বাড়ি ভর্তি ছেলে মেয়েদের হইচই। ছুটিতে বেড়াতে এসেছে ওরা। কন্যা তার ভাইবোনদের নিয়ে হই হুল্লোড়ে ব্যস্ত। কন্যার মা পিঠে বানিয়েছে। কুমড়ো ফুল ভাজছে। আমি কন্যার কাছে বাড়তি বায়না করি-কফি করে দিবি? কন্যা এসে গালে গাল মেলালো, হাতে গরম কফির পেয়ালা। দুই-এক চুমুক দিতেই মোবাইল ফোন বাজছে এক যোগে দু’টি। দু’টি নম্বরই পরিচিত নয়। একটি ধরতেই পরিচিত কণ্ঠ- এক প্রিয়জনের নাম ধরে বলল, ওর খারাপ খবর আছে। আমি থমকে গেলাম। আমি কি কেঁপে উঠেছিলাম। না হলে ফোনে তো কতো কথাই বলি। কতো খারাপ খবরই আসে। এমন কি এর আগে কখনও হয়নি। না হলে কন্যা আর তার মা কেন আমার দুই পাশে এসে দাঁড়ালো? পরিচিত কণ্ঠকে বললাম-প্রিয়জনকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসতে। আপাতত কাউকে কিছু বললাম না। জানালাম না। এভাবে কতো দিন উৎসব, আনন্দের মাঝ পথে উঠে চলে গেছি। তবে আজ মেয়ের চোখের জল, উদ্বেগ। মেয়ের মায়ের চোখ সব হারানোর শোকে বিধ্বস্ত।
পরিচিত কণ্ঠ ততোক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। আমার সঙ্গে কয়েকজন সহকর্মী। কিছুক্ষণ পরই প্রিয়জনের শিক্ষকরা চলে এলেন। আমাদের কারো মুখে কোনো ভাষা নেই। শুধু কিছুক্ষণ পরপর প্রিয়জন কতোদূর এলো, সেই খোঁজ নিচ্ছি। হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, গাইনি ওয়ার্ডে জানিয়ে রাখলাম। হাসপাতালের পুলিশকেও জানিয়ে রাখা হলো। প্রিয়জন এলো। আমি ওর কাছে এগিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। শিক্ষকদের বললাম, আপনারা যান। গাড়িতে বসেই শুনুন, কী ঘটেছিল। মিনিট সাতেক তারা শুনলেন। আমরা গাড়ির দরজার কাছে হুইল চেয়ার নিয়ে এগিয়ে যাই। সঙ্গে ওর সহপাঠীরা। আরো কয়েকজন শিক্ষক ছুটে এলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর তার সহকর্মীদের আগেই পাঠিয়েছিলেন। এখন তিনিও আছেন পাশে। প্রিয়জনকে দেখে আমরা সবাই একবার চিৎকার করে উঠতে গিয়েই চুপ হয়ে গেলাম। আর্তনাদ করতে গিয়ে কীভাবে চুপসে যেতে হয়, এতোদিনে আমাদের জানা হয়ে গেছে। প্রিয়জনকে নিয়ে আমরা হাসপাতালের দীর্ঘ করিডোর দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল অপমান, লজ্জা, দুঃখবোধের ভার বইবার এই পথ যেন ফুরোবার নয়। বরং দীর্ঘই হচ্ছে।
প্রিয়জনকে গাইনি ওয়ার্ডে পৌঁছে দিলাম। সঙ্গে তার দুই শিক্ষক। তাদের অনুমতি নিয়েই খবরটি গণমাধ্যমকে জানানো হলো। মুহূর্তেই সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে গণমাধ্যম কর্মী, সহপাঠী, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের। প্রিয়জনের বাড়িতে খবরটি কীভাবে দেব? কী জানাব? সত্য বলার সাহস হারিয়েছি তো সেই কবেই। অভ্যাস আছে মিথ্যে বলার। তাই বললাম। হাসপাতাল, পুলিশের দাপ্তরিক নানা জটিলতা তখনো চলছে। হাসপাতাল চত্বরে শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়ছেই। প্রিয়জনকে নিয়ে আসা, এক প্রকার উদ্ধার করে নিয়ে আসা তার দুই সহপাঠী করিডোরের এক কোনে বসে আছে। ওরা তখনও কাঁপছে আতঙ্কে। ওদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেই। ততোক্ষণে প্রিয়জনকে গাইনি ওয়ার্ড থেকে নিয়ে আসা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। এখানেই ওর চিকিৎসা চলবে। ভেতরে প্রিয়কণ্ঠ ও শিক্ষকরা। আমি সহকর্মীদের দুইজন নিয়ে ভিড় থেকে সরে আসি। হুম, আমরা সরে আসতে জানি।
মধ্য রাত থেকেই প্রতিবাদে কাঁপছে ক্যাম্পাস। সব দল মতের শিক্ষার্থী, শিক্ষকের কণ্ঠে প্রতিবাদের স্লোগান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রিয়জনের অভিভাবকের মতোই কাজ করছে। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে থাকা প্রিয়জন ভালো নেই। তার শারীরিক ব্যথা নাকি বাড়ছেই। ঘটনা কীভাবে হলো, কে বা কারা ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মানসিক কষ্টটা বাড়ছে ক্রমশ। আন্দোলন চলছে। দোষীকে ধরার চেষ্টা ও ঘটনা তদন্ত চলছে পুরোদমে। দূরে বসে দেখছি সব। আন্দোলনের আয়োজন পরিচিত। তদন্তের ক্ষিপ্রতা পরিচিত। আমি শুধু অপেক্ষায় আছি, কবে সেই প্রিয়জনকে দেখব হেলে দুলে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। আগের মতোই পেছন থেকে ডাক দিলে জানাবে-সহপাঠী কারো বিপদের খবর। ও সেখানেই ছুটছে। তাই থামার সময় নেই ওর। অথচ ততোদিনে ওকে ঘিরে আমাদের সব উৎকণ্ঠা, প্রতিবাদের আয়োজেন থেমে যাবে। কারণ আমরা থেমে যেতে জানি।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন।