যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে রুশদের সামনে আর বিকল্প নেই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

বিল্লাল বিন কাশেম | 2023-08-29 14:31:15

পুরো নাম ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। পৃথিববীর অনেকে তাঁকে মাচোম্যান পুতিন হিসেবেও চেনেন। ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর লেনিনগ্রাদে জন্মগ্রহণকারী রুশ প্রজাতন্ত্র বা রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি।

২০১২ সালের ২ মে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন হন পুতিন। এর আগে ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০০ ও ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। এছাড়া ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত একই সাথে ইউনাইটেড রাশিয়া দলের সভাপতি এবং রাশিয়া ও বেলারুশের মন্ত্রিসভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হন বরিস ইয়েলৎসিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে খানিকটা কোণঠাঁসা হয়ে পড়ে রুশরা। ওয়াশিংটনের মারপ্যাচের কাছে ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়ছিল রাশিয়া।

১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাশিয়ার শাসন ক্ষমতায় আসেন সাবেক কেজিবি প্রধান ভ্লাদিমির পুতিন। দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। কখনও কনকনে শীতে উদাম শরীরে ঘোড়া চালিয়ে গণমাধ্যমের নজরে আসেন। সমুদ্রে জ্যান্ত হাঙ্গরের মুখ থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। আবার কখনও তরুণ জুডো খেলোয়ারদের পরাজিত করেন। এসবের মাধ্যমে রুশদের মনজয় করেন পুতিন। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রুশদের সাবেক সোভিয়েত আমলের মতো বৃহৎ দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখান। যে কথা, সেই কাজ। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা রাজনৈতিক ছকে নিজেকে এগিয়ে রাখতে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিন শিবির গোপনে ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করেছে।

১৯৯৯ থেকে ২০২০ সাল। রুশ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। অপরদিকে দেশটির বিরোধী শক্তিকে সামলেছেন শক্ত হাতে। এসবের মাধ্যমে রাশিয়ার ম্যাচোম্যানের তকমা নিয়েছেন সাবেক এই গোয়েন্দা। এবার আজীবন দেশটির ক্ষমতায় থাকার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন তিনি। ওই পরিকল্পনায় রুশ সংবিধানে পরিবর্তন আনার কথা বলা আছে। সংবিধানের এ পরিবর্তন আগামী ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিনকে ফের ক্ষমতায় ফিরতে সহায়তা করবে।

সংবিধানের এই পরিবর্তন আনা হলে ৬৭ বছর বয়সী রুশ নেতা পুতিন চাইলে আগামী ২০৩৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার শাসন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। মহাকাশে পাড়ি জমানো প্রথম রুশ নারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা বর্তমানে দেশটির পার্লামেন্ট সদস্য। তিনি সম্প্রতি কোনো রুশ প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদের সীমা বাতিল করে একটি প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবটি দ্রুত রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে পাস হয়। ৮৩ বছর বয়সী সাবেক সোভিয়েত নভোচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা রাশিয়ায় উচ্চ পর্যায়ের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। এদিকে, পুতিন সরকারের সমালোচকরা তেরেসকোভার এ প্রস্তাব ভালোভাবে নেয়নি। তারা এ প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজপথে নামার ঘোষণা দেয়। এতে কাজ হয়নি। বরং রুশ সংসদ সদস্যরা আরও একগুচ্ছ আইন পাস করিয়েছে, যা পুতিনের পক্ষে যায়। রুশ সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে আগামী মাসে দেশজুড়ে গণভোটের আয়োজন করা হয়েছে।

পুতিন তাঁর সময়কালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছেন। রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন চেচনিয়ায় ২য় চেচেন যুদ্ধের মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যগুলোর অখণ্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। পুতিনের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে রাশিয়ায় অর্থনৈতিক ভিত ৯ বছরের মধ্যে জিডিপি শতকরা ৭২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্র্যতা কমপক্ষে ৫০ ভাগ কমাতে পেরছেন। গড় মাসিক বেতন ৮০ ডলার থেকে বেড়ে ৬৪০ ডলার হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় পুতিন লভ্যাংশের ওপর কর হ্রাসসহ ১৩ ভাগ হারে আয়কর ধার্যের বিষয়ে আইন পাস করেন। জ্বালানি নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার ফলে রাশিয়া জ্বালানি খাতে বৃহৎ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। বৃহৎ জ্বালানি প্রকল্প হিসেবে রাশিয়ার আণবিক শক্তিতে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও অনেকগুলো বৃহৎ রফতানি সহায়ক পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থার অবকাঠামো নির্মাণেরও সূচনা হয়। তার মধ্যে ইস্টার্ন সাইবেরিয়া-প্যাসিফিক ওসেন অয়েল পাইপলাইন বা এসপো এবং নর্ড স্ট্রিম প্রকল্প অন্যতম।

অবশ্য পশ্চিমা পর্যবেক্ষক ও দেশের অভ্যন্তরে বিরোধীরা পুতিনের রাষ্ট্রপতিত্বকে অগণতান্ত্রিক হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে। কিন্তু দেশে আইনের শাসন ও স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে রুশ সমাজ ব্যবস্থায় তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। লেনিনগ্রাদে অবস্থানকালীন যুবক বয়সে পুতিন বেশ কয়েকবার জুডো এবং স্যাম্বো (মার্শাল আর্ট) খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। রাশিয়ার ক্রীড়া উন্নয়নেও তিনি প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৪ সালে সোচিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক রাশিয়ায় আয়োজনের লক্ষ্যে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

রুশভাষী হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জার্মান ভাষায়ও কথা বলতে পারেন। বাড়িতে তিনি ও তার পরিবার জার্মান ভাষায় কথা বলে থাকেন। প্রেসিডেন্ট হবার পর জানা যায় যে তিনি ইংরেজি ভাষা শিখেছেন। তাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি রুশ ও ইংরেজিভাষীদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনার সময় তিনি এখনও অনুবাদকের সহায়তা গ্রহণ করে চলেছেন। পুতিনকে প্রকাশ্যে ইংরেজিতে প্রথমবারের মতো কথা বলতে দেখা যায় ২০০৩ সালে। তখন তিনি বাকিংহাম প্রাসাদে ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা এলিজাবেথ বোজ-লিওনের মৃত্যুতে ইংরেজিতে অল্প কিছু শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি সোচিতে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের নিলাম ডাকের অনুষ্ঠানে খুবই স্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজিতে কথা বলেন। গুয়াতেমালা সিটিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অধিবেশনে তার এ ভূমিকা সবাইকে চমকে দিয়েছিল।

পুতিন রুশ অর্থোডক্স গির্জার সদস্য। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত পুতিন ১৯৮৩ সালের ২৮ জুলাই কালিনিনগ্রাদে জন্মগ্রহণকারী ও সাবেক বিমানবালা লিদমিলা শ্রেবনেভাকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে মারিয়া পুতিনা ও ইয়েকাতেরিনা পুতিনা নামে দুই কন্যা রয়েছেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত উভয়ে জার্মানিতে বসবাস করেন। বিএনডি সংগ্রহশালার তথ্য মোতাবেক জানা যায়, পুতিনার এক জার্মান গোয়েন্দা বন্ধু ছিল ও প্রণয় আসক্তির ফলে পুতিন তাকে পেটান। ১৯৯০ সালে জার্মান ত্যাগের পর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পুতিন অবৈধ সন্তানকে ফেলে গেছেন।

গত ২০ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন পুতিন। সোভিয়েত একনায়ক যোশেফ স্টালিনের পর পুতিনই সবচেয়ে বেশি দিন দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছেন। ২০০০-২০০৮ সাল পর্যন্ত দুই দফা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পুতিন। এরপর দুই দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিমিত্রি মেদভেদেভ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। বলা হয়, মেদভেদেভ প্রেসিডেন্ট হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন পুতিন। পেছন থেকে সব কলকাঠি তিনিই নাড়েন। দিমিত্রি মেদভেদেভের সময়ই রুশ প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করা হয়।

এরপর ২০১৮ সালে ফের রুশ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসেন পুতিন। ২০২৪ সালে তার ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি রুশ পার্লামেন্টে এই পরিকল্পনা প্রকাশের পর দেশটির প্রধান বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি এর কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এটি আজীবন ক্ষমতায় থাকার নীলনক্সা ছাড়া আর কিছু নয়। পুতিন গত কুড়ি বছর রাশিয়ার ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন। কিন্তু মানুষের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তারপরও পুতিন ঘনিষ্ঠরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে এখন পুতিন ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও বিকল্প নেই।

এপি, আল জাজিরা ও অন্যান্য ওয়েবসাইট অবলম্বনে।

বিল্লাল বিন কাশেম: সাবেক কূটনীতিক প্রতিবেদক ও আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর