অতন্দ্র প্রহরীদের স্যালুট

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-28 07:02:05

ফেসবুকে একটা ডেলিভারি বয়ের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। বাচ্চা ছেলে। এই অবরুদ্ধ সময়ে ছেলেটি মোটর সাইকেলে করে পণ্য নিয়ে যাচ্ছিল, হয়তো আপনাদের কারো বাসায়। আমাদের আর সবার মত তারও ভয় করে, তবু আল্লাহর নাম নিয়ে মাঠে নেমেছে। তবে সাবধানতার কমতি নেই। তার মুখে মাস্ক, হাতে গ্লোভস, পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ছেলেটি যত সাবধানেই থাকুক, তাকে কিন্তু দিনভর নানান জায়গায় যেতে হয়। কোথায় যে করোনা লুকিয়ে আছে কে জানে। আর করোনা ভাইরাসকে আমার কাছে লখিন্দরের বাসর ঘরের ঢুকে পড়া সুতানলি সাপের মত মনে হয়। এই যে আমরা সবাই ভয়ে ঘরে ঢুকে গেছি, তারপরও কি পুরোপুরি নিরাপদ? জানি না। ভয় হয়। অনেক সতর্কতা নেয়ার পরও কোনদিক দিয়ে সুতানলি সাপের মত করোনা ঢুকে পড়বে, কে জানে। তারপরও আপনারা যারা ঘরে আছেন, বিচ্ছিন্ন আছেন; তারাই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ। কিন্তু ঘরের ভেতরে আপনার সময়কে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত করতে কত হাজার মানুষ বিনিদ্র রাত জাগছে, সেই খবর কী রাখেন আপনারা?

এই যে আপনার এসি চলছে, পাখা ঘুরছে; বিদ্যুৎ অফিসের কেউ না কেউ কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখছে। এই যে আপনার চুলায় গ্যাস আছে, কলে পানি আছে; কেউ না কেউ কিন্তু সেগুলো সচল রাখছে। আপনি বাসায় বসে বসে সারাদিন ফেসবুকিং করছেন, সিনেমা দেখছেন, ফোনে কথা বলছেন; কেউ না কেউ তো ফোন বা ইন্টারনেট সচল রাখছে। আপনি ঘুম থেকে ওঠার আগেই কেউ না কেউ আগের রাতের ময়লাগুলো নিয়ে যাচ্ছে। বাজার খোলা, সুপার শপ খোলা। চাইলে আপনি ঘরে বসেও বাজার করতে পারবেন। আপনি যে টিভিতে নিউজ দেখছেন বা পত্রিকা পড়ছেন; কেউ না কেউ কিন্তু খবরগুলো তৈরি করছে; ক্যাবল অপারেটর বা হকাররা সেই খবর আপনার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। বিকেলে 'আর ভাল্লাগে না' বলে বেপরোয়া আপনি বাইরে বেরিয়ে পড়েন; তখন আপনাকে বুঝিয়ে বা ঠেঙিয়ে ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর কাজটি কিন্তু করছে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কেউ, যাদের গালি দেয়া ছাড়া আপনার কোনো দায়িত্ব নেই। এরমধ্যে কিন্তু আগুনও লেগেছে, ফায়ার সার্ভিস নিভিয়েছেও। রাস্তা ফাঁকা, তাই তাদের আসতেও দেরি হয়নি। কৃষক ফসল ফলাচ্ছে, পুকুরে মাছ বড় হচ্ছে, মুরগি ডিম পাড়ছে, গরু দুধ দিচ্ছে। তাই তো আপনারা খেয়ে পড়ে বেঁচে আছেন। আবার আটকে পড়া দরিদ্র মানুষগুলোর কাছেও ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে কেউ না কেউ।

আপনি যতই গালাগাল করুন, অপবাদ দিন; ডাক্তাররা কিন্তু আপনার জন্য দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকেন। সব বড় হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ২৪ ঘণ্টা খোলা। করোনা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আসলে বাংলাদেশে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই নেই। তারপরও কিন্তু জীবনের পরোয়া না করে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তাররাই ফ্রন্ট-লাইন ফাইটার। তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। অন্তত দুজন ডাক্তারের মৃত্যুর খবর এসেছে। ডাক্তারদের নিয়ে আলাদা করে লিখেছি, তাই এখানে আলাদা করে লিখছি না। খালি একটা কথা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আপনার যত অভিযোগ আছে, ক্ষোভ আছে, বিদ্বেষ আছে; সব ভুলে তাদের পাশে দাঁড়ান, তাদের মানসিকভাবে চাঙা রাখুন। ডাক্তাররাই কিন্তু আমাদের লাইফ লাইন। আমলাদের অব্যবস্থাপনার দায় ডাক্তারদের ঘাড়ে চাপাবেন না।

সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনা মোতায়েন করা হয়। প্রথম দিন সেনা মোতায়েনের নিউজের সাথে পুরনো ফুটেজ ব্যবহার করা হয়, যাতে অস্ত্রসহ সেনাবাহিনীর টহলের ছবি ছিল। সংশ্লিষ্ট একজন ফোন করে খুব বিনয়ের সাথে সশস্ত্র টহলের ছবি না দেখানোর অনুরোধ করে বলেন, সশস্ত্র টহল দেখলে তারা ভয় পাবে। কিন্তু আমরা তাদের ভয় দেখাতে চাই না, পাশে থাকতে চাই। অনুরোধটা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এরপর গত ২০/২২ দিনে সেনা সদস্যরা কী ধৈর্য নিয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে বলছে, মাইকিং করছে। করোরা বিপর্যয়ে সেনাবাহিনী আবারও প্রমাণ করলো, তারা জনগণের সত্যিকারের বন্ধু।

আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে পুলিশের জন্য। বাংলাদেশে পুলিশ সবচেয়ে বেশি গালি খায়, সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমও করে। ডাক্তারদের তবু পিপিই আছে। কিন্তু বাড়তি কোনো সুরক্ষা ছাড়া পুলিশ দিনের পর দিন রাস্তায় কাজ করছে। দিনভর তাদের হরেক লোকের সাথে কাজ করতে হয়। কোথায় যে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে করোনা কে জানে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তবুও তারা কাজ করে যাচ্ছেন মুখ বুজে। যে অসীম ধৈর্য নিয়ে মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে পাঠাচ্ছে, দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। আমি নিশ্চিত, তাদের জায়গায় থাকলে এত অবুঝ মানুষের সামনে আমি এতটা অহিংস থাকতে পারতাম না। মানুষ যেন পুলিশের সাথে চোর-পুলিশ খেলে। পুলিশের গাড়ি এলেই রাস্তা ফাঁকা, চলে গেলেই আবার ভিড়। যেন পুলিশের ঠেকা পড়েছে, মানুষকে ঘরে রাখতে, যেন ঘরে রাখতে পারলে পুলিশের বিশাল লাভ। আমরা বুঝতেই চেষ্টা করছি না, যে ঘরে থাকাটা আমাদের স্বার্থে। আচরণ দেখে মনে হয়, পুলিশ মানুষ নয়, রোবট। রাস্তায় অসুস্থ কেউ পড়ে থাকলেও এখন কেউ এগিয়ে আসে না। পুলিশে খবর দিলে তারা এসে নিয়ে যায়। যেন আমাদের করোনা হবে, পুলিশের হবে না। করোনা সন্দেহে সন্তানেরা মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়। উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু পুলিশকে কি কখনো আমরা গালি ছাড়া আর কিছু দিয়েছি?

সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আছেন ব্যাংকাররা। ব্যাংক যে জরুরি সেবা, ব্যাংক যে খোলা আছে রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেটা মানতেই চান না বা বোঝেন না। আচ্ছা মানলাম, পুলিশ বুঝছে। কিন্তু তারা অফিসে যাবেন কীভাবে? সব ধরনের গণপরিবহন তো বন্ধ। সব ব্যাংকারের তো আর গাড়ি নেই। তাদের অনেক কষ্ট করে ব্যাংকে যেতে হয়। আর পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। কোনোরকমে অফিসে আসলেও মুক্তি নেই। অফিসে আসা মানে ঝুঁকির কেন্দ্রে আসা। টাকা হতে পারে করোনার প্রধান উৎস। আর ব্যাংকে নানান জায়গা থেকে নানান শ্রেণি পেশার মানুষ আসে। কে যে শরীরে করোনা নিয়ে ঘুরছে, কে জানে। শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ মানুষও ব্যাংকারদের এই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করাকে আমলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কোথাও কোনো আলোচনাতেই তারা নেই।

এই অবরুদ্ধ সময়ে আপনার সবচেয়ে দরকার সঠিক তথ্য। এমনকি চিকিৎসার জন্য সঠিক হাসপাতালেও যেতেও আপনার তথ্য প্রয়োজন। আর সেই অতি প্রয়োজনীয় তথ্য আপনাকে দিচ্ছে গণমাধ্যম। ঝুঁকি বিবেচনায় ডাক্তারদের পরেই সাংবাদিকদের অবস্থান। তাদের প্রতিদিন হাসপাতালসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যেতে হয়। কিন্তু তাদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। প্রতিদিনই গণমাধ্যম কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। একটি টেলিভিশন তো সংবাদ প্রচার দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের কপালেও গালি ছাড়া আর কিছু জোটে না। প্রধানমন্ত্রীও শুকনো ধন্যবাদ দিয়েছেন। কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা, বীমা সুবিধা ছাড়াই কাজ করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। তবুও তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

এছাড়া ক্যাবল অপারেটর, ইন্টারনেট প্রোভাইডেরদের কর্মীরাও কাজ করে যাচ্ছে। ই-কমার্সের কর্মীরা আপনার বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে আপনার পছন্দের পণ্য। তারা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ এদের দরকারটা বোঝেই না।

কিন্তু আপনারা তো নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন, আপনাদের গৃহবাসকে নিশ্চিন্ত, নির্ভার, নিরাপদ, স্বস্তিদায়ক করতে কত লক্ষ মানুষকে প্রতিদিন পথে ঘাটে, হাসপাতালে, ব্যাংকে কাজ করতে হচ্ছে। আপনি বলতে পারেন, এত লোক দরকার কী, কিছু কমিয়ে ফেললেই হয়। আচ্ছা আপনিই প্রায়োরিটি ঠিক করে দিন, কাকে কাকে কমাবো। পুলিশ-প্রশাসন ছাড়া তো চলবে না। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসও তো লাগবেই। কাঁচাবাজার, ঔষধের দোকান ছাড়াও তো চলবে না। আচ্ছা ইন্টারনেট তো অত দরকারি নয়, অন্তত মৌলিক চাহিদা নয়; এটা বন্ধ থাক। আপনারা নিশ্চয়ই আমাকে মারতে আসবেন। আমি জানি ইন্টারনেট ছাড়া আপনাদের এক মুহূর্তও চলবে না। তাই সবগুলো সার্ভিসই দরকারি। কোনটা ছাড়াই চলবে না। আচ্ছা এবার একটা ছোট্ট প্রশ্ন, এই যে আপনাদের জন্য লাখ লাখ লোক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত খেটে মরছে, তাদের কথা ভেবেছেন কখনো? সারাক্ষণ তো পুলিশ ঘুষ খায়, ডাক্তার পালিয়ে যায়, সাংবাদিকরা দালাল বলে গালি দিচ্ছেন। তাহলে আপনার জন্য সব তৈরি করে দিচ্ছে কারা? প্লিজ মন থেকে সব বিদ্বেষ, ঘৃণা ঝেড়ে ফেলুন। আপনাকে নিশ্চিন্ত রাখতে যারা কাজ করছেন, তাদের মন থেকে ভালোবাসুন, সাহস দিন, পাশে থাকুন।

 

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর