদের নাগরিকপঞ্জি ‘এনআরসি’থেকে বাদ দিয়েছে ভারত।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু ও ভারতের এনআরসি ইস্যু নিয়ে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম'র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সমস্যা সমাধানের নানা উপায় ও সরকারের করণীয় তুলে ধরেছেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম'র সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট শাহজাহান মোল্লা।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: এনআরসি কী ভারতের শুধুই রাজনীতি, নাকি এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে?
আবুল হাসান চৌধুরী: যদিও এটা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ এবং যে দেশের সঙ্গে আমাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের অত্যন্ত গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তারপরও সে দেশে কিছু ঘটলে আমাদের উদ্বিগ্ন করবেই। আমার বিশ্বাসের জায়গা, আজকে ভারতের সঙ্গে আমাদের যে পারস্পরিক সম্পর্ক এটা আরও দৃঢ় করার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যেন আমাদের এই দেশ অন্য কোনো দেশের উদ্বিগ্নের কারণ হোক এটা প্রত্যাশিত নয়। প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। সেটা সর্বজনীনভাবেই স্বীকৃত। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের সব দলের কাছেও স্বীকৃত।
আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে এরকম একটা সম্পর্ক ভারত কেন বিঘ্নিত করতে চাইবে? তবে যখন এরকম একটা লিস্ট করা হয় এবং আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখছি ১৯ লাখ, হয়তো কিছুটা কমে আসবে, তাদেরকে একটা বিশেষ জায়গায় রাখার বন্দোবস্ত করা হয় এবং বার বার দেশটির উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয় যে তারা অবৈধ (তাদের ভাষায়, আমরা এটা বলি না, এটা আমরা সত্য বলেও মনে করি না) যার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। তাদের ভাষায় যখন বলা হয় তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে, তখন আমি উদ্বিগ্ন।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: এ বিষয়ে বাংলাদেশের কী করার আছে?
আবুল হাসান চৌধুরী: দেখুন ডিপ্লোমেসির অনেক কিছু প্রকাশিত থাকে আবার অনেক কিছু অপ্রকাশিত থাকে। আমরা এই সময়ে রোহিঙ্গা নিয়ে বিরাটভাবে জর্জরিত। এটা শুধু ব্যক্তিগতভাবে গর্বের বিষয় না, সমস্ত বাংলাদেশের গর্বের বিষয়। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) মাদার অব হিউম্যানিটি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। সে সময় অনেক তথাকথিত পণ্ডিতরা বলেছিলেন, এদেরকে কেন আশ্রয় দিতে হবে? কিন্তু আমাদের একটা ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা তখন সঠিক কাজ করেছি। কিন্তু সেটা নিয়েই আমরা আজকে বিশাল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। সেখানে আল্লাহ না করুক এরকম (এনআরসি) যদি অন্য দিক থেকেও আসে তাহলে এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য চিন্তার বিষয়।
এখানে পারস্পরিকভাবেই রাজনীতির ব্যাপার আছে। তবে এরকম একটা ঘটনা যখন আমরা দেখছি ভারতের পশ্চিম সীমান্তে কিছুটা হলেও তো তাদের পদক্ষেপের কারণে নানা দিক থেকে তাদের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সেখানে একটা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যেটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন।
আমি আশা করব, জাতিসংঘের বিভিন্ন সফরে সাইড লাইনে আলাপ-আলোচনা হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন দিল্লি যাবেন এ ব্যাপারে আলোচনা হবে।
তাছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আশা করব, সেই জায়গাতেই থাকবেন। এটা করা ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে? তবে কূটনৈতিকভাবে সেটা প্রকাশিতভাবেই হোক আর চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমেই বা চায়ের কাপের আলোচনাতেই হোক, আমি নিশ্চিত এটা করবেনও আমাদের অত্যন্ত দক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। উনি দীর্ঘদিন জাতিসংঘে থেকেছেন। সেখানে অনেক সমস্যার সাক্ষী হয়েছেন। এবার নিজের দেশের সমস্যার ব্যাপারে কিছু আলোচনা করবেন।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: এটা কী নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীকে টার্গেট করে করা হয়েছে?
আবুল হাসান চৌধুরী: পত্রিকায় যেটা দেখেছি আর ভারতে যেটা আলোচিত হচ্ছে- একটা সম্প্রদায়কে তারা সেদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে। তার মানে অবশ্যই মুসলমানরাই আক্রান্ত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এরকম একটা চিন্তা করার তো কারণ থাকতেই পারে। কিন্তু এটাকে খুব ধৈর্য্যের সাথে ও ম্যাচিউরিটির সাথে মোকাবেলা করতে হবে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে কী?
আবুল হাসান চৌধুরী: অবশ্যই উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যাপার আছে। উদ্বিগ্নতা প্রকাশের বিভিন্ন পন্থা থাকে। কিছু লোক নিয়ে রাস্তায় নামলে কী এটার সমাধান হবে? হয়তো হতে পারে, হয়তো হবে না। কিন্তু আমি মনে করি, পয়েন্ট অব ডিপ্লোমেসির ভেতরে অত্যন্ত স্ট্রং ডিপ্লোমেসি আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার সুযোগ হয়েছিল, সৌভাগ্য হয়েছিল ওনার সঙ্গে কাজ করার। আমি জানি, তিনি কী সুদৃঢ়ভাবে কাজ করতে পারেন। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না- দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা ফারাক্কা নিয়ে আলোচনা করেছি। ১৯৯৬ সালে জাতির জনকের কন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় গেলো, আমরা কিন্তু ছয় মাসের ভেতরে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি করেছিলাম। পাহাড়ের দীর্ঘ দিনের সমস্যা কয়েক বছরের মধ্যে সমাধান করেছিলেন। আর এরকম একটা সমস্যা চলবে, আমি মনে করি, এটা সমাধানের দিকে যাবে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: এনআরসি নিয়ে আন্তর্জাতিকমহলের ভূমিকা নিয়ে বলবেন?
আবুল হাসান চৌধুরী: আন্তর্জাতিক মহলে কোনো সমস্যার সমাধান হয়েছে? পাকিস্তান বারবার জাতিসংঘে গেছে, কোনো সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে?
তাই, এখানে জাতিসংঘের প্রতি অত্যন্ত সম্মান রেখেই বলতে চাই, আমরা তাকে সম্মানও করবো, গুরুত্বও দেব। কিন্তু অত বেশি জাতিসংঘের প্রতি নির্ভরশীল হওয়াটা বোধহয় খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। জাতিসংঘে নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা তো হয়েছে। কিছুই এগোয়নি, এগিয়েছে যখন আমরা দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনা করেছি।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: অন্য দেশগুলো এগিয়ে আসছে না। এখানে আমাদের কী করার আছে?
আবুল হাসান চৌধুরী: অন্য দেশ কী পদক্ষেপ নিল, কী ভাবল, এবিষয়ে মন্তব্য করা শুধুমাত্র নিষ্প্রয়োজন, এটা আমার জন্য অবান্তর, এটা করা সমীচীন হবে না। প্রত্যেক দেশ জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করে।তবে আমি আশা করব ‘ওআইসি’ অন্তত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আরো দৃঢ় হবেন। জাতিসংঘ তৈরি হবেন। এটা সমস্ত পৃথিবীর বোঝা, আমরা আমাদের কাঁধে নিয়েছি।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের আবাস আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি কী না?
আবুল হাসান চৌধুরী: শুধু আমাদের নিরাপত্তা নয়, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা মানবতার বাইরে কিছু চিন্তা করতে চাই না। তারা একটা দেশের নাগরিক, তারা সেখানে ফিরে যেতে পারবে না- এটা হতে পারে না। বাংলাদেশ যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এটা খুব জোরালোভাবে চালানো উচিত।
আমি মনে করি, আশিয়ান, বিমসটেক শীর্ষ সামিটে এই ঢাকায় রোহিঙ্গা ইস্যুর ওপর ফোকাস করা উচিত। কারণ জাতিসংঘ তো জাতিসংঘই। আমাদের এই অঞ্চলে ভেতর থেকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। চীনের একটা বড় ভূমিকা আছে, জাপানের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। বিশাল উদ্বাস্তু সমস্যা, এটাতো বাংলাদেশের সমস্যা না, এটা পৃথিবীর সমস্যা। এটা এভাবে চলতে পারে না। চীনকে আরো বোঝাতে হবে। আমাদের খুব জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: বাংলাদেশ থেকে বার বার চাপ প্রয়োগ করার পরেও মিয়ানমার আন্তরিক হচ্ছে না। এরপর আর কী করার আছে?
আবুল হাসান চৌধুরী: একাত্তরে যখন আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তখন ডেলিগেশন বিভিন্ন দেশে দেশে গিয়েছে, সেসব করতে হবে, চাপ প্রয়োগ করতে হবে-আমি মনে করি, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিভিন্ন দল এভাবে কাজ করবে। সবাইকে বোঝাতে হবে এটা সারা বিশ্বের সমস্যা। আফগানিস্তানের যখন সমস্যা হয়েছিল তখন তারা বুঝতে পারেনি, সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। আজকের এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলে বড় ভুল হবে।
নাগরিকত্বহীন হয়ে কেউ থাকতে চায় না। আমরা এক সময় উদ্বাস্তু ছিলাম, পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়েছিলাম। আমরা থাকতে চাইনি, আমরা সবাই ফিরে এসেছি। তারাও (রোহিঙ্গারা) তাদের দেশে যেতে চায়, মাথা উঁচু করে, নিশ্চয়তা নিয়ে, নির্ভয়ে। তাদের নিজের দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে সেটা কেন করতে পারবে না?
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবুল হাসান চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।