রান্নার জন্য পেঁয়াজ একটি অতি প্রয়োজনীয় মশলা। তাই এর দর বৃদ্ধিতে ভোক্তারা উদ্বিগ্ন হন। আমাদের দেশে প্রতিবছর মৌসুম পেরুলেই বিশেষ একটা সময়ে রান্নার প্রয়োজনীয় এই উপাদানটির অভাব ঘটে কেন সেটাই আজকের প্রশ্ন।
কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশে এখন প্রতিটি ফসলের বাম্পার উৎপাদন লক্ষ্যণীয়। তবে পেঁয়াজের সংকট দেখে মনে হয় আমরা বুঝি কৃষিতে খুব দুর্বল। আসলে কি তাই? মোটেও নয়।
আমাদের কৃষি উৎপাদন সারা বিশ্বে ঈর্ষনীয়। মৌসুমে আলু, ফল, পেঁয়াজ পচে যায় সংরক্ষণের অভাবে। ধান, ডিম, দুধের দাম পায় না বলে কৃষকরা রাস্তায় ছুড়ে আন্দোলন করে। সমস্যাটা সেখানেও নয়। সমস্যা আমাদের চতুর সোনার মানুষগুলোকে নিয়ে, যারা এগুলো নিয়ে কারবার করে ও যারা এই অতিলোভী, অতি মুনাফাখোর, স্বার্থান্বেষী কারবারিদের নিয়ে রাজনীতি করে ও অপরাজনীতি করার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
সংবাদে জানা গেছে, ক’দিন আগে ঢাকায় পেঁয়াজের মূল্য ১২০ টাকা ও পীরগাছা উপজেলার বাজারে ১৪০ টাকা উঠেছিল। ভারতে বন্যা হওয়ায় সেখানে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। সেই অজুহাতে আমাদের দেশে সংকট না থাকা সত্ত্বেও ৪০ টাকার পণ্যের দাম তিন দিনের মাথায় ১৪০ টাকায় উঠে গেল! এটা নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে হৈ চৈ তো হবেই।
সম্প্রতি ভারতে ইলিশ মাছ পাঠানো হয়েছে। কেউ বলছেন, রফতানি করা হয়েছে। সেখানকার মানুষ ৫২০ টাকা কেজিতে সেই ইলিশ কিনতে পারলেও বাংলাদেশে এত অল্প দামে ওই মানের ইলিশ কেনা অকল্পনীয় ব্যাপার। সেজন্য বিষয়টিকে ‘সহজ-সরল একজন গ্রামীণ প্রান্তিক গৃহস্থের ডিমপাড়া মুরগিটি অতিথিকে জবাই করে দাওয়া খাওয়ানোর গল্পের মত’ মনে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক সহকর্মী লিখেছেন, ভারতকে দিলাম ইলিশ, বন্ধ হলো পেঁয়াজ। আরেকজন সহকর্মী তার উত্তরে কৌতুক করে একটা জনপ্রিয় গানের কলি লিখেছেন-দুশমনি কোরো না প্রিয়তম... ইত্যাদি।
পরে জানলাম, প্রতিবছর ভাদ্র-আশ্বিনের এই সময়টাতে বাজারে ইলিশের দাম কমলে বাসা-বাড়িতে ফেরিওয়ালারা ইলিশ নিয়ে আসত। সবাই সস্তায় ইলিশ মাছ কিনতেন এবং কিছু সংরক্ষণ করে বেশ কিছুদিন ধরে খেতেন। কিন্তু এবারে সেটা না হওয়ায় বাড়িতে ফেরিওয়ালারাও ইলিশ বেচতে আসেনি, কেনাও হয়নি, তাই খাওয়াও হবে না। এই আক্ষেপ ওনাদের।
এদিকে ইলিশ রফতানির কথা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই দেশের বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে গেছে হু হু করে। সঙ্গে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইলিশের দো-পেঁয়াজা নাকি সীমান্তের ওপাড়ে রান্না করা হচ্ছে! এদিকে অসময়ে ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়েছে। এতে অকাল বন্যায় উঠতি ফসল ও বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় হায় হায় শুরু করে দিয়েছে পদ্মাপাড়ের মানুষ।
আমাদের দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন কত? চাহিদার পরিমাণই বা কত? আপৎকালীন মজুদ কত পরিমাণ করা হয়? ঘাটতিই বা কত? জানা গেছে, আমাদের বার্ষিক পেঁয়াজের উৎপাদন ১৭ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার পরিমাণ ২২ থেকে ২৪ লাখ মেট্রিক টন। স্বভাবতই: বার্ষিক ঘাটতির পরিমাণ ৫-৬ লাখ মেট্রিক টন মাত্র। এই সামান্য ঘাটতি তো সহজেই পুষিয়ে নেবার কথা আমদানির মাধ্যমে। তা না করে সরকার প্রতিবছর কেন এত বোকামি করছে?
সেজন্য উৎপাদিত পেঁয়াজ-রসুন তথা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আমাদের উৎপাদিত সব কৃষিপণ্যের যথার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ফসল ঘরে তোলার মৌসুম পেরুলেও যেন বাজারে এসব দরকারি পণ্য ন্যায্যমূল্যে সবার জন্য সহজলভ্য হয় সে ব্যবস্থা করা উচিত।
বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা আমাদের সবচে’ পুরনো ও বড় সমস্যা। দেশের বাজারে দেশি-বিদেশি যে কোনো দ্রব্য মেলে। কিন্তু দাম-দরের নিয়ন্ত্রণহীনতা আমাদের সবচে’ ভোগায়। দেশের সিংহভাগ মানুষের আয় কম। তাই তাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত। যেমন- পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৫০০ টাকা উঠে গেলেও তা কিনে খাবার ক্ষমতা কালো টাকার কিছু মালিকের রয়েছে। মরণ শুধু সীমিত আয়ের সৎ মানুষদের। যাদের মাসিক ভোগ্যপণ্য কিনতে তালিকা বানিয়ে হিসেব করতে হয়। এটি নিয়ন্ত্রণে শূন্য সহ্যসীমা কর্মসূচির আওতায় সবার আগে বাজার দর নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্ববানদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত কঠোর নজরদারি দরকার।
আমাদের বাজার দর নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্ববানরা দু’একটি পোস্টার ছেপে ও টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে যেন দায়মুক্তি না ঘটায়, সেটা কে দেখভাল করবে? তবে এক্ষেত্রে দুর্নীতি করার প্রবণতাকেও কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ‘সকলি গরল ভেল’- হতে পারে।
কৃষিতে বাম্পার ফলন হলে পেঁয়াজ-রসুন-আদা ইত্যাদির জন্য কি উচ্চতর গবেষণা হয় না? তাহলে এগুলোর উৎপাদনে এখনও ঘাটতি কেন? চীন, জাপানের মত ‘নাগানেগি’ বা বারোমাসি লম্বা জাতের পেঁয়াজ-রসুন চাষ করা হচ্ছে না কেন? আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় সহজেই এর চাষাবাদ করা যেতে পারে।
এসব বারোমাসী লম্বা পেঁয়াজ-রসুনের আবাদ বাড়ির আঙিনায়, আশেপাশের ফাঁকা জায়গায়, এমনকি টবের মধ্যেও করা যায়। চীন, কোরিয়া, জাপানের মানুষেরা বাগান থেকে ‘নাগানেগি’ তুলে পাতা ও গাছশুদ্ধ রান্নায় ব্যবহার করে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও এর উৎপাদন ও ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। তবে এখন কেন আমরা প্রতিবছর এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিই? কেনই বা এসব কৃষিপণ্যের বেশি দাম শুনে হা পিত্যেশ করি? আমাদের কৃষি বিশ্বিবিদ্যালয়গুলো এদিকে নজর দিয়ে গবেষণা করতে পারে, যেন আমাদের আবহাওয়া অনুকূল এসব মশলা জাতীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বিপণন সহজে করা যায়।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।