কয়েকদিন আগে এক ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন অসাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতায় থাকার প্রশংসা করছিলেন। বিএনপি-জামায়াতকে বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে অভিহিত করে তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখায় বাংলাদেশের জনগণেরও প্রশংসা করছিলেন তিনি। বেশ কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও তার কথায় ছিল বাংলাদেশের প্রতি, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি গভীর মমতা। আলোচনার এক পর্যায়ে আমি বললাম, দাদা বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এটা আমরা রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জন করেছি। সেই অর্জনের পথে ভারতের অকৃত্রিম সহায়তার কথা আমরা চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।
স্বাধীন বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব, ৩০ লাখ শহীদের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভারত যে আজ চরম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, তার কী হবে? আমি জানি, এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। শুধু তার কাছে নয়, কোটি দেশপ্রেমিক ভারতীয়র কাছেও এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে বিজেপি সরকার কিছুটা রয়ে সয়ে চললেও, দ্বিতীয় মেয়াদে এসে নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহ জুটি তাদের স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ৭২ বছরের ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর সকল আয়োজন শেষ করে এনেছে তারা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এখন কাজীর গরু; কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
১৯৪৭ সালে একদিন আগে পরে স্বাধীন হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। পাশ্চাত্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাজনৈতিক কারণে ধর্মকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। ধর্ম হলো রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে সহজ অস্ত্র। জিন্নাহ সেটা ভালোই বুঝেছিলেন। তাই নিজে জীবন চর্চায় মুসলমান না হলেও মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি দেশ গড়ে তুলেছিলেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন হয় পাকিস্তান। আর পাকিস্তানের চেয়ে একদিনের ছোট ভারত এগিয়ে চলে পন্ডিত জওহারলাল নেহেরুর চেতনায় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদকে পুজি করেই। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর গণতন্ত্রের জন্য সারাবিশ্বেই অনুকরণীয় হয়ে ওঠে ভারত। আর ধর্মকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী দ্বারা শাসিত। একদিন পরে স্বাধীন হওয়া ভারত এখন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ, আর পাকিস্তান প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র, চলতে হয় ধার করে।
দ্বিজাতিতত্ত্ব যে একটি ভাওতা, তা বুঝতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বেশি সময় লাগেনি। দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম শেষে একাত্তরে নয় মাসের রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। দ্বিজাতিতত্ত্বের খপ্পর থেকে বেরিয়ে অসাম্প্রদায়িক ধারায় চলতে পেরেছিল বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। সব সূচকে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। ভারত কেন যে ৭২ বছরের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলে হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে; আমার মাথায় ঢুকছে না।
সাধারণত বিরোধী দল নানা কর্মসূচি দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বিব্রত করে। কিন্তু কোনো সরকার নিজের তৎপরতা দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে, এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। বিজেপি সেই বিরল সরকারের একটি। এনআরসি, কাশ্মীর, রাম মন্দির- তাদের একের পর এক ইস্যু অস্থিতিশীল করে তুলেছে ভারতকে। সর্বশেষ নাগরিকত্ব বিল পাস নিয়ে এখন বিক্ষোভ, কারফিউ, আগুন, গুলি, মৃত্যুতে উত্তাল ভারত। তবে ভাবার কোনো কারণ নেই, মোদি-অমিত জুটি বোকার মত নিজ দেশকে অস্থিতিশীল করছেন। নরেন্দ্র মোদির সমর্থনে অমিত শাহ খুব ভেবেচিন্তে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছেন। যতই বাধা আসুক, তাদের থামানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
গুজরাটের দাঙ্গায় সমালোচিত নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, বিজেপি হিন্দুত্ববাদ কায়েম করতে চাইবে। প্রথম দফায় মোদি সরকার অনেক সংযত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে মোদি সরকার তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঠে নামে। তাদের মূল এজেন্ডা ছিল তিনটি- কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ এবং নাগরিকত্ব বিল সংশোধন। তিনটি এজেন্ডাই রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের মৌলিক চেতনার বিপরীত। বলা হচ্ছে, বিজেপি ভারতের আত্মায় আঘাত করছে। মোদি-অমিত জুটি একে একে তিনটি এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছে। আর এই কাজে তারা সাফল্যের সঙ্গে আদালতকে ব্যবহার করতে পেরেছে।
নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ তো হচ্ছেই, প্রতিবাদ জানাচ্ছেন দেশটির অসাম্প্রদায়িক চেতনার বুদ্ধিজীবীরাও। নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মানদণ্ড বেধে দেয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশনও (ইউএসসিআইআরএফ)। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনা হয়েছে, যা দেশটির সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। ভারতীয় সংবিধানে সমতার কথা বলা হয়েছে। সংশোধনী তাও ক্ষুণ্ন করবে। সংশোধনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে যাওয়া সংখ্যালঘুরা সে দেশের নাগরিকত্ব পাবেন। আগে যেখানে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য সে দেশে ১১ বছর অবস্থানের বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটা কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। তবে এই তিন দেশের মুসলমানরা এই সুবিধা পাবেন না। এই বিল নিয়ে ভারতে নানামুখী আপত্তি চলছে। কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার পয়েন্টে আপত্তি করছেন। আর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বিক্ষোভ চলছে, কারণ তারা বহিরাগত কাউকেই নাগরিকত্ব দিতে চান না। তাদের অভিযোগ, বহিরাগতদের নাগরিকত্ব দিলে তাদের কাজের সুযোগ কমে যাবে, তাদের জাতিগত জনসংখ্যার প্যাটার্ন বদলে যাবে। সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়বে। আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ক্ষোভ এমন, তবে গোটা ভারতের শুভ ইচ্ছার মানুষদের শঙ্কা, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হারিয়ে যাচ্ছে বলে।
তবে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমার আপত্তির জায়গাটা অন্য। অমিত শাহ পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মত দুটি অকার্যকর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশকে এক কাতারে ফেলেছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক। অমিত শাহ কৌশলে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সরকারকে সার্টিফিকেট দিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় চাপিয়েছেন বিএনপি-জামাতের ঘাড়ে। এটা ঠিক বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কিন্তু ভারতের সম্পর্কটা তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে। তাই অমিত শাহর বিবেচনাটা বাংলাদেশের সঙ্গে হতে হবে। কোনো বিবেচনাতেই বাংলাদেশকে খাটো করার সুযোগ নেই। ভারতের নাগরিকত্ব বিলের সংশোধন আসলে বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক, এই বিল মানেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ মাথা পেতে নেয়া।
আশির দশকে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছেন এবং ভোটের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ তা বাদও দিতে পারেনি। তবে ধর্মনিরপেক্ষতায় চেতনায়ই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। ৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। জিয়াউর রহমান সেটি সংবিধান থেকে বাদ দিলেও আওয়ামী লীগ সরকার আবার তা ফিরিয়ে এনেছে। নানা কারণে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমেছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা এমন নয় যে সংখ্যালঘুরা দলে দলে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আর মুসলমানদের কেউ কোনো কারণেই ভারত গিয়ে থেকে যেতে চাইবেন বলে মনে হয় না। বরং ভারতের অনেকে এখন বাংলাদেশে কাজ করেন। ভারতের চতুর্থ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দেশ বাংলাদেশ। এর বাইরে অনেক ভারতীয় অবৈধভাবেও বাংলাদেশে থেকে কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েকদিন আগে এনআরসি করেও বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে।
ভারত যদি ন্যায্যতার প্রশ্নে নির্যাতিত মানুষদের পাশে দাঁড়াতো, তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু পুরো বিষয়টার মধ্যেই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সত্যিকারের বিপদে আছে, তারা নির্যাতিত। কিন্তু বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও ভারত তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং ভারত বেছে বেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি ও শিখদের নাগরিকত্ব দেবে। সমস্যাটা এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই। চোখের সামনে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখে দুঃখ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তবে ভারতের সরকার এবং তাদের জনগণই ঠিক করবে, তাদের দেশ কীভাবে চলবে। তারাই তো ভোট দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছে। ভারতের জনগণ যদি নিজেদের ভালোটা না বোঝে, তাহলে কার কী করার আছে। তবে আমাদের বৃহত্তম প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কোনো তৎপরতা যখন আমাদের দেশে প্রভাব ফেলে তখনই আমার আপত্তি। ভারতের নাগরিকপঞ্জি এবং নাগরিকত্ব বিলের অস্থিরতায় সীমান্তে পুশব্যাকের হার বেড়েছে। যেটা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশে। ভারত আমাদের বৃহত্তম প্রতিবেশী। বন্ধু বদলানো যায়, কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যায় না। তাই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটি স্থিতিশীল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকাটা দুইদেশের জন্যই দরকার। ভারতের কোনো সিদ্ধান্ত যেন এই সম্পর্কের হারমনি নষ্ট না করে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ভারতকেই নিতে হবে।
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ