আমি কাঁদছি কেন? দুই চোখ গড়িয়ে জল পড়ছেই। সেই ভোর থেকেই। সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার নেমেছে। আঁধারে কেউ হয়তো আর আমার কান্না দেখতে পারবে না। জল লুকোনোর কোনো ছল নিতে হবে না। কিন্তু যতো আঁধার নামছে দশদিক অন্ধকার করে, ততোই আমি ভয়ে আঁতকে উঠছি। কেন? শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। আমি কি ভয়ে, আতঙ্কে কাঁপছি, নাকি আমি এসকল উপলব্ধির চৌকাঠ পেরিয়ে চলে গেছি, যাচ্ছি?
আকাশ গুমোট হয়ে ছিল। জল ঝরেছে আকাশেরও। মেঘ আর আমার চোখের জল একাকার হয়ে যায়নি। আমার চোখের জলে রক্ত ভাসছে। কার রক্ত? না, মোটেও আবরারের রক্ত নয়। ওর রক্ত কেন আমার চোখে ভাসবে? আমার সঙ্গে ওর কোনো আত্মীয়তা নেই। ছিলও না।
ওর মৃত্যু সংবাদ আমি কানে তুলিনি। মৃত্যু না হত্যা এই প্রশ্ন তোলাও পাপ। উঁহু, পাপ নয়, আরেকটি হত্যার উপলক্ষ্য তৈরি হবার ক্ষেত্র।
আমি কোনো প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি। মৃত্যু আর হত্যার সংজ্ঞা জানি না আমি। কোনো দিন শিখিওনি আমি। আমি ভাবছি না আবরারের কথা। আবরারের কথা ভাবুক ওর মা, ওর বাবা। অভিশাপ দেক সন্তানকে তারাই। কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিকেলে ভর্তি না হয়ে পড়তে গেল বুয়েটে? সেইতো এখন মেডিকেলের মর্গেই শুয়ে থাকতে হচ্ছে। সইতে হচ্ছে ছুঁড়ি-কাঁচি।
কাঁদছি কেন আমি, সুবিধাজনক কোনো রাজনৈতিক আদর্শের বিলবোর্ড বইতে পারি না তাই? আবরার, ও আমার কান্নার উপলক্ষ্য নয়। এ কেমন মেধাবী ছেলে ও? কখন কোন কথা বলতে হয়, কি নিয়ে কথা বলা বিপজ্জনক, এই বিচার বিবেচনা যার নেই, তাকে মেধাবী বলবো, এমন গর্দভ আমি নই।
আবরারকে যারা হত্যা করেছে, তারা ওর সহপাঠী বুয়েটেরই? এই ভাবনাও গর্দভের ভাবনা। মেধার পরীক্ষা ডিঙ্গিয়ে যারা বুয়েটে ঢুকেছে, তারা খুনি? উফ, এই অন্ধকারে আমার চারপাশে খুনিদের বিকৃত মুখ। আঁধারে জ্বলজ্বল করছে আবরারের নীলাভ হয়ে যাওয়া কষ্টের শরীরটা।
খুনিদের উল্লাসে পিষ্ট হওয়া আবরারের শরীর দেখে আতঙ্কিত নই আমি। আমার ভয় নিজ সন্তানকে নিয়ে। ওকেও আগামী দিনে পাঠাবো কোনো উচ্চ বিদ্যায়তনে। ওর শরীর এমন নীল হয়ে ফিরে আসবে আমার কাছে, সেই আতঙ্কের চেয়েও বড় ভয় আমার সন্তানও কি উন্মাদ হয়ে উঠবে তার সহপাঠীকে হত্যার জন্যে?
কারো মুখে প্রশ্ন নেই। শুধু বন্দনা। আমার সন্তান এমনভাবেই কি দূরে চলে যাচ্ছে ‘মানুষ’ নামের জনপদ থেকে?
নিজের ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ছি। নিজ স্বার্থ, লোভের মুদ্রা হয়ে উঠেছে আমার সন্তান। ও এখন খুনি। সহপাঠীর হত্যাকারী। আমি, আমরা তাদের পিতা, মাতা। নিজেকে, নিজেদের আমরা হন্তারক ভাবতে পারছিনা কেন আমরা? এ কেমন অনুসারী , উত্তরসূরি তৈরি করছি, যারা জন্মান্ধ। নিজের চোখ তৈরি হয়নি ওদের। আবার ভুল বলছি, ওদের চোখতো নিজেরাই উপরে নিয়েছি। বসিয়ে দিয়েছি পাথরচোখ। অতএব ওরা দেখছে না কিছুই। আমাদের ইচ্ছের পুতুল হয়ে নাচছে ওরা।
আমার সন্তানকে কোথায় পাঠাবো উচ্চশিক্ষার জন্যে? যেখানে শিক্ষক নেই, আছেন রাজনৈতিক পরিচয়ের কতিপয় অনুসারী। এই অনুসারীরা শিক্ষার্থীদের না হতে পারছে শিক্ষক হতে, না পারছে অভিভাবক হতে। তাদের অনিকেত অবস্থানেই উচ্চশিক্ষার বিদ্যায়তন এখন হত্যার নিরাপদ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আবরার’কে দিয়ে সেই প্রমাণ রাখা হলো।
কে, কারা হত্যা করলো আবরারকে, সেই হত্যাকারীকে লুকানোর পাঁয়তারা করে যে বিদ্যায়তন, সেখানে আমার সন্তানকে পাঠাবো? মোটেও না। তাহলে ? যেভাবে পাচার হচ্ছে আমাদের মেধা, তারই ‘চালান’ হবে আমার সন্তান? এতো ব্যর্থতা নিয়ে আমি কি করে বাবা কিংবা মায়ের পরিচয়ে আছি?
না, আমি মোটেও কাঁদছি না আবরারের জন্য। কাঁদছি নিজের জন্য। আমার সন্তানকে রাজনীতি শেখাতে পারিনি। আদর্শ না শিখিয়ে, স্বাদ দিয়েছি ক্ষমতার। দেশ বন্দনার বদলে, আত্মবন্দনায় মুগ্ধ হতে চেয়েছি। সেই ব্যর্থ পিতার কাঁধেতো সন্তানের লাশ থাকবেই।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন