আমি যখন এ লেখাটা লিখছি তখন সারা বিশ্বজুড়ে ১.৫৮ বিলিয়ন ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি পাঠগ্রহণ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। শতাংশের হিসেবে প্রায় ৯১% এর ওপরে ১৮৮টি দেশের শিক্ষার্থীরা এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আসলে সারা পৃথিবীই একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। সকাল-সন্ধ্যা মৃত্যুর মিছিল, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় উদ্বেগ আর সুস্থ হবার খবরে স্বস্তি-এই হয়ে পড়ছে আজকালকার দিনলিপি। করোনার এই করাল গ্রাসে মানুষের চলার গতি যেমন থমকে গেছে সেই সঙ্গে থমকে গেছে উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, তেমনি থমকে গেছে শিক্ষা।
বিশ্ব পরিস্থিতি থেকে একটু বাংলাদেশের দিকে চোখ রাখি। ইউনেস্কো রিপোর্ট বলছে, আমাদের দেশে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী যার মধ্যে ১৭.৩৩ মিলিয়ন প্রাথমিক, ১৫.৮৬ মিলিয়ন মাধ্যমিক আর ৩.১৫ মিলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের ৪৬টি পাবলিক, ১০৫টি প্রাইভেট এবং ৩টি আন্তর্জাতিকসহ (ইউজিসি ওয়েবসাইট কর্তৃকপ্রাপ্ত) মোট ১৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয় করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের নির্বাহী আদেশে বন্ধ আছে।
বহির্বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটামুটি সম্পূর্ণরূপেই একটি আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ক্লাসে পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অনুরূপ আমাদের দেশেও বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কিছু স্কুলেও সীমিত পরিসরে অনলাইন শিক্ষণ অ্যাপ্লিকেশন যেমন জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট বা সমমানের লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে পাঠদান প্রক্রিয়া চালু রেখেছে সেমিস্টারের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে।
প্রতিষ্ঠানের বাহিরেও নিজ উদ্যোগে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক শিক্ষক তাদের পাঠদান প্রক্রিয়া বজায় রেখেছে। বিশেষ করে যখন এটি অনুধাবন করা যাচ্ছে যে করোনা পরিস্থিতি আরো দীর্ঘ হবে এবং জীবনের পাশাপাশি এটি সর্বক্ষেত্রেই একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
অনলাইন কোর্সের ধারণাটি নতুন কোন বিষয় নয়। সারা পৃথিবীতেই দিনে দিনে এর কদর বাড়ছে। অনলাইন ভিত্তিক কোর্সগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও আলোচনা থাকলেও বিগত কিছু বছর যাবৎ বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ক্যাম্পাস ভিত্তিক কোর্সের সাথে সাথে অনলাইন ভিত্তিক কোর্স অফার করা শুরু করলে এই অবস্থার একটি ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
আধুনিক পাঠদান পদ্ধতি আর আধুনিক অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতির প্রচলনের সাথে সাথে অনলাইন কোর্সের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নটি এখন তেমন যুক্তিপূর্ণ মনে হয় না। বরং এটি বিশ্বব্যাপী অনেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি করেছে বাড়িতে বসে বা দেশে থেকে বিশ্ব র্যাংকিং এর একটি উপরের সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হওয়া। বস্তুত: অনলাইন ভিত্তিক পাঠদান সব বিষয়ের জন্য প্রযোজ্য না হলেও শিক্ষকের মুনশিয়ানা, অনলাইন প্লাটফর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা এটি বেশিরভাগ বিষয়ের জন্য উপযোগী করে তুলতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অনলাইন ভিত্তিক কোর্স পরিচালনা করা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। কিছু প্রতিষ্ঠান এবং অল্প সংখ্যক শিক্ষক নিজ উদ্যোগে গুগল ক্লাসরুম বা অন্যান্য লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস ব্যবহার করলেও এটি মূলত কন্টেন্ট শেয়ারে সীমাবদ্ধ ছিল। আসলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করোনার প্রকোপ একরকম বাধ্যই করেছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে অনলাইন ব্যবস্থায় পাঠদান শুরু করতে। সে হিসাবে এদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা।
অনলাইন পাঠদানের সাথে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি এবং ইন্টারনেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার একটি ইস্যু, সম্ভবত: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। উন্নত দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের এই সমস্যাটির সম্মুখীন হতে হয় না, যেটি ইন্টারনেটে ইনফ্রাস্ট্রাকচারে পিছিয়ে থাকা একটি দেশের শিক্ষার্থীকে মোকাবেলা করতে হয়। আরেকটি প্রধান বিষয়য় হলো ব্যান্ডইউথের দাম। আমাদের দেশের টেলিকমসহ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা প্রায়শই দাবি করেন, অন্য দেশের তুলনায় এদেশে ব্যান্ডইউথের দাম সস্তা! হবে হয়ত। কিন্তু আমি নিশ্চিত ঐ দেশগুলোর তুলনায় আমাদের মাথাপিছু আয় আর আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান, যেটি সম্ভবত: টেলিকমগুলোর বিবেচনায় নেবার প্রয়োজন মনে করেন না।
টেলিকমগুলো উদ্ভট প্যাকেজের প্রসারে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করলেও করোনার এই দুর্যোগে যে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পাঠ গ্রহণ করছে, তাদের জন্য কোনো স্পেশাল প্যাকেজ প্রচলনের জন্য চিন্তা করেননি, যেটি অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। যাই হোক, করোনা পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং রাজনীতি, অর্থনীতিসহ শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
একটু দেখে নেই, কি হতে পারে এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো।
১. বাংলাদেশ, চীনসহ বেশকিছু দেশ ইতোমধ্যেই টেলিভিশনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশে এর বিশাল পরিচালনা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রাম, মফস্বলে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অবশ্যই একটি উপযোগী পদ্ধতি যদিও এটিতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক মিথস্ক্রিয়া (interaction) টি একেবারেই অনুপস্থিত। সেই প্রেক্ষিতে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষাদান গণমাধ্যম ব্যবহারের চেয়ে অধিক যুক্তিযুক্ত।
ডিজিটাল শিক্ষার একটি শ্লোগান হলো, 'শিক্ষা সর্বত্র, সবসময়'। একজন শিক্ষার্থী যেহেতু ইন্টারনেট ও যেকোন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস (মোবাইল ফোন, ট্যাব, কম্পিউটার) ব্যবহার করেই যেকোন অবস্থায়, যেকোন জায়গা থেকে এবং যেকোন সময় ক্লাসে যুক্ত হতে পারে, সেহেতু করোনা উত্তর সময়েও যে এটির ব্যবহার বাড়তে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেকোন প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে অনলাইন হতে পারে ট্র্যাডিশনাল শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার যথার্থ বিকল্প।
করোনার এই বিশেষ সময় তাই আমাদের দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে অনলাইন পাঠদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা, কৌতূহল বৃদ্ধি সর্বোপরি দক্ষতা বৃদ্ধির সময় হিসেবেই বিবেচিত হবে বলে আশা করি।
অনলাইন শিক্ষা সম্পর্কে যে "ট্যাবু" আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা ভাঙ্গতেও এটি বিশেষ কার্যকরী হবে বলে বিশ্বাস করি। অনলাইন শিক্ষাদানের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রাখা। কিন্তু একটি বড় সেশনকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে, ইন্টারএ্যাকটিভ কাজের মাধ্যমে ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখার কাজটি সহজেই করা সম্ভব। আজকে প্রাথমিকের যে শিক্ষার্থীটি অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করছে, সে যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছাবে, অনলাইন শিক্ষা গ্রহণ তার কাছে সহজাতই মনে হবে।
২. সরকারি এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য বেসরকারি বিশেষ করে টেক- এবং টেলিকম-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটি একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। দেশীয় টেক-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম দামে এবং সহজে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষাদানের পদ্ধতির প্রচলন ও বিতরণের সহায়ক হবে। দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপযোগী কোর্সগুলো অনলাইনে অফার করার ব্যাপারে মনোযোগী হবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মফস্বলে থেকেও কম খরচে দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ থেকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবেন।
৩. শুধুমাত্র অনলাইন কোর্স নয়, বিশ্বজুড়েই ইন্টারনেটের প্রচার আর প্রসারে একটি বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, আর তা হলো ইন্টারনেট ভিত্তিক 'বিভাজন' (digital divide)। যার শাব্দিক অর্থ হলো, যার কাছে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি আছে সে, যার কানেক্টিভিটি নেই তারচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে।
অনলাইন পাঠদান প্রক্রিয়ার সাথেও এই অপবাদটি জড়িত। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত কম্পিউটার নেই, অনেকেরই সঙ্গতি নেই উচ্চমূল্যের ব্যান্ডইউথ কিনে লাইভ ক্লাসে সংযুক্ত থাকার। হতাশার বিপরীতে আশার কথা হলো, আমাদের বিপুল সংখ্যক মানুষ আজ মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই স্মার্ট ফোনের ব্যবহারকারী। সুতরাং ব্যান্ডইউথের গতি আর দাম-এই দুটোই মূলত প্রধান অন্তরায় অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যাপক অর্থে ছড়িয়ে পরার জন্য। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই দুটির ব্যাপারে সুদৃষ্টি দিবেন এই প্রত্যাশায় রইলো।
মো: মাহবুবুল আলম: অধ্যাপক, কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা